তাহসিনা মাহজাবিন

  ১৪ অক্টোবর, ২০২২

কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিক পদ্ধতি

ছবি : সংগৃহীত

কঠিন বর্জ্য বলতে বোঝায় কঠিন ও প্রায় কঠিন বর্জ্যবস্তু। যেমন : আবর্জনা, রাবিশ বা জঞ্জাল, ভাঙা-নষ্ট পাত্র, প্লাস্টিক দ্রব্য, ধাতুর খাদ, ছাই, মেডিকেলে ব্যবহৃত সরঞ্জাম জৈবদ্রব্য বর্জ্যকে কঠিন বর্জ্য হিসেবে ধরা হয়। বর্জ্যবস্তু মানুষও প্রকৃতির ক্ষতি করে। তাই এর ব্যবস্থাপনা খুবই জরুরি। বর্জ্যবস্তুর প্রকৃত ব্যবস্থাপনার জন্য মানুষের পরিবেশ সচেতনতা এবং উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা অপরিকল্পনীয়। পৃথিবীর যে দেশ যু বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সে দেশ তত বেশি উন্নত। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলতে বোঝায় বর্জ্য সংগ্রহ, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পুনর্ব্যবহার এবং নিষ্কাশনের সমন্বিত প্রক্রিয়া।

কঠিন বর্জ্যপদার্থ মাটির ওপর দীর্ঘদিন ফেলে রাখলে তা পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, পরিবেশ দূখিু হয়। এর ফলে মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, পচা-আবর্জনা থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়, পোকা-মাকড়ের জন্ম হয়, রোগজীবাণু ছড়ায় এবং পরিবেশের সৌন্দর্যহানি ঘটায়। কঠিন বর্জ্যপদার্থর মূল উৎস কল-কারখানার বর্জ্য, নগরায়ণ, কৃষিজাত কঠিন বর্জ্যবস্তু, বায়ো মেডিকেল প্যাথলোজিক্যাল বর্জ্য বা হাসপাতালের বর্জ্য, গৃহস্থালির বর্জ্য, খনিজাত কঠিন বর্জ্য, গ্রাম ও নগর জনবসতি এবং পৌরবসতির বর্জ্য। কঠিন বর্জ্য পদার্থসমূহের সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং পুনর্ব্যবহার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে অমূল্য সম্পদে পরিণত করা যায়। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে বর্তমান বিশ্ব আজ হুমকির সম্মুখীন। বাংলাদেশ পৃথিবীর অষ্টম জনবহুল এবং দশম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। বিপুল জনসংখ্যার সঙ্গে সমানতালে বৃদ্ধি পাচ্ছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমস্যা তারই সঙ্গে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার টন বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এই কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আধুনিক পদ্ধতির সঠিক বাস্তবায়ন করা হয়ে ওঠেনি এখনো। বাংলাদেশে বর্তমানে বর্জ্য সৃষ্টির পরিমাণ প্রতি বছর প্রায় ২২.৪ মিলিয়ন টন, যা মাথাপিছু দাঁড়ায় ১৫০ গ্রাম। এই হারে বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণ বাড়তে থাকলে ২০২৫ সালে এসে দাঁড়াবে ৪৭ হাজার ৬৪ টন এবং মাথাপিছু হার ২২০ কিলোগ্রাম, যা দেশের জন্য হুমকির কারণ। পরিবেশকে এই মারাত্মক বর্জ্যদূষণের হাত থেকে রক্ষার জন্য পরিকল্পিতভাবে কঠিন বর্জ্য পদার্থসমূহের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় দূষণ রোধ করতে হবে এবং বর্জ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদে পরিণত করার চেষ্টা করতে হবে। এর জন্য আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অবলম্বন করা খুবই জরুরি।

নিম্নে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিক পদ্ধতি :

১. ইনসিনারেশন একটি আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি। ইনসিনারেশন বা জ্বলন হলো একটি বর্জ্য নিষ্কাশন বা নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া, যার দ্বারা শক্ত জৈববস্তুগুলো দহন/পোড়ানোর মাধ্যমে বায়বীয় বস্তুতে পরিণত করা যায়। এটি একটি আধুনিক নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি এবং রাসায়নিকভাবে সংঘটিত প্রক্রিয়া, যা জৈববর্জ্যকে ক্ষয় করে এবং ধ্বংস করে দেয়। যেহেতু পোড়ানো বর্জ্যরে পরিমাণ কমাতে পারে, সেহেতু এটি ল্যান্ডফিলের থেকে অধিক কার্যকর পদ্ধতি। এটি অন্যস্থানে বর্জ্য পরিবহনের প্রয়োজনীয়তাও দূর করে। বিদ্যুৎ উৎপাদনেও বিশেষ ভূমিকা রাখে ইনসিনারেশন।

২. পাইরোলাইসিস একটি দ্রুত বিকাশমান বায়োমাস তাপ রূপান্তর প্রযুক্তি এবং পরিবেশবান্ধব কর্মদক্ষতা বৈশিষ্ট্যের কারণে বিশ্বব্যাপী অনেক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। বর্জ্য থেকে কাচ, ধাতু, প্লাস্টিক পৃথকীকরণ করার পর এই প্রযুক্তির মাধ্যমে পাইরোলাইসিস চুল্লিতে প্রক্রিয়াকরণে কঠিন বর্জ্য, কৃষির অবশিষ্টাংশ, স্ক্র্যাপ টায়ার, অপুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ইত্যাদি বর্জ্যকে পরিচ্ছন্ন শক্তিতে রূপান্তর করে। এ ছাড়া এটি তাপ, বিদ্যুৎ এবং রাসায়নিক পণ্য উৎপাদন করতে ব্যবহৃত হয়।

৩. বর্জ্য পৃথকীকরণ একটি অন্যতম পদ্ধতি। যার মাধ্যমে ভেজা বর্জ্য ও শুকনো বর্জ্য পৃথক করা হয়, যাতে শুকনো বর্জ্য সহজে পুনর্ব্যবহার এবং ভেজা বর্জ্য কম্পোস্ট হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বর্জ্য পৃথকীকরণ বর্জ্যরে ধরন, সর্বাধিক উপযুক্ত চিকিৎসা এবং নিষ্পত্তির ওপর ভিত্তি করে হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। পৃথকীকরণের পর বিভিন্ন প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা যায়। যেমন : কম্পোস্টিং, পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং জ্বলন। বর্জ্য পৃথকীকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া।

৪. গ্যাসিফিকেশন হলো অনন্য প্রক্রিয়া, যা একটি কার্বনভিত্তিক উপাদান, যেমন কঠিন বর্জ্য বা জৈববস্তুকে প্রকৃতপক্ষে না পুড়িয়ে শক্তির অন্য রূপে রূপান্তরিত করে। পরিবর্তে, গ্যাসীকরণ রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে কঠিন, তরল বর্জ্য পদার্থকে গ্যাসে রূপান্তরিত করে। গ্যাসিফিকেশন একটি তাপ রাসায়নিক প্রক্রিয়া, যেখানে বর্জ্য প্লাস্টিককে ৭০০-১১০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় নিয়ন্ত্রিত পরিমাণ অক্সিজেন, বায়ু, অক্সিজেন-সমুদ্ধ বায়ু এবং বাষ্প দ্বারা উত্তপ্ত করা হয়, যাতে সংশ্লেষণ গ্যাস বা সিঙ্গাস নামক শিল্প গ্যাসের মিশ্রণ তৈরি হয়।

৫. কঠিন বর্জ্য শোধনের আরেকটি পদ্ধতি হলো কম্পোস্টিং। এটি একটি জৈবিক প্রক্রিয়া যেখানে বর্জ্যরে জৈব অংশকে পচার জন্য নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় রাখা হয়। কম্পোস্টিং একাধারে আবর্জনা ও নর্দমার ময়লা প্রক্রিয়াকরণ এবং পুনর্ব্যবহারের পদ্ধতি। যেহেতু বর্জ্য পোড়ানো, ল্যান্ডফিলিং পরিবেশবান্ধব না, সেহেতু কম্পোস্টিংয়ের প্রয়োগ বাড়াতে হবে।

৬. ল্যান্ডফিল হলো সবচেয়ে প্রাচীন ও সাধারণ পদ্ধতিগুলোর মধ্যে একটি। সব কল-কারখানা, বসতি ও সমাজের ময়লা-আবর্জনা এনে ফেলা হয় ল্যান্ডফিল সাইটে এবং বর্জ্যগুলোকে পদ্ধতিগতভাবে রাখা হয়। তবে এই পদ্ধতিটি মোটেও পরিবেশসম্মত নয়। ল্যান্ডফিলগুলোর কার্যকরিতা নিশ্চিত করতে বিশেষ ডিজাইন এবং দক্ষ পরিদর্শক প্রয়োজন সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য। এটি বিভিন্নভাবে পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে।

৭. স্যালভেজিং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অন্যতম একটি আধুনিক পদ্ধতি। এটি হলো কঠিন বর্জ্য প্রবাহ থেকে পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য আলাদাকরণ পদ্ধতি, পরে পুনর্ব্যবহারযোগ্য, কম্পোস্টিং পদ্ধতি প্রয়োগের জন্য। উপরোক্ত কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিক পদ্ধতিগুলোর সুষ্ঠু ব্যবহার বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। শেষ গন্তব্যস্থল হিসেবে মাটিচাপা দেওয়া হয় এসব বর্জ্যরে, যেখানে-সেখানে স্তূপাকারে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে রাখা হয়। যার ফলে বর্জ্য পঁচে-গলে, দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পরিবেশ নানাভাবে দূষিত করছে ব্যাপক হারে। বর্ষাকালে আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করে এই চিত্র, যা আমাদের ভবিষ্যৎকে মারাত্মক হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষার লক্ষ্যে বর্জ্যব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে হবে। একটি শহরের সৌন্দর্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অনেকাংশে নির্ভর করে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর। কথায় আছে, আজকের বর্জ্য আগামী দিনের সম্পদ। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশাল জনসংখ্যার এই দেশে বেশির ভাগ মানুষেরই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সঠিক ধারণা নেই। আমাদের উচিত এই বর্জ্য থেকে কীভাবে তা গুরুত্বপূর্ণ সম্পদে পরিণত করা যায় সে দিকে বেশি নজর দেওয়া এবং সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় 3R (Reduce, Recycle, Reuse)-এর পরিবর্তে 5R (Recovery, Refuse, Reduce, Recycle, Reuse)-এ অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যকর ও বসবাসযোগ্য পরিবেশ গড়ে তুলতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঠিক পদ্ধতি ব্যবহারের দিকে নজর দিতে হবে আজই। সম্পদের পুনরায় ব্যবহারের মাধ্যমে যেমন লাভবান হওয়া যাবে, ঠিক তেমনি মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতির ঝুঁকিও হ্রাস করা সম্ভব হবে। এসব দিক বিবেচনায়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত করে তোলার বিকল্প কিছু নেই।

লেখক : এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা,বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিক পদ্ধতি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close