আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা

  ০১ অক্টোবর, ২০২২

আইনের দিগন্ত খুলে দেবে ‘প্রবেশন’ 

ছবি : সংগৃহীত

কোনো বস্তু অম্লিয়, নাকি ক্ষারীয় তা নির্ণয় করা যায়, লিটমাস পেপার দ্রবণে পরীক্ষা করলে। ঠিক তেমনি কোন কাজটি অপরাধ এবং কোন কাজটি অপরাধ নয় তা নির্ণয় করা যায়, রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন দ্বারা। অপরাধ বলতে সাধারণত আইন দ্বারা নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় কাজকে বোঝায়। অর্থাৎ রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত ও বলবৎকৃত আইনের পরিপন্থি এবং দণ্ডনীয় যেকোনো কাজই অপরাধ। অপরাধ একটি সামাজিক ব্যাধি। এই ব্যাধি অপসারণে প্রতিটি সভ্য দেশের মতো বাংলাদেশেও অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি প্রদানের প্রচলিত আইন রয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, শাস্তি অপরাধ প্রতিরোধে সহায়ক না হয়ে অপরাধ বিস্তারে সহায়ক হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার প্রায় সর্বক্ষেত্রেই দণ্ডিত অপরাধীদের সাজা ভোগের নিমিত্তে কারাগারে পাঠানো হয়। এতে দেশের কারাগারসমূহের সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে কারাগারে থাকাকালীন সেই ব্যক্তি অন্যান্য দাগি অপরাধীদের সংস্পর্শে এসে মারাত্মক ধরনের অপরাধের কু-অভিজ্ঞতা ও ক্ষতিকর কুশিক্ষা লাভ করে থাকে। এজন্য অপরাধীদের সংশোধনের একটি বিশেষ ব্যবস্থা হচ্ছে প্রবেশন। প্রবেশন বলতে কোনো অপরাধীকে তার প্রাপ্য শাস্তি স্থগিত রেখে, কারাবদ্ধ না রেখে বা কোনো প্রতিষ্ঠানে আবদ্ধ না করে সমাজে খাপ খাইয়ে চলার সুযোগ প্রদান করাকে বোঝায়। প্রবেশন Probation শব্দটি লাতিন শব্দ Probare থেকে এসেছে। প্রবেশনের শব্দগত অর্থ পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চেষ্টা দ্বারা শর্তসাপেক্ষে অপরাধীর চরিত্র সংশোধনের ব্যবস্থা করা। ফৌজদারি মামলায় কোনো অপরাধীর আদালত কর্তৃক ধার্যকৃত চূড়ান্ত রায় বা শাস্তি স্থগিত করে তার আচরণ সংশোধনের এবং নিজেকে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেওয়াই হচ্ছে প্রবেশন। প্রবেশন হচ্ছে অপরাধীকে সমাজে স্বাভাবিক জীবনযাপনের এক প্রতিশ্রুতি। অপরাধীকে এই প্রতিশ্রুতি মুচলেকার মাধ্যমে লিখিতভাবে আদালতে দিতে হয়। এই প্রতিশ্রুতি পূরণে রয়েছে পুরস্কার এবং ব্যর্থতায় শাস্তি।

প্রবেশনের উদ্দেশ্য আত্মশুদ্ধি করতে সুযোগ দেওয়া ও সাহায্য করা; চারিত্রিক সংশোধনের মাধ্যমে পুনঃঅপরাধ রোধ করতে সহায়তা করা; প্রবেশনারকে শৃঙ্খল জীবনযাপনে সহায়তা করা; একজন আইনমান্যকারী নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করা; প্রবেশনারের পিতা-মাতা এবং অন্য আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের মন থেকে বিরূপ মনোভাব দূর করে প্রবেশনারের প্রতি সমানুভূতিশীল করে তোলা; সমাজে উৎপাদনশীল ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ দান করা; মোটিভেশন, কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে অপরাধ সম্পর্কে প্রবেশনারকে সচেতন করে তাকে অপরাধ থেকে দূরে রাখা; সামান্যতম ভুলের জন্য অপরাধীকে ‘দাগি আসামি’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা; সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার মাধ্যমে অর্থাৎ অপরাধের মূল কারণসমূহ নির্ণয়পূর্বক প্রবেশনারের সংশোধনের ব্যবস্থা করা; সংশোধনের পর প্রবেশনারকে সমাজে পুনঃএকত্রীকরণ; সমাজে অপরাধের সংখ্যা উত্তরোত্তোর কমিয়ে আনা ইত্যাদি।

John Augustus-কে প্রবেশন ব্যবস্থার জনক বলা হয়। প্রবেশনব্যবস্থা উৎপত্তির পেছনে এই মানবতাবাদী জুতা প্রস্তুতকারক ব্যক্তির অবদান অনস্বীকার্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটর রাজ্যে ১৮৭৮ সালে সর্বপ্রথম প্রবেশন আইন পাস করা হয়। পরে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য অঙ্গরাজ্যগুলোতেও Probation Law পাস হয়। নিউজিল্যান্ডে ১৮৮৬ সালে প্রবেশন সার্ভিস গঠিত হয়। ইংল্যান্ডে ১৯০৭ সালে প্রবেশন Probation of Offenders Act পাস হয়। এই আইনের মাধ্যমে ১৯২৫ সালে ব্রিটেনের সব আদালতে প্রবেশন অফিসার নিয়োগের ব্যবস্থা গৃহীত হয়। ইংল্যান্ডে বর্তমানে সেনটেনসিং অ্যাডভাইসরি প্যানেল অপরাধের জন্য প্রবেশন, কমিউনিটি শাস্তিসহ কারাদণ্ডাদেশের বিকল্প পদ্ধতিগুলো প্রয়োগের সুপারিশ করে থাকে। ১৯৫১ সালে গ্রিস অপরাধ সংশোধনমূলক ব্যবস্থা হিসেবে প্রবেশন ব্যবস্থা গ্রহণ করে। একইভাবে আয়ারল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ইত্যাদি দেশেও প্রবেশন ব্যবস্থা প্রচলন করে।

বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় প্রায় সর্বক্ষেত্রেই দণ্ডিত অপরাধীদের সাজা ভোগের জন্য কারাগারে পাঠানো হয়। যেহেতু অপরাধ দমনে রাষ্ট্রের অন্যতম একটি লক্ষ্য হলো দুষ্টের দমন। সে কারণে রাষ্ট্রের মধ্যে কেউ অপরাধ করলে তাকে আইনের আওতায় এনে বিচারে সোপর্দ করা হয়। রাষ্ট্রের দায়িত্ব প্রচলিত আইন অনুসরণ করে বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্য হচ্ছে অপরাধী যাতে ভবিষ্যতে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পুনরায় জড়িত হতে না পারে এবং নিজেকে সংশোধন করে সমাজের মূল স্রোতোধারায় ফিরে আসার সুযোগ পায়। লঘুদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধী এবং প্রথম অপরাধকারীর শাস্তি হিসেবে কারাগারে পাঠানোর ফলে দাগি অপরাধীদের সাহচর্যে তাদের মধ্যে বড় অপরাধ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে কারাদণ্ডাদেশের অতি নির্ভরশীলতার কারণে কারাগারসমূহে সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর সংখ্যা ক্রমেই আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারাগারের প্রকোষ্ঠে দীর্ঘদিন পর্যন্ত সাজা ভোগের পর সমাজে ফিরে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিকসহ অনেক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পুনরায় আরো বড় অপরাধ করে বসে। কলোনিয়াল ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি অর্থাৎ অপরাধী কারাগারে বন্দি থাকার কারণে তার পরিবার অর্থনৈতিক সংকটে পতিত হয়, ফলে পরিবারটির জীবিকা চির অনিশ্চয়তার মুখে ফেলে দেয়।

আরো আশ্চর্যের বিষয়, অতিসম্প্রতি গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কারাগারসহ ৬৮ কারাগারে বন্দি ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৬২৬ জন হলেও বর্তমানে ৮৬ হাজার বন্দি রয়েছে (২১ আগস্ট ২০২২ তারিখ পর্যন্ত), যা কারাগারে ‘তিল ঠাঁই আর নাহিরে’ অবস্থা বলা চলে। যদিও ৬৮ কারাগারে অনুমোদিত চিকিৎসকের পদ রয়েছে ১৪১টি, কিন্তু বাস্তবে চিকিৎসক রয়েছে মাত্র ৫ জন। কোভিড-১৯-সহ বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পাওয়া কারণে বিগত ৬ বছরে ৪১৯ জন কারাবন্দির অকালমৃত্যু হয়েছে। ফলে বন্দি নাগরিকের জীবনের ও স্বাস্থ্যের অধিকার খর্বের বিষয়টি উদ্বেগজনক অবস্থা সৃষ্টি করছে। যদিও বাংলাদেশের সংবিধান ৩১ অনুচ্ছেদ বর্ণিত আছে, আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে এবং ৩২ অনুচ্ছেদে আইনানুযায়ী জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না।

তাই বিশেষজ্ঞরা অপরাধ সংশোধনের ক্ষেত্রে একজন অপরাধীর শাস্তি প্রদান ব্যবস্থার পরিবর্তে সংশোধনমূলক প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য করে নিজের সমাজে রেখে সংশোধন ও পুনর্বাসনমূলক ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছেন। তাই বর্তমান ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় অপরাধীকে সব ক্ষেত্রেই সাজা আরোপ করা সমর্থন করে না। কেননা সাজা প্রদানের উদ্দেশ্য সংশোধনমূলক, প্রতিহিংসামূলক নয়। সংশোধনের এই ধারণা থেকে ১৯৬০ সালে অপরাধী প্রবেশন অধ্যাদেশ জারি করা হয়। নানান সমস্যার কারণে প্রবেশন সার্ভিস এ দেশে গত ৬০ বছরে দৃশ্যমান হয়নি। তারও আগে ১৯১৯ সালে ভারতীয় জেল রিফর্ম কমিটি লঘুদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬২ ধারার পরিধি বৃদ্ধির সুপারিশ করেন। বাংলাদেশে প্রবেশনের প্রাথমিক ভিত্তি ১৯৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬২ ধারা। এই ধারা অনুসারে যে ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি প্রথমবারের মতো চুরি, তহবিল তছরুপ অথবা দণ্ডবিধিতে বর্ণিত অন্য যেকোনো অপরাধ করে, যার শাস্তি দুই বছরের কম, সেসব সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ভালো আচরণের জন্য বিজ্ঞ আদালত নিজ বিবেচনায় প্রবেশন প্রদানের মাধ্যমে মুক্তি দিতে পারেন। প্রবেশন জেলের বাইরে কারাগারের সাজার মতো, এর মূল উদ্দেশ্য অপরাধীর চরিত্র সংশোধনের মাধ্যমে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা। ‘টোকিও রুলস, ১৯৯০’ স্বল্প খরচে কার্যকর প্রবেশন ব্যবস্থা প্রণয়নের রূপরেখা তুলে ধরেছে।

যদিও বাংলাদেশ সরকার ১৯৯০ সালে দি ইউনাইটেড ন্যাশনস স্ট্যান্ডার্ড মিনিমাম রুলস ফর নন-কাস্টোডিয়াল মেজার’স-এ স্বাক্ষর করেন, যা ওই চুক্তির ১.৫ ধারায় বাধ্যবাধকতার ফলে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় প্রবেশনসহ নন-কাস্টোডিয়াল বিষয়ে কাজ করার জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবেও দায়বদ্ধ। সুপ্রিম কোর্ট ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ Probation of Offenders Ordinance,1960-এর বিধান প্রতিপালনের জন্য সার্কুলার জারি করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের ওই সার্কুলারে পর ২০১৯-২০ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনাকালে দীর্ঘদিন আদালত বন্ধ থাকা সত্ত্বেও প্রবেশন সুবিধা পেয়েছেন ২৩৫৫ জন, প্রতিদিন এই সুবিধা বাড়ছে। তাই বর্তমানে আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে অপরাধীকে শাস্তি আরোপ করা আইন সমর্থন করে না।

যার ভিত্তিতে রাষ্ট্র ‘প্রবেশন আইন, ২০২০’ খসড়া তৈরি করে, বর্তমানে উক্ত আইনটি মহান জাতীয় সংসদ কর্তৃক পাসের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সম্প্রতি মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ‘নুর মোহাম্মদ বনাম সরকার এবং অন্যান্য’ ক্রিমিনাল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল নং ১২৭১/২০১৭, [১৫ এসসিওবি (২০২১) আপিল বিভাগ ৭১] মামলার রায়ে মন্তব্য করেন, ‘আসামিকে জেলে পাঠানোই ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য নয়। বরং তার সংশোধনই হলো মুখ্য। জেলে পাঠানো হয় সে উদ্দেশ্য পূরণকল্পে এবং তার নিরাপত্তার জন্য। বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায় : ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় প্রবেশন প্রতিষ্ঠায় ইতোমধ্যেই কিছু বিজ্ঞ জজ ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করতে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার মধ্যে যাদের কথা না বললেই নয়, যারা প্রবেশন আইনের আওতায় বেশ কিছু ব্যতিক্রমী রায় প্রদান করেছেন। প্রবেশন এর মূল্য উদ্দেশ্যে কিছু শর্তে পারিবারিক পরিবেশে থেকে সংশোধন হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। তবে, বিষয়টি এখনো খসড়ার বেড়াজালে আটকে আছে। প্রত্যাশা রাখি প্রবেশন বিষয়ে খসড়া আইনটি মহান জাতীয় সংসদে পাস হলে এই প্রবেশন ব্যবস্থাই ফৌজদারি বিচার কার্যক্রমের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করবে।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আইনের দিগন্ত,খুলে দেবে ‘প্রবেশন’
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close