মোহাম্মদ কবীর মোল্লা

  ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আইন না মানলে জনদুর্ভোগ বাড়বেই

ছবি : সংগৃহীত

জনবহুল ও গাড়িবহুল ব্যস্ত রাস্তায় দিনেদুপুরে খোলা ক্রেন দিয়ে ভারী কংক্রিট ওঠানামা করা হচ্ছিল। একশ পঞ্চাশ টন ওজনের বক্স গার্ডারকে ওপরে তুলতেই ক্রেনের চাকা ওপরে উঠে বেসামাল হয়ে পড়তেই দুর্ঘটনা ঘটে যায়। চলন্ত কারের মধ্যে গার্ডারটি চাপা দিলে গাড়িতে থাকা সাতজনের মধ্যে পাঁচজনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, গাড়িতে আটকা পড়ে আহত শিশু দুটি অনবরত কাঁদতে কাঁদতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। এসব নির্মাণকাজে মানুষ ও গাড়ি চলাচল বন্ধ করে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করে কাজ করার নিয়ম থাকলেও তার ব্যত্যয় ঘটেছে। সড়কগুলো প্রশস্ত না হওয়ায় কাজের সময় তা পুরোপুরি বন্ধ করার উপায় থাকে না। ১৫ আগস্ট ছুটির দিনের বিকাল হওয়ায় মানুষ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠান এবং জিয়ারতের উদ্দেশ্যে ঘরের বাইরে বের হয়েছিল। আলোচ্য গাড়িটিতে বউভাতের অনুষ্ঠান শেষে বাবা নিজে ড্রাইভ করে তার ছেলেসহ বৌমাকে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছিয়ে দিচ্ছিলেন। বিকাল সোয়া ৪টায় এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত গাড়ি থেকে দুুজন দরজা ঠেলে বের হয়ে আসতে পারলেও বাকি পাঁচজন বের হতে পারেননি। ফ্লাইওভার তৈরির বক্স গার্ডার অত্যন্ত ভারী জিনিস। এসব ওঠানামা করার জন্য নিরাপত্তা-সুরক্ষা জোরদার করার প্রয়োজন ছিল অনেক বেশি। কিন্তু ন্যূনতম নিরাপত্তাব্যবস্থা চোখে পড়েনি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বিআরটি ধারণাটি বিশ্বের বড় শহরগুলোতে একটি এক্সক্লুসিভ বাসওয়ে সিস্টেম। এটা সর্বপ্রথম কানাডার অটোয়ায় ১৯৭৩ সালে শুরু হয়েছিল। পরে ১৯৭৪ সালে ব্রাজিলের কুরিটিবাসহ নানা দেশে বিআরটি ব্যবস্থা চালু হয়। এশিয়ায় সর্বপ্রথম বিআরটি চালু হয়েছে জাকার্তায়। ২০০৪ সালে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় চালু হওয়া ২৫১.২ কিমি দীর্ঘ ট্রান্সজাকার্তা বিআরটি বিশ্বের দীর্ঘতম বিআরটি সিস্টেম।

ঢাকা বিআরটি কোম্পানি ২০১৩ সালে চালু হয়। তারা উত্তরা থেকে টঙ্গী হয়ে গাজীপুর পর্যন্ত ২০ কিমি দীর্ঘ ফ্লাইওভার নির্মাণের বর্তমান কাজ পেয়েছিল। ‘বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট’ বা বিআরটি নামে সে কাজ সমাপ্ত হওয়ার কথা ছিল আরো অনেক আগে। কিন্তু নানা সমস্যায় যথাসময়ে কাজ শেষ করা হয়নি। সেটাকে এ দেশীয় ঠিকাদারের মাধ্যমে দেরিতে করানো হচ্ছে।

একই প্রতিষ্ঠানের কাজে এর আগেও গার্ডার দুর্ঘটনা ঘটেছে। গত ১৫ জুলাই গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তার কাছে গার্ডার পড়ে এক ব্যক্তি মারা গেছেন। আহত হয়েছেন আরো কয়েকজন। তবুও টনক নড়েনি প্রতিষ্ঠানটির। একটি জাতীয় ট্র্যাজেডির দিনে আরেকটি মর্মন্তুদ ঘটনা মানুষকে আরো বেশি কষ্ট দিয়েছে। সিসি ক্যামেরায় বিয়েবাড়ি-ফেরত যাত্রীদের গাড়িতে ভারী বস্তু দিয়ে চাপা দিয়ে চ্যাপ্টা করার করুণ দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠেছে দর্শকের প্রাণ। ভাবা যায়, মৃত্যু কি এত সহজে স্পর্শ করতে পারে মানুষকে?

এগুলো অহরহ ঘটে চলেছে। তাই অনেককে হয়তো আহত করে না। কিন্তু নির্মাণকাজ তো শুধু দু-এক দিনের কোনো ব্যাপার নয়। এগুলো এখন পেশাদার প্রতিষ্ঠানের বারোমাসি কাজ। কিন্তু তাদের মধ্যে পেশাদারিত্বের বিন্দুমাত্র লক্ষণ দেখা যায় না। নির্মাণকাজে জননিরাপত্তার নিশ্চিত করার ব্যাপারে চুক্তি করা হয়ে থাকে। তাহলে সেসব কি কাগুজে চুক্তি মাত্র?

আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায়, জনবহুল রাস্তায় ছিল না কোনো ব্যারিকেড, সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড বা বিপৎসংকেতের নোটিসও নেই। ব্যবহৃত ক্রেনটি খুব হাল্কা প্রকৃতির। সেটি এত ভারী কাজের জন্য উপযুক্ত ছিল না। দুর্বল ক্রেন হোক বা সবল ক্রেন হোক, জনবহুল জায়গায় মানুষ ও গাড়ি চলাচলের মধ্যে সেগুলো ব্যবহার করা কি চুক্তির মধ্যে গণ্য আছে? নিশ্চয়ই নেই।

তাহলে এ ধরনের অবহেলা ও উদাসীনতা দেখানোর কারণ কী? আইন না মেনে চলা আমাদের অভ্যাগত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনের বিধিনিষেধ মেনে না চলার ব্যাপারে সবাই বেশ অভিজ্ঞতাভাব পোষণ করে থাকে। কারণ, দুর্নীতির মাধ্যমে আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে পার পাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এজন্যই জনদুর্ভোগের কথা মাথায় না এনে অন্যায় ও যেনতেনভাবে দায়সারা গোছের কাজ করা হয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি যদি ভাবত যে, একটি গার্ডার ছিটকে পড়লে কারো মৃত্যু না হোক, কিন্তু ছয়-সাত ঘণ্টার জন্য এই জনবহুল রাস্তাটিতে চলাচল বন্ধ হয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হবে তাহলে তারা প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে কাজ করত। কিন্তু তাদের সেই ভাবনা কই?

বিশেষ করে দেশের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা সেটি। আরো একটি বিশেষ বিষয় হলোÑ জনবহুল রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটলে ট্রাফিক জ্যামের কারণে অকুস্থলে পুলিশ বা ফায়ার ব্রিগেডের উদ্ধারকারী দল সেখানে কোনোভাবেই সময়মতো পৌঁছাতে পারেন না। উত্তরার দুর্ঘটনায় একই সমস্যা হয়েছে। পথচারীরা চিৎকার, হা-হুতাশ করেও কোনো কূলকিনার করতে পারেননি অসহায় মানুষকে সাহায্যের জন্য। সেখানে আরেকটি বড় ক্রেন না আসা পর্যন্ত গার্ডারটি সরিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে আহতদের উদ্ধার করা যায়নি। আমাদের উদ্ধারকারী দলের সামর্থ্য নেই বললে ভুল হবে। তাদের যথেষ্ট শক্তি ও সামর্থ্য রয়েছে। কিন্তু সময়মতো তারা নিজেদের সক্ষমতার ব্যবহার করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেছে’ বেশিরভ াগ দুর্ঘটনায়।

তবে ঠিক সময়মতো অকুস্থলে পৌঁছাতে না পারাটাও আমাদের উদ্ধারকাজে সক্ষমতা না থাকার একটি শর্ত। এজন্য রাস্তার থার্ড লেনকে সব সময় নির্দিষ্ট স্পিড দিয়ে ব্যবহার করার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। কোনোভাবেই রিকশা বা ধীরগতির যানবাহনকে থার্ড লেনে উঠতে দেওয়া যাবে না। উন্নত বিশ্বে শহর এলাকাতেও শুধু হাইস্পিডের গাড়িগুলো থার্ড লেনে উঠে দ্রতগতিতে চলে যাওয়ার নিয়ম রয়েছে। বিপদের সময় আমাদের সব লেনকেই রিকশা দ্বারা বা জ্যাম দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে থেমে থাকতে দেখা যায়। তাহলে অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি দ্রুত চলবে কীভাবে?

উদ্ধারকারী দলের অতিদ্রুত বা দৌড়ে কোনো দুর্ঘটনাস্থলে যেতে না পারাটা আমাদের দেশে দুর্ঘটনার মৃত্যুসংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে। আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসাসেবা শুরু করতে পারলে অনেক মূল্যবান জীবনকে হয়তো বাঁচানো সম্ভব হতো। আহত হয়ে আর্তনাদ ও আহাজারি শুনে দয়ালু পথচারীদের মন কাঁদলেও শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে সবাই দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। এটাই বড় হতাশার, এটাই ভয়ের।

সাধারণত বিদেশি প্রকৌশলী ও ঠিকাদার আমাদের দেশের মেগা প্রকল্পে কাজ বাগিয়ে নেন। কিন্তু এসব কাজের শ্রমিক ও মূল দায়িত্ব পালন করেন আমাদের দেশের মানুষ। বিদেশিরা নিজেদের দেশে যত সতর্কতার সঙ্গে নির্মাণকাজের নিয়মকানুন মেনে কাজ সম্পন্ন করেন আমাদের দেশে ঠিক ততটাই অবহেলা করেন। তারা মানসম্মত ও উপযুক্ত মেশিন ও ব্যবহার করছেন না। আমাদের শ্রমিক ও নির্মাণ এলাকায় জননিরাপত্তা গ্রহণের ক্ষেত্রেও যেনতেন প্রকারে দুর্বলভাবে কাজ চালিয়ে নেন। কারণ, এ দেশে এসব আইন ও নিয়মকানুনের ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখে তারাও চরম উদাসীন হয়ে দায়সারা নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন। যার চরম খেসারত দিতে হচ্ছে পথচারীদের মূল্যবান জীবনের মৃত্যুর বিনিময়ে।

আমাদের দেশে প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটে আর মানুষের আর্তনাদ ও কষ্ট বাড়ে। কর্তৃপক্ষ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বড় দুর্ঘটনার জন্য শুধু শোক প্রকাশ করে ক্ষান্ত দেন। সব দুর্ঘটনাই যে দুর্ঘটনা নয় তা যাচাই করার ফুরসত থাকে না। অনেক দুর্ঘটনাই হত্যাকাণ্ডের শামিল। এসব হত্যাকাণ্ডের দায়ভার কে নেবে? এগুলো যে হত্যাকাণ্ড সেজন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে শক্ত হাতে বিচার করতে হবে, শাস্তি দিতে হবে।

প্রায়ই তদন্ত কমিটি গঠিত হয় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর। কিন্তু কোনো ঘটনা ঘটতে পারে এমন আইনগুলো অমান্য করে চলেছে বা মানা হচ্ছে না সেটা অবলোকন করার জন্য আগে কেন তদন্ত কমিটি গঠিত হয় না? নির্মাণকাজে প্রতিদিন কতশত ক্রেন, ভারী মেশিন রাস্তায় চলাচলকারী মানুষের মাথার ওপর দিয়ে ঘুরছে তা কোনো কর্তৃপক্ষ আগেভাগে দেখার প্রয়োজন মনে করে না। যারা জনগণের মাথার ওপরে নিত্য ক্রেন চালু করে লাভের অঙ্ক কষে তাদের ব্যাপারে পূর্বাহ্নেই কোনো তদন্ত করা হয় না। সেটাও দায়িত্বের অবহেলা। এই অন্যায়গুলোকে কেউ গ্রাহ্য করে না।

অথচ, নির্মাণকাজে দুর্ঘটনা ঘটলে হঠাৎ কাজ বন্ধ করে দিয়ে আরো জনদুর্ভোগ বাড়ানোর জন্য পরামর্শদাতার অভাব নেই। একটি দুর্ঘটনার জন্য গোটা কাজ বন্ধ ঘোষণা করা হলে কোনো একটি সুযোগ-সন্ধানী পক্ষের আরো মুনাফা করার সুযোগ তৈরি হয়। এতে কষ্ট বাড়ে শ্রমিকদের, কষ্ট বাড়ে ভুক্তভোগী জনগণের। তাই হঠাৎ কাজ বন্ধ করে দেয়াটা হঠকারিতা, অন্যায়। অর্থাৎ, নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত কেউ কেউ শুরু থেকে শেষ অবধি নানা অন্যায়, অবহেলা ও উদাসীনতার মাধ্যমে জনদুর্ভোগ বাড়িয়ে তোলার কাজে তৎপর রয়েছেন।

এতে সময় ব্যয় হচ্ছে ও সম্পদের অপচয় হচ্ছে। নির্মাণকাজে এসব দুর্বল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার আগে সেগুলোর উপযুক্ততা যাচাই করে নিতে হবে। শ্রমিক ও সংশ্লিষ্ট জনগণের সার্বিক নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে যথাযথ নিরাপদ ও নিরাপত্তা করে তবেই কাজে হাত দিতে হবে। আমরা এভাবে হঠাৎ কারো মৃত্যু ঘটুক তা হতে দিতে চাই না। কোনো আহত শিশুর অনবরত কান্নাকে মর্মান্তিক মৃত্যু দিয়ে সমাপ্ত করতে চাই না। দেশে আরো অনেক নির্মাণকাজ হবে। এজন্য নতুনভাবে সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণের নীতিমালা চাই। নির্মাণকাজে মূল্যবান জীবন রক্ষার্থে ও ন্যূনতম জননিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে এসব ঐচ্ছিক গাফিলতি ও অবহেলার আশু অবসান হোক।

লেখক : কানাডা (মন্ট্রিয়েল) প্রবাসী, সাংস্কৃতিককর্মী

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আইন না মানলে,জনদুর্ভোগ বাড়বে
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close