রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২

পশ্চিমা রণকৌশল ও বিশ্ব অর্থনীতি সংকট

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সাত মাসে গড়িয়েছে। যুদ্ধের শুরুর দিকে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা চালিয়ে ইউক্রেনের বিশাল এলাকা দখল করে নিয়েছিল রুশবাহিনী। তবে সময় যত গড়িয়েছে, যুদ্ধের ময়দানে রাশিয়ার সাফল্য ততই ফিকে হয়েছে। সর্বশেষ ইউক্রেনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় খারকিভ থেকে পিছু হটতে হয়েছে রাশিয়ার সেনাদের। তাহলে বলাই যায়, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জন করছে। অনেক শহর ও গ্রাম তারা মুক্ত করছে এবং রুশ বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করছে।

ইউক্রেনীয় পাল্টা আক্রমণ কত দূর যাবে তা দেখার বিষয়, তবে এটি এরই মধ্যে স্পষ্ট যে রণক্ষেত্রের কৌশলগত ভারসাম্যে পরিবর্তন আসছে। পশ্চিমা অস্ত্রে সজ্জিত ইউক্রেনের বাহিনীর জন্য খারকিভের দখল ফিরে পাওয়া বড় অর্জন বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে, খারকিভ থেকে পিছু হটা কি মস্কোর সামরিক ব্যর্থতা, নাকি কৌশল। তাই খারকিভে ইউক্রেনের সেনাদের আপাতসাফল্যের চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন অনেকেই। এর মধ্য দিয়ে আগামী দিনে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণের চেষ্টাও চলছে। তবে এরই মধ্যে রুশ বাহিনী পিছু হটার পর ইউক্রেনের ইজিয়ামে মিলল গণকবর। পূর্বাঞ্চলীয় ইজিয়াম শহরে গণকবরের সন্ধান পাওয়ার দাবি করেছে ইউক্রেন। কবরটি থেকে ৪৪০টি মৃতদেহ উদ্ধারের কথা বলছে দেশটির পুলিশ। নিহতরা সবাই রুশ আগ্রাসনের শিকার বলে অভিযোগ কিয়েভের। রুশ সেনা প্রত্যাহারের পর ইজিয়াম এখন ইউক্রেনীয় সেনাদের দখলে।

এ মুহূর্তে রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্ব বড় সংকটে পড়েছে। শুধু মাঠের দক্ষতানয়, বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকেও ইউক্রেনের সেনাবাহিনী রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে মাত করে দিয়েছে। খারকিভে ইউক্রেনের বাহিনীর সফলতার মূলে রয়েছে রুশ গোয়েন্দা বাহিনীর প্রতারণা। এ কারণেই সংকটময় মুহূর্তে রাশিয়া তার সেনাবাহিনীকে পুনঃস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে। রাশিয়ার এই পরাজয় নতুন আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্র খুলে দিল। সমন্বয়ের ক্ষেত্রে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সামর্থ্য সীমিত। এতে তারা কতটা অর্থপূর্ণ প্রতিরক্ষা তৈরি করতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। এ বিপর্যয়ে রাশিয়া ওই অঞ্চলে তাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল রোমান বার্ডনিকভকে বরখাস্ত করেছে। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তার তিন সপ্তাহের দায়িত্বের পরিসমাপ্তি হলো। রাশিয়ার এমন প্রতিক্রিয়া খুব স্বাভাবিক হলেও এ সমস্যার মূল অনেক গভীরে। কারণ, রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন রাশিয়ার সামরিক অবকাঠামো সরাসরি পুতিনের অধীনে। তাই ২০২২ সালে এসেও রাশিয়ার সেনাবাহিনী তাদের সোভিয়েত আমলের কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। সেনাবাহিনীর মধ্যে যাতে অভ্যুত্থান না হয়, তার প্রস্তুতি হিসেবে এটি পরিকল্পিতভাবে রক্ষা করা হয়েছে। এই কৌশল যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যর্থতা ডেকে আনলেও ইউক্রেন যুদ্ধের বিপর্যয়ের ফলে রাশিয়াতে যে ঘটনাপ্রবাহ সৃষ্টি হচ্ছে, তার উত্তাপ থেকে সুরক্ষিত রাখছে পুতিনকে। এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন শক্তি সংকট মোকাবিলায় পুরোপুরি সক্রিয় হয়েছে।

এদিকে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়ে ইইউ রাশিয়ান জ্বালানির ওপর তার নির্ভরতা শেষ করে দেওয়ার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ক্রেমলিন গ্যাস রপ্তানির পরিমাণ নাটকীয়ভাবে হ্রাস করার মাধ্যমে বিশ্ববাজারকে ধাক্কা দিয়ে তার চুক্তি ভঙ্গ করেছে। জ্বালানি বন্ধ করে দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করার ক্ষমতাকে রাশিয়ার একটি শক্তি বলে মনে হতে পারে; কিন্তু এটি শেষ পর্যন্ত একটি হারানো কৌশল। জনপ্রিয় বিশ্বাসের বিপরীতে দাঁড়ানো প্রকৃত বাস্তবতা হলো, রাশিয়া সহজে ইউরোপীয় বাজারের বিকল্প টেকসই বাজার খুঁজে পাবে না। এর কারণ হলো, দেশটির বেশির ভাগ গ্যাস-রপ্তানি অবকাঠামো ইউরোপে রপ্তানির উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছে। সেই পাইপলাইনগুলো ঘুরিয়ে চীনের মতো দেশে গ্যাসের প্রবাহ চালু করতে প্রথমত কয়েক বছর সময় লাগবে, দ্বিতীয়ত, এতে রাশিয়ার কয়েক শ কোটি ডলার খরচ হবে। এটি সত্য, রাশিয়া সাম্প্রতিক গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি থেকে উপকৃত হয়েছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ব্যর্থ হয়েছে। আসলে রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি কমানোর বিষয়ে ইউরোপের নেওয়া সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ প্রভাব দেখতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

এখন পর্যন্ত ইউরোপ শুধু রাশিয়ান কয়লা আমদানি নিষিদ্ধ করেছে এবং রাশিয়ান তেলের ক্রয় কমিয়েছে। তবু তার প্রভাব লক্ষণীয় হয়ে উঠছে। রাশিয়া সাম্প্রতিক গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি থেকে উপকৃত হয়েছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ব্যর্থ হয়েছে। এখন পর্যন্ত ইউরোপ শুধু রাশিয়ান কয়লা আমদানি নিষিদ্ধ করেছে এবং রাশিয়ান তেলের ক্রয় কমিয়েছে। ওদিকে রাশিয়ার কয়লা রপ্তানির সাম্প্রতিক পরিমাণ তার ইউক্রেনে আক্রমণ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত সময়ে রপ্তানি হওয়া পরিমাণের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছে। এটি ক্রেমলিনের অন্যান্য ক্রেতা খুঁজে পেতে ব্যর্থতার প্রতিফলন ঘটায়। একইভাবে, যেহেতু ইইউ ঘোষণা করেছে, তারা ২০২২ সালের শেষ নাগাদ রাশিয়ান তেলের আমদানি ৯০ শতাংশ কমিয়ে দেবে, সেহেতু তেলের দাম অনেক কমে গেছে। ক্রেমলিন যদি ইউরোপে তার গ্যাস সরবরাহ আরো কম করে, তবে তার রাজস্ব আরো কমে যাবে। যেমন জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক বলেছেন, ইউরোপ অতীতে হয়তো রাশিয়ান গ্যাসের জন্য আরো অনেক কম মূল্য পরিশোধ করতে পারত, কিন্তু তারা তাদের নিরাপত্তার শর্তে অর্থ প্রদান করার কারণে মস্কোকে বেশি দাম দিতে হচ্ছিল। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করেছিল কারণ তারা নিশ্চিত ছিল, ইইউ রাশিয়ার ওপর অতিরিক্ত জ্বালানিনির্ভর হওয়ায় ইইউ দেশগুলো রাশিয়ার ওপর অবরোধ আরোপে বিভক্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ভুল হিসাব করেছেন। রাশিয়ান জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করে ইউরোপ সেই পুরোনো বিশ্বাস থেকে নিজেকে মুক্ত করছে, যেখানে মনে করা হতো অর্থনৈতিক পারস্পরিক নির্ভরতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক উত্তেজনা হ্রাস করে।

আজ থেকে ৪০ বছর আগে এই উপলব্ধি হয়তো সঠিক ছিল, কিন্তু এটি অবশ্যই এখন কার্যকর নয়। কারণ পারস্পরিক অর্থনৈতিকনির্ভরতা এখন অস্ত্র হয়ে উঠেছে। আবার অভ্যন্তরমুখী হয়ে নিজেদের গুটিয়ে রাখাও কাজের কাজ নয়। আমাদের অবশ্যই একটি উন্মুক্ত অর্থনীতি দরকার; কিন্তু আমরা স্থিতিস্থাপকতা এবং বৈচিত্র্য ব্যতীত পরস্পরনির্ভরতাকে গ্রাহ্য করতে পারি না। আমরা যাদের সঙ্গে বাণিজ্য করি এবং যোগাযোগ রাখি, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। অন্যথায়, পুতিন ২০ বছর ধরে যে ফাঁদ পেতে রেখেছেন, আমরা সেই একই ধরনের ফাঁদে পা দেব। নিষেধাজ্ঞাগুলোও স্পষ্টতই রাশিয়ার ওপর একটি বাধ্যতামূলক প্রভাব ফেলেছে। তবে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ফলে ইউরোপের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনের এই জয়যাত্রা কতটা টেকসই হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

এক সপ্তাহ আগেও ইউক্রেনের ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য এমন ছিল, যেদিকেই পা বাড়ানো হোক, পরিস্থিতি প্রতিকূল। পশ্চিমাদের জন্য বিষয়টা ছিল লেগে থাকার বিকল্প কিছু নেই, অনেকটা এমন। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অন্য বিশ্বনেতাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন পশ্চিমা নেতারা। ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন জানানো থেকে পশ্চিমাদের সরে আসার সুযোগ নেই বললেই চলে। কারণ উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা একেবারেই হুমকির মুখে পড়েছে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ইউক্রেনীয়দের অনেক বেশি রক্ত ঝরেছে। পশ্চিমা কোষাগারের ব্যয়ের ক্ষেত্র অনেক বেশি বিস্তৃত হয়েছে। শুধু ইউক্রেনকে প্রতি মাসে ৫০০ কোটি ডলারের আর্থিক সহায়তা দিতে হচ্ছে। যুদ্ধ শুরুর পর শুধু যুক্তরাষ্ট্রকে এজন্য খরচ করতে হয়েছে ১ হাজার ৫৫০ কোটি ডলার। যদি পশ্চিমারা রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে ফেলার পরিকল্পনা অব্যাহত রাখে, তাহলে মরিয়া ভøাদিমির পুতিন নিশ্চিতভাবে রাশিয়া থেকে গ্যাস রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেবেন। শুধু নর্ড স্ট্রিম ওয়ান দিয়ে আসা গ্যাসই নয়, সব পাইপলাইন বন্ধ করে দেবেনÑ এমন হুশিয়ারিও দিয়েছেন তিনি।

কিন্তু ইউরোপকে উদ্ধারে এগিয়ে আসা ও তেল উৎপাদন বাড়াতে সৌদি আরব থেকে শুরু করে ইরানসহ তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। ফলে লাখো ইউরোপীয় ভোক্তা এই শীতে জমে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছেন কিংবা দেউলিয়া হতে যাচ্ছেন। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির খড়্গ থেকে ইউরোপীয় নির্বাচকদের বাঁচানোর খরচ এখন ৫০ হাজার কোটি ইউরোতে গিয়ে ঠেকেছে। এই ব্যয় এখনো বাজেট ধসিয়ে দেওয়ার হুমকি হিসেবে বহাল রয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে সুদের হার বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো চাপের মধ্যে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৮ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে, যা ইউরোপে ২৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। যাই হোক, যুদ্ধে ইউক্রেনের সাফল্যের এই গল্প এখনই থামছে না। জাতিসংঘে ভাবমূর্তির বিষয়টি বিবেচনায় নিলে দোনেৎস্কে রাশিয়ার পরাজয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিন পিং। তবে এখনো পশ্চিমা নেতারা তাদের ঝাড়বাতি অফিস থেকে উদ্বিগ্নভাবে তাকিয়ে থাকবেন যে ইউরোপ চাপে কাবু হয়ে পড়বে, নাকি দৃঢ় থাকবে। কারণ, চাপ এখনো বন্ধ হয়নি। নিকোলাই মাইত্রোখিনের ভাষায়, রাশিয়ার পক্ষ থেকে যেটাই বলা হোক না কেন, খারকিভের নিয়ন্ত্রণ হারানো রুশ সেনাদের জন্য বড় একটি ধাক্কা।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
পশ্চিমা রণকৌশল,বিশ্ব অর্থনীতি সংকট
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close