ইসরাত জাহান মুক্তা

  ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আমাদের সমাজ ও নারী

দেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, গুণে গরিমায় আমাদের নারী আর্দশ দুনিয়ায় / রূপে লাবন্য মাধুরী শ্রীতে হুরী পরী লাজ পায় / কোন কালে একা হয়নি ক'জয়ী পুরুষের তরবারি / প্রেরণা দিয়েছে শক্তি দিয়েছে বিজয়ী লক্ষী নারী / রাজা করিতেছে রাজ্য শাসন, রাজারে শাসিছে রাণী / রাণীর দরদে ধুইয়া গেছে রাজ্যের যত গ্লানি ...।

এভাবে বললে কে না পিছন ফিরে তাকায়? এভাবে বললে কে মুচকি হাসে না? কেউ যদি বলে; পৃথিবীতে সব থেকে মূল্যবান হচ্ছে সময়। আর টাকা হলো অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ, সংসারে তুমি সময় দিচ্ছ, আমি টাকা দিচ্ছি, তাহলে সংসারে তোমার গুরুত্ব নিশ্চয়ই বেশি। তাহলে আর কেউ আর ঘর সংসার ছাড়ার কথা ভাবত না।

অথচ আমরা বলি চার বিয়ে করা জায়েজ, ওই মাইয়া মাথায় কাপড় টান, জাহান্নামে যাবি তো। আমারা একটি লম্বা লিস্ট দিয়ে দিই মেয়েদের করণীয় কী কী। এরপর বলি পৃথিবীর রূপ লাবন্য দেখা পুরুষের কাজ। তুমি ঘরে থাকবে। তোমার কাজ পর্দা করা, বাচ্চা দেয়া, দেখাশোনা করা।

কিছুদিন পর আমরাই বলি, তুমি কি জানো পৃথিবী কেমনে চলে, খবর তো রাখ না কোন জিনিসের দাম কত। টাকা কি গাছে ধরে, বাবার বাড়ি থেকে কী এনেছো- ইত্যাদি ইত্যাদি; আরও কত কী।

শুধু টাকার অভাবে না, সম্মান আর গ্রহণযোগ্যতার অভাবে, ভারতীয় উপমহাদেশের মেয়েরা প্রথম ঘর থেকে কাজের সন্ধানে বের হয়। মুসলিম মেয়েদের পর্দা ফরজ, নামাজও ফরজ, ধর্মীয় জ্ঞান তালাশও ফরজ।

বিভিন্ন স্থানে মহিলাদেরও নামাজের জায়গা দরকার- এ নিয়ে কথা কোন পুরুষকে বলতে দেখিনি। মেয়েদের ইসলমি জ্ঞান তালাশের পথ কেউ দেখিয়ে দেওেয়ার কথা বলে না। সবাই শুধু বলে আরব বিশ্বের মেয়েরা পর্দা করে। ওরা কী দেখে না যে, আরব বিশ্বের মেয়েরা মসজিদে যায়। পরিবারের সবাই একসাথে মসজিদে যায়। নিজেদের গাড়িতে করে যায়। যাওয়ার সময় ওরা পর্দা করে।

আর আমাদের মেয়েরা লোকাল বাসে ধাক্কা খেতে খেতে যায় । তখন কী কেউ কিছু বলে না। তবে মাঝে মাঝে বলেন, যখন দেখেন কোন মেয়ে লোকাল বাসে ধাক্কা খাওয়া বাদ দিয়ে, নিজে স্কুটি নিয়ে স্বাধীনভাবে চলে যাচ্ছে তখন বলে, কেয়ামত কাছে চলে আসছে। আরব দেশে তো মেয়েদের আলাদা শপিং মল থাকে। ওদের মেয়েরা ব্যবসা করে। ওদের মেয়েরা জ্ঞান তালাশেও বের হয়। আমরা কী পর্দা প্রথাকে অনুসরণ করব আর সকল ভালো বিষয় অনুসরণ করব না? আজকাল অনেকেই তুরস্কের কথা বলে, কিন্তুু তুরস্কের প্রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সের মত লাইব্রেরি বাংলাদেশে তৈরী করার কথা কেউ ভাবে না। আমরা একটি নতুন রেস্টুরেন্টের দেওয়ার কথা চিন্তা করি।

সেন্ট্রাল প্লাজা আর নিউ মার্কেট। চট্টগ্রামের এ দু জায়গায় মেয়েদের নামাজের জায়গা ছিল, এখন সেখানেও ফুড কর্ণার। কিস্তুু এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ ধর্মভিরু এরা সওয়াবের আশায় মাজারে গরু, ছাগল মেজবানি করতে দু বার ভাবে না।

ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমরা যতটা সচেতন পর্দা নিয়ে, তার একভাগও যদি ইসলামিক জ্ঞান তালাশে হত তাহলে আজ আর ভঙ্গুর সমাজ ব্যবস্থা দেখতে হতো না।

আমাদের মূল সমস্যা আমারা পড়তে ভয় পাই বা আমরা পড়ি না। আল্লাহ্ কোরআনের প্রথম শব্দে বলেছেন পড়। একজনের অন্তত নিজ ভাষায় কোরআন পড়া উচিত, সূরার শানে নুযুল জানা উচিত, বিশ্লেষণ জানা উচিত। ন্যুনতম হাদিস সম্পর্কে দু চারটা বই শেষ করা উচিত। সিরাত পড়া উচিত। কমপক্ষে চার খলিফা আর সাহাবীদের জীবনী পড়া উচিত। বীরত্বে গাথা মুসলিম বীরদের তো আমরা ভুলে গেলাম। আমি মুসলিম- এ কথা বলার পর পর এ গুলো পড়া দায়িত্ব।

নবীজি হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর দাওয়াতের কাজে প্রথম অর্থ দিয়ে সহায়তা করেন খাদিজা (রঃ)। শুধু কি তাই, ইসলামের প্রথম শহীদও একজন নারী (সুমাইয়া)। ওহুদ যুদ্ধে নারী যোদ্ধা নুসাইবা (অঃ) অবদানের জন্য নবীজি তাকে উপাধি দেন ‘খাতুনে ওহুদ’। নবীর জীবন রক্ষায় তিনি চারাপাশে প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করেন। মেরাজের ঘটনা আমরা প্রথম জানতে পারি কোন এক নারীর মাধ্যমে। এ তালিকা দীর্ঘ করা যায়। তাতে কী আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে?

কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বললে :

‘সে গৌরব গোর হয়েছে আধাঁরে বোরকায়

আধাঁর হেরেমে বন্দি হলে সাহসা আলোর মেয়ে

সেই দিন হতে ইসলাম গেল গ্লানিতে কালিতে ছেয়ে

লক্ষ খালিদ আসবে যদি এ নারী মুক্তি পায়’

-নারী

নারী বলে কি চেপে রাখতে হবে? নারী অধিকার আর স্বাধীনতা কথা বললেই কি ফেমিনিস্ট বলে কটুকথা শুনতে হবে? পৃথিবীতে সবার আগে নারী অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন নবীজি হযরত মুহাম্মদ (সঃ)।

একটা রসাত্মক গল্প শোনা যায়, হেলেন নাকি ট্রয় নগরী ধ্বংসের জন্য দায়ী। যখন পাল্টাভাবে বলা হয়, ট্রয়ের রাজপুত্র হেলেনকে অপহরণ করেছে। তখন উত্তর আসে সাবাই সুন্দরের পুজারি। তাহলে দোষ হেলেনের কী ভাবে?

যেখানে গ্রিকরা মেয়েদেরকে অভিহিত করে- হিংসুক, সুন্দরী প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, জ্ঞানহীন, অহংকারী ও ভ্রষ্টচরিত্র হিসেবে। সেখানে ইসলাম ধর্ম নারীর চিত্রাঙ্কন করেছে শিক্ষক, যোদ্ধা, নায়িকা, সফল ব্যবসায়ী হিসেবে।

তাহলে আমাদের নারীদের কাছে ইসলাম আতঙ্ক কেন? উপমহাদেশে মুসলিম ছেলেদের স্পট চিত্রায়ন দেখা যায় লালসালু উপন্যাসে মুজিব চরিত্রের মধ্যে দিয়ে। আহমদ ছফার অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী উপন্যাস পড়ে মনে মনে ভেবেছিলাম ছেলেটা এত খারাপ কেন। বাস্তব জীবনে দেখলাম এ রকম প্লে বয়ের সংখ্যা বেশি। কাজী ইমদাদুল হক মিলনের আবদুল্লাহ উপন্যাসের আবদুল্লাহর মত ছেলের সংখ্যা হাতে গোনা।

তবে আশার কথা হচ্ছে বেগম রোকেয়ার বড় ভাই আর স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের মত পুরুষ ছিল বলেই এখানের নারীরা এখনও হারিয়ে যায়নি।

আমাদের পুরুষরা ভুলে যায় ঘরের মেয়েটাকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তার। সে মানুষ, সে স্বধীনতা চাইবে। আমি না নিয়ে গেলে লুকিয়ে চুরি করে সে বের হবে। তখনই কিন্তুু আপনি আঙুল তোলেন ধর্মের দিকে। অথচ দায়িত্বটা আপনার ছিল। বোনদের নিয়ে শেষ কবে ঘুরতে গেছেন?

নবীজি কিন্তুু আয়েশা (রাঃ) নিয়ে ঘুরতে যেতেন। মালহাম রক্ষার দায়িত্ব বাবা, ভাই, স্বামীর। আপনি নিচ্ছেন না দেখে আন্য ছেলের সাথে ঘুরতে যায়। তখন আপনি সমাজ ব্যবস্থার দিকে অঙুল তোলেন। বলেন পর্দা প্রথা নেই বলে এত বিশৃঙ্খলা। তখন আপনি বলেন এদের ঘরে রেখে দাও। কিন্তুু এটা তো আপনার কথা, এখানে ইসলামকে কেন লোগো করেন?

লেখক : শিক্ষার্থী

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নারী,সমাজ,মুক্তমত
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close