আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা

  ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২

জলবায়ু বিপর্যয় রোধ করাই সময়ের দাবি 

ছবি : সংগৃহীত

জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে প্রকৃতি চরম অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। এই বিপর্যয়ের ফলে বাংলাদেশের ১ কোটি ৯০ লাখেরও বেশি শিশু সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব শিশুর এক-চতুর্থাংশের বয়স পাঁচ বছরের কম (এই তথ্য ওঠে এসেছে জাতিসংঘের গবেষণা প্রতিবেদনে)। যার কারণে জলবায়ু বিপর্যয় ও তার বিরূপ প্রভাবের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত। ধনতান্ত্রিক শিল্পোন্নত দুনিয়ার লাগামহীন কার্বন নিঃসরণ এবং মাত্রাতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এই অবস্থার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। ওই শিল্পোন্নত দেশগুলোর রাজনৈতিক সদ্বিচ্ছা না থাকার কারণে অনেক বড় বড় জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশ ও জলবায়ু সম্মেলন হলেও জলবায়ু বিপর্যয় ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের লাগাম কিছুতেই টেনে ধরা যাচ্ছে না।

মাত্রাতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের কারণে কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের হার না কমে বরং ক্রমাগত বাড়ছে এবং এসব গ্যাস বায়ুমণ্ডলে আটকা পড়ার ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতার মাত্রাকে ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এজন্যই জলবায়ু বিপর্যয়কে ‘মানবজাতির জন্য লাল সংকেত’ বলে অভিহিত করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব। বর্তমান সময়ে জীবাশ্ম জ্বালানির অতিমাত্রায় ব্যবহার ও জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে শুধুমাত্র বাংলাদেশেই নয়, বরং সারা পৃথিবীতে সাইক্লোন, টর্নেডো, ভূমিকম্প, বজ্রপাত, নদীভাঙন, নদী শুকিয়ে যাওয়া, লবণাক্ততা, খরা, দাবদাহ ও দাবানল ইত্যাদি প্রাণ-প্রকৃতিকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেওয়া তারই প্রমাণ। স্কুল জীবনে আমরা পড়েছিলাম রান্নার কাজে (সৌর চুলা) সোলার কুকার ব্যবহার বিষয়ে, বাস্তবে যদি তার প্রয়োগ না করা যায়, তাহলে এই পড়ালেখার দরকার আছে কি? যতটা সম্ভব সর্বক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার, রান্নার কাজে সোলার কুকার, খাদ্য উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণনে লোকালাইজেশন (স্থানীয়করণ), যাতায়াত ব্যবস্থায় সাইকেল ও রিকশার ব্যবহার জ্বালানি সংকট ও জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবিলায় অনেকাংশে গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। বর্তমান বাস্তবতায় জ্বালানি সংকট, জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবিলা, যানজট নিরসন এবং বায়ু ও শব্দদূষণ হ্রাসে গাড়িমুক্ত শহর অত্যন্ত জরুরি। তাই জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় ও জলবায়ু বিপর্যয় রোধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

যেহেতু জলবায়ু বিপর্যয়ের বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। এজন্যই পরিবেশে সুরক্ষার পাশাপাশি প্রাণ-প্রকৃতির রক্ষার জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তাই অযান্ত্রিক যানবাহনের ব্যবহার বৃদ্ধি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো দরকার। জীবাশ্ম জ্বালানিকে পালিত পুত্রের মতোই বলা চলে। পালিত পুত্রের ওপর নির্ভরতা না করাই উত্তম। তা না হলে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের ‘সৌদামিনী মালো’ গল্পের সৌদামিনীর মতো সর্বস্বান্ত অবস্থা হবে।

একদিকে ২০১৮ সালে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের হার ২ শতাংশ বেড়ে ৩ হাজার ৭০০ কোটি টনের রেকর্ড ছুঁয়েছিল। করোনা মহামারির কারণে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কিছুটা কম হয়ে থাকলেও বর্তমানে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধির প্রভাবে উষ্ণতা বাড়ার কারণে মেরু অঞ্চল ও হিমালয়ের বরফ অতিমাত্রায় গলে যাওয়ার ফলে অনেক দেশে এখন বন্যা, আবার অনেক দেশে খরা ও দাবানলে বনভূমি পুড়ে সেখানেও প্রাণ-প্রকৃতির জন্য বিপর্যয়কর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সবকিছু মিলে উষ্ণায়নের কারণে বেড়েই চলেছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা। ফলে প্রতিনিয়তই বাড়ছে মেরু অঞ্চলের বরফ গলার হার, উত্তপ্ত হচ্ছে সমুদ্র, বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার সঙ্গে বাড়ছে খরা-দাবদাহ-বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক ঋতুচক্র। এসবের কারণে প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে আবাদী শস্যÑ ধান, গম, ভুট্টাসহ খেতের অন্যান্য ফসল; ফলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ও আরো হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতার বৃদ্ধির কারণে অনেক প্রজাতির পতঙ্গ মারা যাচ্ছে; ফলে পরাগায়ন না হওয়া কারণে ফুল ও ফলের উৎপাদন কমে গিয়ে কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে। জলবায়ুর বিপর্যয়ের ফলে এরই মধ্যে বহু প্রজাতি উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলীন হয়ে গেছে। এই বিলীন হওয়ার প্রক্রিয়া এখনো চলমান।

সমুদ্র উপকূল অঞ্চলগুলোতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে মিঠা পানির মাছ মারা যাওয়ার ফলে মাছের উৎপাদন বছরের প্রায় ৬০ ভাগ মাছের উৎপাদন কমে গেছে। এরই মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানি ও মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি, জীবন-জীবিকার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। লবণাক্ততা কারণে উপকূলীয় এলাকার জনগোষ্ঠীরও প্রয়োজনীয় সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। মানুষকে সুপেয় পানির জন্য ক্ষেত্রবিশেষে ১০-১২ কিলোমিটার দূরে গিয়ে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। বিশেষ করে রাজশাহী ও বরেন্দ্র অঞ্চল ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস পাওয়ায় অনেক এলাকায় সুপেয় পানির অভাব দেখা দিয়েছে। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে দেশে লবণাক্ত ভূমির পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর, আর এখন লবণাক্ত ভূমির পরিমাণ প্রায় ৩৫ লাখ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। বিগত কয়েক বছরের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ক্ষত নিয়ে এখনো মানবেতর জীবনযাপন করছে বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক উপকূলীয় মানুষ।

জীবাশ্ম জ্বালানির অতিমাত্রায় ব্যবহারের কারণে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মিথেন গ্যাস নিঃসরণের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন হচ্ছে, এই উষ্ণায়নের ফলে হিমালয় ও মেরু অঞ্চলের বরফে ফাটল ধরে সমুদ্রে লবণাক্ত পানি বাড়ার গতিকে আরো ত্বরান্বিত করছে, তা পরিবেশবিজ্ঞানীদের গবেষণায় সত্য প্রমাণিত। যা এখন সবার কাছে জ্ঞাত বটে। এই উষ্ণতা রোধ করতে না পারলে ২০৫০ সালের মধ্যে ৩-৮ ফুট পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে, তখন লবণাক্ততার পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুল এলাকায়। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের স্থলভাগের প্রায় ২০ ভাগ পানির নিচে তলিয়ে যাবে। জলবায়ু বিপর্যয় ফলে বাংলাদেশে ১৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এতে ১ দশমিক ৯৪ কোটি শিশুর প্রাণ হুমকির মধ্যে পড়বে। ২১০০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের বেশির ভাগ স্থলভূমি পানির নিচে তলিয়ে যাওয়াসহ রাজশাহী ও বরেন্দ্র অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার হুমকিতে রয়েছে। যার ফলে মালদ্বীপের মতো বাংলাদেশের অনেক মানুষের বাস্তুচ্যুতি ঘটবে।

রাষ্ট্রের একটি মৌলিক দায়িত্ব আছে, এমন কিছু না করা, যাতে করে অন্য রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি হয়। আন্তর্জাতিক কাস্টমারি আইনের বলে পরিবেশ রক্ষায় রাষ্ট্রের ওপর কিছু দায়দায়িত্ব অর্পিত ছিল। Trail Smelter Arbitration (ট্রেইল স্মেলটার সালিস, ১৯৩৮) মামলায় সিদ্ধান্ত : কোনো দেশ নিজের ভূখণ্ড এমনভাবে ব্যবহার করতে পারে না, যাতে করে নিজ ভূখণ্ড হতে নির্গত ধোঁয়া বা অন্য কোনো কারণে অন্য ভূখণ্ড বা অন্য ভূখণ্ডের অধিবাসী কিংবা অন্য কোনো সম্পত্তির কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়। Confu Channel Case, 1949 মামলায় আদালত ধার্য করেন, যে প্রত্যেক রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে জ্ঞানত নিজের ভূখণ্ড এমনভাবে ব্যবহার করতে না দেওয়া যাতে অন্য রাষ্ট্রের অধিকার লঙ্ঘিত হয়। নৈতিকভাবেও কোনো রাষ্ট্রই এসব দায় এড়াতে পারে না।

বর্তমানে জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রভাবে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের মানুষই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। জলবায়ুর বিপর্যয়ের ফলে বাংলাদেশের মানুষের অস্তিত্ব চরম সংকটে। এই বিপর্যয়ের রোধ করতে না পারলে মানুষের খাদ্যাভাব দেখা দিবে, মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়বে। উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্য, খাদ্যাভাব, সুপেয় পানির অভাব দেখা দিবে ফলে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকিও বেড়ে যাবে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারে প্রবুদ্ধকারী যান্ত্রিক যানবাহন ও অটোমোবাইল প্রতিষ্ঠান ও কারখানার মালিকদের যেন কারো কোনো দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি নেই। অর্বাচীন কর্তৃপক্ষ ও মানুষের অমানবিক কর্মকাণ্ড প্রতিনিয়ত পৃথিবীর প্রাণ-প্রকৃতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নে বাংলাদেশের দায় নগণ্য হলেও ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে ও কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রণোদনা দেওয়ার কারণে দায় একবারেই এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ আছে কি? যেখানে প্যারিস চুক্তিতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হতে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ৯০ মিলিয়ন টন বা মোট নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইডের ২২ শতাংশ কমানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে কার্বন নিঃসরণের জন্য প্রধানত দায়ী যান্ত্রিক যানবাহন, এর বেশির ভাগই ব্যক্তিগত গাড়ি। অযান্ত্রিক যানবাহনের ব্যবহার বৃদ্ধি, উন্নত হাঁটা পথ, সাইকেল লেন তৈরি, ব্যবহার নিশ্চিত এবং গণপরিবহন নির্ভর যাতায়াত ব্যবস্থা করা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করে ২২ ভাগ কার্বন নিঃসরণ কমাতে পারে। কারণ বিশ্বের অন্যতম পরিবেশবান্ধব শক্তির উৎস হিসেবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির স্বীকৃতি রয়েছে। বর্তমানে বাস্তবতায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দরকার রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সদ্বিচ্ছা।এজন্য জলবায়ুর বিপর্যয় অর্থাৎ অস্বাভাবিক পরিবর্তনের করালগ্রাস থেকে রক্ষা পেতে হলে এখনই জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। তাই পরিবেশ দূষণরোধে ব্যক্তিগতভাবে যেমন সচেতন হতে হবে, তেমনি সমষ্টিগতভাবে তা প্রতিরোধে রুখে দাঁড়াতে হবে। যত বাঁধাই আসুক সার্বিকভাবে জলবায়ুর বিপর্যয় মোকাবিলায় আমাদের থেমে থাকলে চলবে না, পুরো জাতিকে ঐক্যবন্ধ করে ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। আমরা যদি সচেতন না হই বা বিশ্ববাসীকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি বা এর বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে জানান দিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করি, তাহলে ২০৫০ সালে মধ্যে বাংলাদেশের অনেকাংশ পানির নিচে নিম্মজ্জিত থাকবে। একই চেইন রিয়েকশনে পুরো পৃথিবী থেকেই প্রাণের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে পারে। এজন্যই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষ্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে আমাদের দাবিগুলো বিশ্ববাসীকে জানানোর এখনই সময়।

লেখক : আইনজীবী [email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জলবায়ু,জলবায়ু বিপর্যয় রোধ,সময়ের দাবি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close