মো. উজ্জল হোসেন

  ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২

মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে আমাদের করণীয়  

উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. উজ্জল হোসেন। ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

শিক্ষা সকলের সমান অধিকার। দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্য পূরণে শিক্ষাই হচ্ছে প্রধান অবলম্বন। মেধা ও মননে আধুনিক এবং চিন্তা-চেতনায় অগ্রসর একটি সুশিক্ষিত জাতিই একটি দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে। তাই শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত দেওয়া হয়েছে। আর তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে সার্বজনীন শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রণিত ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে- সরকার একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামুলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করিবে। আর প্রাথমিক শিক্ষাই হচ্ছে শিক্ষার প্রথম সোপান। বিভিন্ন দেশে প্রাথমিক শিক্ষার পদ্ধতি, বয়সসীমা, সময়সীমা, প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা বিভিন্ন ধরনের।

জাতিসংঘের শিশুদের তহবিল (ইউনিসেফ) বিশ্বাস করে, শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের অনেক ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। যেমন: দারিদ্র্য হ্রাস করে, শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস করে, লিঙ্গ সমতা উৎসাহিত করে এবং পরিবেশগত বোঝাপড়া বাড়ে।

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন ও বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষা একই সুতোয় গাঁথা। তিনি দেশ স্বাধীন হবার পরপরই সমগ্র শিক্ষা নিয়ে ভাবনা শুরু করেছিলেন। যেহেতু প্রাথমিক শিক্ষাই ভিত্তি, তাই এই শিক্ষা নিয়ে ভাবনা শুরু করেন তিনি। গরীব দুঃখী মেহনতী মানুষের সন্তানদের কাছে শিক্ষাকে সহজভাবে পৌঁছে দিতেই প্রাথমিক শিক্ষাকে এক ঘোষণায় সরকারিকরণ করেন। ১৯৭২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রেসনোটে বলা হয়, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বাংলাভাষাই হবে শিক্ষার মাধ্যম। ফেব্রুয়ারির ১৯ তারিখ অন্য একটি প্রেসনোটের মাধ্যমে জানানো হয়, প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে বই পাবে এবং ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা পাবে বাজার মূল্যের চেয়ে ৪০ শতাংশ কম দামে। বঙ্গবন্ধুর সরকারের উদ্যোগে ৩৬ হাজার ১৬৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয় এবং বাড়ানো হয় শিক্ষকদের বেতন। এছাড়া নারীর উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নারীদের অবৈতনিক শিক্ষা চালু করার যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন আপাদমস্তক শিক্ষানুরাগী। তিনি একটি শোষণ-বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। তিনি জাতিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা ছিল তার রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম ভিত্তিভূমি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ৬টি প্রধান শিক্ষা কমিশনসহ মোট ৮টি শিক্ষা প্রতিবেদন পেশ করে। কিন্তু কোনোটিতেই অখণ্ড পাকিস্তানের জাতীয় মুক্তি ও আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন হয়নি। তাই তিনি সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও শিক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাবেন। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনা ও দর্শনকে ধারণ করে যে কোনো জাতি একটি আধুনিক, কর্মমুখী এবং বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। বাংলাদেশ উত্তরোত্তর যে উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৩ সালের ২০ মার্চ, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-এর প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় শিক্ষা সম্পর্কে তার চিন্তাধারা আরও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। সেদিনের অনুষ্ঠানে নতুন স্নাতক সনদধারী এবং শিক্ষকদের সামনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের দুইশ বছরের ও পাকিস্তানের ২৫ বছরে গড়ে ওঠা শিক্ষাব্যবস্থা শুধু কেরানি তৈরি করেছে, মানুষ তৈরি করেনি। এজন্য তিনি এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর জোর দেন, যার মাধ্যমে আদর্শ নাগরিক গড়ে তোলা যাবে এবং যার মাধ্যমে স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণে সহায়তা করবে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা এবং সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন বঙ্গবন্ধু। আর দক্ষ মানবসম্পদ বা সোনার বাংলা গড়তে আমাদের শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে আর এ শিক্ষার ভিতই হল প্রাথমিক শিক্ষা ।

শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা এবং দর্শন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একই সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চান। গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা, গবেষণা ও উদ্ভাবনের সুযোগ বৃদ্ধি ছাড়া কোনো দেশ উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। তাই বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন অনুরসরণ করে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আবশ্যক। জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণিত টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে ১৭টি অভিষ্টকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০১৫ সালে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে (এসডিজি) প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। ১৭টি অভিষ্ট লক্ষ্যমাত্রার সাথে সাথে ১৬৯ টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও ২৩২টি পরিমাপক রয়েছে। যার মধ্যে ৪ নং অভিষ্ট হল- মানসম্মত শিক্ষা (অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা, সবার জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা)। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নে স্বল্প মেয়াদী এবং দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন পূর্বক তা বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষায় ছেলে-মেয়েদের অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি এবং সমতা তৈরির মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। প্রাথমিক শিক্ষার সফলতার দিকগুলো হল- শতভাগ শিশুর প্রাথমিকে ভর্তি হওয়া, শ্রেণিকক্ষে লৈঙ্গিক সমতা প্রতিষ্ঠা এবং অতি উচ্চ হারে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করা। এ ধারাকে অব্যহত রাখতে বর্তমান সরকার নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, রূপকল্প ২০২১ এবং ২০৪১ বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ জনসম্পদ উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে বর্তমানে মানসম্মত শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

প্রাথমিক শিক্ষার অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার নতুন ভবন নির্মাণ করছে। ফলে শিক্ষার্থীরা একটি নিরাপদ পরিবেশে পাঠ গ্রহণ করতে সক্ষম হবে। এ প্রক্রিয়া আরো ত্বরান্বিত করার সুযোগ রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সামাজিক দায়বদ্ধতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সমাবেশের আয়োজন করা হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে শেখ হাসিনা সরকারের গৃহীত উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ সমূহের মধ্যে রয়েছে বছরের শুরুতে প্রতিটি স্কুলে ক্যাচমেন্ট এলাকাভিত্তিক শিশু জরিপপূর্বক ভর্তি নিশ্চিত করা, নিয়মিত মা সমাবেশ, উঠান বৈঠক, হোম ভিজিট কার্যক্রম, বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই বিতরণ, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম গ্রহণ ও উপবৃত্তি প্রদান কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক গুণগতমানোন্নয়ন ও উৎকর্ষ সাধন। যা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন কল্পে শিক্ষা বিভাগ সংশ্লিষ্ট সকলকে আরোও বেশি আন্তরিক হতে হবে। সর্বোপরি শিক্ষক অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মা সমাবেশ, উঠান বৈঠক, সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকল্পে এসএমসি কমিটির নিয়মিত সভা আয়োজন করা যেতে পারে। প্রত্যেক প্রাথমিক একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সাথে সাথে টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে রূপকল্প ২০২১, ২০১৪১ ও ডেল্টাপ্ল্যান বাস্তবায়নে হাতিয়ার হিসিবে প্রাথমিক শিক্ষার আধুনিকায় অত্যবশ্যকীয়।

প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন ও আধুনিকায়ন ব্যতীত বাংলাদেশ কখনও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে না। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের পাশাপাশি আরোও সময়োপযোগী কার্যক্রম গ্রহণের অবকাশ রয়েছে। শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য দূর করার মাধ্যমে সমাজে শিক্ষকদের মর্যাদার উন্নয়ন সাধন করা যেতে পারে। শিক্ষক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের জবাবদিহিতা আরোও বেশি নিশ্চিত করা যেতে পারে। এসএমসি এর জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরা এবং এসএমসির কার্যক্রম যথাযথভাবে তদারকি নিশ্চিত করা যেতে পারে। প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারে। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও যুগোপযোগী করে তোলাই বর্তমান সময়ে দাবী।

১৯৭০ সালে নির্বাচনী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে বিনিয়োগকে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ বলে অভিহিত করেন। শিক্ষা সম্বন্ধে নীতিনির্ধারণী এ বক্তব্যে তিনি বলেন, সু-সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাখাতে পুঁজি বিনিয়োগের চাইতে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়নে মূলমন্ত্র নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এ সরকার।

আজকের শিক্ষার্থীরা দেশের গৌরবময় সংগ্রামী ইতিহাস, জাতীয় সংস্কৃতি জেনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা ।

লেখক : উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা,বাস্তবায়নে আমাদের করণীয়
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close