মোহাম্মদ কবীর মোল্লা

  ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২

জ্বালানির প্রশ্নে টালমাটাল ইউরোপ

ইউরোপে জ্বালানি সংকট চলছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ অনিশ্চয়তার মুখে পড়ায় জ্বালানির দাম আকাশচুম্বী হয়েছে। প্রতি ব্যারেল প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ৫০০ ডলারে গিয়ে ঠেকেছে, যা স্বাভাবিক দামের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। চলমান এই অবস্থা চিন্তা বাড়াচ্ছে ইউরোপবাসীর। আসন্ন শীতকাল সামনে রেখে তীব্র জ্বালানি ঘাটতির আশঙ্কায় রয়েছে ইউরোপের দেশগুলো। সম্ভাব্য তীব্র জ্বালানি ঘাটতির শিকার হয়ে হিমশীতল ঠান্ডা কাল হওয়ার ভীতি শঙ্কা বাড়াচ্ছে গোটা ইউরোপে।

জ্বালানি সংকটের কারণে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম প্রভাবিত হতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। বিশেষ করে সার, যা উৎপাদন করার জন্য বিশাল পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রয়োজন পড়ে। উচ্চ মূল্যের কবলে পড়ে গ্যাসের সংকটের কারণে সার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতের ঘাটতির আশঙ্কায় গ্যাস মজুদ করছেন উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা (গ্যাস মজুদের কারণ হলো আসছে শীতের তীব্রতা থেকে রক্ষা পেতে বাসাবাড়ি, শিল্পকারখানাসহ সবক্ষেত্রে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যাবে স্বাভাবিকভাবেই)। এরমধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে উঠেছে ‘জলবায়ু পরিবর্তন’। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব পরিস্থিতিকে খারাপ করে তুলেছে, তুলছে। স্মরণকালের তীব্র দাবদাহ ও খরার প্রকোপে ইউরোপের নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। এর নেতিবাচক ফল পড়ছে জলবিদ্যুতের ওপর। বিদ্যুৎ প্লান্টগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে উল্লেখযোগ্যভাবে। মোটকথা, জ্বালানি সংকট প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠছে দিন দিন। এর ধাক্কা লাগছে অর্থনীতিতে। যুক্তরাজ্যে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের জ্বালানি সংকটের পর সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতির শিকার হয়েছে জার্মানি। একই অবস্থা প্রায় প্রতিটি ইউরোপীয় দেশের।

১৯৭৩-৭৪ সালে জ্বালানি সরবরাহ বিঘ্নিত হয়ে ইউরোজুড়ে শীতকালে যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল, তার সঙ্গে বর্তমান সংকটের বেশখানিকটা সাদৃশ্য রয়েছে। সেসময় তেল আমদানির ওপর আংশিক নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয় ইউরোপ। বিশ্ববাজারে তেলের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি এবং জ্বালানি ঘাটতির আশঙ্কার মুখোমুখি হয় ইউরোপবাসী। চলমান সংকটের প্রেক্ষাপটে একটা বিষয় মোটাদাগে উল্লেখ করতে হয়, সত্তরের দশকে জ্বালানি ঘাটতির পরিপ্রেক্ষিতে যেরূপ ‘চরম’ সংকটের পূর্বাভাস পাওয়া গিয়েছিল ঠিক ততটা সংকট অবস্থা দেখা যায়নি পরবর্তীতে। বরং বিপর্যয় বেশ কমই ছিল। অনুরূপভাবে আসছে শীতে লোডশেডিং, রেশনিং (বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে গৃহীত ব্যবস্থা) প্রভৃতি নিয়ে যতটা দুশ্চিন্তা করা হচ্ছে, পরিস্থিতি সে তুলনায় প্রকট নাও হতে পারে। এমনকি ‘সংকট অবস্থা’ কেটে গিয়ে ‘ভয়-ভীতি’ উবে গেলে অবাক হওয়ার মতো কিছুই থাকবে না। তবে খুব ভালোভাবে মাথায় রাখতে হবে, বিপর্যয় এড়ানো গেলেও বর্তমান দুর্দশা ইউরোপের ভঙ্গুর জ্বালানি নিরাপত্তার বাস্তবতাকে চিরতরে মুছে দিতে পারবে না। উপরন্তু আগামী দিনগুলোতে ‘নতুন কোনো ধাক্কা’ আসাটাও অস্বাভাবিক নয়। কাজেই সংকটের ‘ভবিতব্য ঝুঁকি’ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় ‘স্থিতিস্থাপকতা’ অর্জনের বিষয়ে ভাবতে হবে ইউরোপকে। আগামীর সংকট এড়াতে এসব বিষয়কে আমলে নেওয়াটাই উরোপের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

আমরা দেখেছি, জ্বালানি নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রশ্নে মহাদেশব্যাপী কয়লার সমৃদ্ধ চূড়ার ওপর স্থির শিকড় গেড়ে বসেছিল ইউরোপ। পরবর্তীকালে বিশ শতকে তেলের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব সামনে আনে এক জটিল হিসাব-নিকাশ। শুরু হয় তীব্র প্রতিযোগিতা। দেশীয় তেলের চাহিদা পূরণে অধিক সরবরাহের তাগিদে পেশিশক্তি ব্যবহার করে গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং নেদারল্যান্ডস। ইতালি এবং জার্মানি নামে যুদ্ধে। আংশিকভাবে হলেও বিদেশি তেলক্ষেত্রগুলো দখল করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে বিভিন্ন দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ‘আমদানি করা জ্বালানির ওপর ইউরোপের নির্ভরতা’ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় পরিণত হয়ে ওঠে। মার্শালপ্ল্যানের মাধ্যমে পশ্চিম ইউরোপের পুনর্গঠনে ইন্ধন জোগায় ‘মধ্যপ্রাচ্যের তেল’। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপ তার জ্বালানির ৫৯.৬ শতাংশের জন্য নির্ভরশীল ছিল তেলের ওপর। এই জ্বালানির প্রায় পুরোটাই আমদানি করা হতো পারস্য উপসাগর এবং উত্তর আফ্রিকার তেলক্ষেত্রগুলো থেকে।

১৯৭৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলে আকস্মিক আক্রমণ করে বসে সিরিয়া ও মিসরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে চাইলে সৌদি আরব এবং অন্যান্য আরব তেল-উৎপাদনকারী রাষ্ট্র আমেরিকায় তেল সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। রাষ্ট্রগুলো ১৯৭৩ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ধীরে ধীরে উৎপাদন কমিয়ে দেয়। উৎপাদন ২৫ শতাংশ হ্রাস করে এসব রাষ্ট্র। পর্তুগাল এবং নেদারল্যান্ডসকে এই কাতারে যুক্ত করার জন্য নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ায় রাষ্ট্রগুলো। অক্টোবরের শেষের দিকে যুদ্ধকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করায় ওপেক। যুদ্ধ তেলের দাম প্রায় দ্বিগুণ করে; এমনকি জানুয়ারির শুরুতে তা দ্বিগুণের বেশি হয়ে ওঠে। ওপেকের দাবি ছিল, এই দামবৃদ্ধির জন্য দায়ী যুদ্ধ, সংঘাত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্যাস স্টেশনগুলোতে লম্বা লাইন, মুদ্রাস্ফীতি ও সত্তরের দশকব্যাপী চলতে থাকা অর্থনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে যুক্ত ‘জ্বালানি (তেল) বিপর্যয়’ও আরব নিষেধাজ্ঞা। তবে এই ধাক্কা ইউরোপের জন্য আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। কেননা, ইউরোপ আমদানি করা তেলের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ১৯৭৩ সালে শীতকালে পশ্চিম ইউরোপে মোট ব্যবহৃত তেলের ৭২ শতাংশের জোগান মেটায় আরব তেল। যদিও ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি এবং যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো আরব নিষেধাজ্ঞার সরাসরি টার্গেটে ছিল না, তা সত্ত্বেও আরব উৎপাদন হ্রাসের কারণে সরবরাহ-ঘাটতির সম্মুখীন হয় এসব দেশ। এর ফলে দামের ঊর্ধ্বমুখিতায় দেশগুলোর রিজার্ভে টান পড়ে। মন্দার কবলে পড়ার উপক্রম হয় পুরো মহাদেশ।

নেদারল্যান্ডসের ওপর আরব নিষেধাজ্ঞার ধাক্কা ছিল অতি প্রকট। রটারডাম বন্দর (ইউরোপের বৃহত্তম বন্দরনগরী) হয়ে পেট্রল ও অন্যান্য পণ্য তৈরির জন্য তেল চলে যায় ডাচ শোধনাগারে। এই অঞ্চলে পশ্চিম ইউরোপের মোট পরিশোধন ক্ষমতার ১০ শতাংশ সম্পন্ন করা হয় এবং এই বন্দর এলাকার মাধ্যমে ৭৫ শতাংশ পণ্য রপ্তানি হয়। কাজেই নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে রটারডামে তেল ও পণ্য সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বাজার বন্ধ হয়ে যায়। পুরো ইউরোপজুড়ে তৈরি হয় ঘাটতি অবস্থা, সংকট।

যেহেতু উৎপাদন হ্রাস ও বর্ধিত মূল্যের ধাক্কা লাগে যুক্তরাষ্ট্রের গায়েও, সেক্ষেত্রে সহজেই আন্দাজ করা যায় অবস্থা কতটা ‘বাজে’ হয়ে ওঠে। উল্লেখযোগ্য পরিমাণে তেলের জোগান হারায় ইউরোপ। উচ্চ মূল্যের ধাক্কায় মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে ব্যাপকভাবে। ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে দেখা দেয় মহামন্দা। এই অবস্থা পর্যবেক্ষণের পর সিআইএ (যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা) এক রিপোর্টে বলেছিল, ‘পশ্চিম ইউরোপীয়দের আসলে করার তেমন কিছু ছিল না’।

এই মন্দাবস্থা উত্তরণে নানা ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে বিভিন্ন রাষ্ট্রকে। পারমাণবিক বহরের সম্প্রসারণকে ত্বরান্বিত করে ফ্রান্স। উত্তর সাগরে তেলক্ষেত্রের উন্নয়নে বিপুল পুঁজি খাটায় যুক্তরাজ্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এটি ছিল একটি ব্যয়বহুল প্রকল্পÑ আশির দশকের গোড়ার দিকে ব্রিটেনকে নিট তেল রপ্তানিকারকে পরিণত করে এ প্রকল্প। অতীতের এসব বাজে দৃষ্টান্ত বিপর্যয়ের আশঙ্কাকে বাড়িয়ে তুলছে। অর্থাৎ সবচেয়ে বড় ভয়, আশঙ্কা কাটছে না সহসাই। কোনো সন্দেহ নেই যে, জ্বালানির দাম অবিশ্বাস্যভাবে আকাশচুম্বী হয়েছে ইতোমধ্যে। এমতাবস্থায় লোডশেডিং কিংবা তীব্র গরম বা বিদ্যুতের ঘাটতি এড়াতে সঠিক, পরিমিত ব্যবহারের মাধ্যমে জ্বালানি সাশ্রয়ের বিকল্প নেই। তা না হলে দিন দিন পরিস্থিতি আরো খারাপ আকার ধারণ করবে। আমরা দেখেছি, শ্রীলঙ্কাকে এই গ্রীষ্মে করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়। পতনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় দেশটি। দেশটির বৈদেশিক মদ্রার রিজার্ভ ফুরিয়ে গেলে বন্ধ হয়ে পড়ে জ্বালানি আমদানি। সমস্যায় আছে প্রায় প্রতিটি দেশ। দৈনন্দিন জ্বালানি ঘাটতি নিয়ে বিক্ষোভে উত্তাল পাকিস্তান। অস্থিরতা বাড়ছে অন্যান্য দেশেও। বাস্তবিক অর্থে উন্নয়নশীল বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের ‘সমূহ শঙ্কা’ সমস্যাগুলোকে প্রকটতর করে তুলছে দেশে দেশে। বলা বাহুল্য হবে, এসবের অভিঘাতে বিশ্বের দরিদ্র মানুষের অবস্থা ক্রমশ কাহিল হয়ে পড়ছে।

ইউরোপ এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। গত শতাব্দীর মতো এখনো আমদানি করা জ্বালানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ইউরোপের দেশগুলো। এই মহাদেশের উন্নত, সমৃদ্ধ শিল্প-অর্থনীতি অতিমাত্রায় নির্ভরশীল বাইরের জ্বালানির ওপর। আমদানি করা জ্বালানির ওপর অতিনির্ভরশীলতার কারণে মহাদেশটিকে বাইরের ধাক্কা সামলে চলতে হয়। জ্বালানি নিরাপত্তার প্রশ্নে এই মহাদেশ ‘অরক্ষিত’ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আচ্ছাদিত। ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো জ্বালানি মজুদের দিকে ঝুঁকছে। জার্মানিসহ বেশ কিছু দেশের তোড়জোড় চোখে পড়ার মতো। বস্তুত রাশিয়ান জ্বালানির ওপর অতি নির্ভরশীলতা থেকে সরে আসতে বিকল্প পথের সন্ধানে আছে প্রতিটি দেশ। আজকের বিশ্বে এটাই চরম বাস্তবতা যে, যথেষ্ট সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধার আধার হওয়া সত্ত্বেও ইউরোপ এক গভীর আঁধারের সম্মুখীন হতে চলেছে।

লেখক : কানাডা (মন্ট্রিয়েল) প্রবাসী ও সাংস্কৃতিক কর্মী

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জ্বালানি,টালমাটাল ইউরোপ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close