মোহাম্মদ আবু নোমান
সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল চাই
শুধু বিপদই নয় মহাবিপদে পড়তে হচ্ছে দেশের সীমিত বা মধ্যম আয়ের মানুষকে। বাজারে গেলে কোনোক্রমেই মাথা ঠিক রাখা যায় না। বাজারে পর্যাপ্ত খাদ্য আছে, অথচ মানুষ কিনতে পারছে না, এ পরিস্থিতি অনেক সময় দুর্ভিক্ষাবস্থা সৃষ্টি করে। বিশ্বের অনেক দেশেই এমন ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রধানত দায়ী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এবং সরকারের যথাসময়ে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়া। দেশের সাধারণ মানুষকে রক্ষায়, দেশকে বাঁচাতে, সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের শায়েস্তায় এখনই ‘বিশেষ ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করে বিচার করতে হবে। প্রশাসনের ভূমিকা থাকবে মাঠের রেফারির মতো। শতভাগ নিয়ম-কানুনের প্রয়োগ নিশ্চিত করে, যারাই নিয়ম ভাঙবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। সিন্ডিকেট, মজুদদারদের অতি মুনাফা লোভের আগুনে দেশ পুড়ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য। সরকার তা কীভাবে মোকাবিলা করার কথা ভাবছে আমাদের জানা নেই। তবে দ্রুত সমাধানই হলো সময়ের দাবি।
তাবত বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশই একটি দেশ, যেখানে প্রশাসনের চেয়েও সিন্ডিকেটের হাত শক্তিশালী! দেশের চালের বাজারে সিন্ডিকেট, তেলের বাজারে, ডিম-মাছ-সবজির বাজারে, শ্রম বাজারে, পরিবহনে সিন্ডিকেট, মাদকের কেনাবেচায়, চামড়ার বাজারে, সিন্ডিকেটের মুঠোয় সারের নাটাই। যেদিকে তাকানো হবে, যতদূর চোখ যাবে, কোথায় নেই সিন্ডিকেট! এর থেকে মুক্তির কোনো উপায় আছে কী? নেই! থাকবে কীভাবে! ক্ষেত্র বিশেষ ওরা তো সরকারের চেয়েও ক্ষমতাবান ও শক্তিশালী। এজন্যই বাংলাদেশে অতি দ্রুত সিন্ডিকেট ব্যবস্থাপনা বিষয়ক একটি মন্ত্রণালয় দরকার...!
ভয়াবহ সিন্ডিকেটের কবলে বাজার এখন এক আতঙ্কের নাম। দেশে বাজেটের আগে দাম বাড়ে, পরে বাড়ে। করোনা এসেছে, দাম বাড়াও। যুদ্ধ লেগেছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়াও। বন্যা হয়েছে, দাম বাড়াও। জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে পারে এতেই জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। সামনে রোজা, দাম বাড়াও। রোজা এলে দাম বাড়ে। ঈদ এসেছে, দাম বাড়াও। কোনো দুর্যোগ বা উসিলা আসতে দেরি, দাম বাড়াতে দেরি নেই। অথচ সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দিকে ব্যবসায়ীদের সুরক্ষায় নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক দ্রব্য আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কহার প্রায় শূন্যের কোটায় নিয়ে থাকে। কিন্তু অতি মুনাফালোভীদের কারণে সরকারের শুভ পদক্ষেপগুলো ব্যর্থ হচ্ছে। দাম নিয়ন্ত্রণ করে সহনীয় পর্যায়ে আনার সরকারি কোনো ব্যবস্থাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। নামকাওয়াস্তে পরিদর্শক টিম নামিয়ে কিছু জরিমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে সরকারি দায়িত্ব। ব্যবসায়ীরা রীতিমতো বেপরোয়া। তারা যথেচ্ছ দাম বাড়িয়ে লুটে নিচ্ছে সাধারণ মানুষের কষ্টের অর্থ। সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের মৌলিক ও প্রধানতম উপকরণ হচ্ছে খাদ্যপণ্য। এই খাদ্যপণ্যের মূল্য যখন ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তখন জনরোষের সঙ্গে দুর্বিষহ পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়ে পারে না।
মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেই বাজারে সবজির দাম কমে না। আমরা সবসম দেখছি বাজারে একটি অদৃশ্য সিন্ডিকেট সবসময় সক্রিয় থাকে। এই সিন্ডিকেট দমনে কি সরকার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার শক্তি রাখে না? সরকারের নির্বাচনী ওয়াদা ছিল, অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভেঙে দ্রব্যমূল্য কমিয়ে মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে নিয়ে আসবে। অর্থ ও খাদ্যমন্ত্রীর ভাষায় দেশে কোনো কিছুর ঘাটতি নেই, সবকিছুর প্রচুর মজুদ আছে। কথা সত্য। তবে কেন বাজার অস্থিতিশীল! এর কারণ কি? শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, সত্যিকার পরিকল্পনা নিয়ে দেশ ও মানুষের মঙ্গলের জন্য আন্তরিক হলে এখনো দ্রব্যমূল্য সাধ্যের বাইরে যাওয়ার কথা নয়।
বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিই শুধু নয়, আগামীর বিশ্ব পরিস্থিতির আলোকেই বলতে হয়, সবাইকেই মিতব্যয়িতার অভ্যাস করতে হবে। আমরা একটি কঠিন সময়ের মধ্যে আছি। সামনে কঠিন সময়। মন্দা আসছে। সুতরাং সতর্কতার সঙ্গে পা বাড়াতে হবে। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবেই। তবে অতিলোভ পরিত্যাজ্য। মানবিক বোধ না থাকলে কিছুতেই কাউকে সঠিক পথে ফেরানো যায় না। অতিমুনাফার জন্য অনৈতিক ও বেআইনিভাবে মজুত করে মানুষের পকেট কাটা অপরাধ। গত ২১ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা অভিযোগ করে বলেছেন, ১৫ দিনে ডিম ও মুরগির বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করে প্রায় ৫২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সিন্ডিকেট। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট কতটা বেপরোয়া।
রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ লেগে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গমের দাম বেড়ে যায়। এটা ঠিক, রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশ প্রচুর গম আমদানি করে। দুই দেশের যুদ্ধের খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলোরও দাম বাড়িয়ে দিয়েছিলেন দেশের ব্যবসায়ীরা। ইউরোপের কোনো দেশ থেকে আমদানি করে বাংলাদেশে বাজারজাত করতে দূরত্ব ভেদে দেড় থেকে দুই মাস সময় লাগে। অর্থাৎ আজ যে পণ্যের মূল্য বাড়ল সেই বর্ধিত মূল্য প্রযোজ্য হওয়ার কথা দেড়/দুই মাস পর। কিন্তু দেখা যায় মুহূর্তেই দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা।
রমজানে বা অন্য সময় জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ে, আমরা বলি সিন্ডিকেট এটা করেছে। ধানের মৌসুমে ধানের দাম পড়ে গিয়ে কৃষক ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত হয়, আমরা সেখানেও সিন্ডিকেটের কথা বলি। উৎপাদনস্থলে পানির দামে বিক্রি হওয়া সবজি ৫ থেকে ১০ গুণ দামে আমরা শহরে কিনি, এখানেও মধ্যস্বত্বভোগী অর্থাৎ সিন্ডিকেট। পেঁয়াজের কেজি ঠেকে ৩০০ টাকায়, আমরা বলি সিন্ডিকেটের কথা। কোরবানির চামড়া পানির দামেও বিক্রি করা যায়নি, তখনো আমরা সিন্ডিকেট দেখেছি। প্রশ্ন হলো, এসব যাদের দেখার কথা তারা কী করেন?
বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে অসহায় সেটা এর আগে বাণিজ্যমন্ত্রীর কথায় টের পাওয়া গেছে। ভোজ্য তেল নিয়ে একবার অসহায় কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করাটা ভুল ছিল।’ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর চালের দামের উল্লম্ফন নিয়েও বাণিজ্যমন্ত্রীর কণ্ঠে অসহায়ত্বের বাণী, ‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় চালের মূল্য প্রতি কেজিতে সর্বোচ্চ ৫০ পয়সা বাড়তে পারে। কিন্তু কেজিতে এরই মধ্যে দাম বেড়েছে ৪ টাকা। কেজিতে এত টাকা দাম বাড়ার কোনো যুক্তি নেই।
খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ প্রায় সবসময়ই ঠিক থাকে। তবু কেন মূল্য স্থিতিশীল থাকে না তা কারোরই অজানা নয়। এর মূলে রয়েছে অসাধু মজুদদার ও সিন্ডিকেট। এটা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। সাধারণত পণ্যের সংকট থাকলে দাম বাড়ে। কিন্তু দেশে খাদ্যপণ্যের কোনো সংকট নেই। চালের উৎপাদন, বিপণন, মজুদ ও আমদানি-সবকিছুতেই গত বছর ও এ বছর রেকর্ড হয়েছে। অনাকাক্সিক্ষত মূল্য বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের বহু মানুষ আজ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছে। মন্ত্রীদের আশ্বাসের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ ঠিক রেখে স্বার্থান্বেষী, মজুদদারদের কৃত্রিম সংকট তৈরির ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।
আমরা মুক্তবাজার অর্থনীতির চর্চা করছি। এই ব্যবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার এবং ভোক্তাসহ সব পক্ষের স্বার্থ রক্ষার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের বাজার যেন মুক্তবাজার অর্থনীতির এক নিকৃষ্ট উদাহরণ। এখানে মুক্তভাবে দাম বাড়ানোই যেন ব্যবসায়ীদের কাজ। কোনো পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদনের আগেই ব্যবসায়ীরা বাড়তি দামে পণ্য বিক্রি শুরু করে দেয়। এ ধরনের অনিয়ম দূর করার জন্যও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সারা দেশে অসাধু ব্যবসায়ীদের এক অদৃশ্য অথচ শক্তিশালী চক্র গড়ে উঠেছে। এ চক্রের শক্তির উৎস খুঁজে বের করে ‘বিশেষ ট্রাইব্যুনালে’ বিচার করা জরুরি।
সরবরাহে ঘাটতি নেই, কিন্তু বাজার কেন অস্থিতিশীল! এ সমস্যা প্রতিকারে করণীয় হিসেবে আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার ওপর। সিন্ডিকেট ভাঙা না গেলে কোনোক্রমেই দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল করা যাবে না। একটি সরকারের জনপ্রিয়তা হারানোর ক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্য যে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে, আমরা কন্টিনিউ সে কথাই সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আমরা মনে করি, খুব বেশি নয় ২০-২৫টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি পৃথক ডিভিশন গঠন করবে। এছাড়া মোট চাহিদার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ সরকারের ব্যবস্থাপনায় সরবরাহের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে কোনো ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের পক্ষে বাজারনিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট