আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা
টেকসই উন্নয়নে লোকালাইজেশন
লোকাল ইজ আওয়ার ফিউচার। লোকাল ফিউচার হলো ‘নতুন অর্থনৈতিক’ আন্দোলন। বেশ কয়েকজন মানুষ ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পরিবেশগত কল্যাণের লক্ষ্যে লোকাল ফিউচারের অর্থনীতি প্রচার করছেন। এই অর্থনীতির অন্যতম পথপ্রদর্শক Helena Norberg-Hodge, যিনি ১৯৭৫ সাল থেকে লোকালাইজেশন (স্থানীয়করণ) প্রতিষ্ঠায় কাজ করে চলেছেন। তার এই কাজকে ‘একটি অনুপ্রেরণামূলক ক্ল্যাসিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। যদিও এই আন্দোলনের মূলনায়ক বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) প্রতিষ্ঠাতা প্রখ্যাত পল্লী উন্নয়ন গবেষক, দার্শনিক ও সমাজসেবক অধ্যাপক ডক্টর আখতার হামিদ খান। তিনি ১৯৫৯ সালে স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার লক্ষ্য বাস্তবায়নে বার্ড প্রতিষ্ঠা করেন। গ্লোবালাইজেশন পৃথিবীর বেশিরভাগ সম্পত্তি হাতেগোনা কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে কুক্ষিগত করে, আর লোকালাইজেশন স্থানীয় অর্থনীতি শক্তিশালী করার মাধ্যমে মানুষের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অর্থনীতিতে লোকালাইজেশন কার্যকরী করে বহুজাতিক কোম্পানির নেতিবাচক প্রভাব প্রতিরোধ এবং লোকালাইজেশনের পুনরুদ্ধার পদক্ষেপ দুটি পরিপূরক হিসেবে কাজ করে।
লোকালাইজেশন আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য কাজের অংশ হিসেবে International Alliance for Localization (IAL) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যাতে করে বিশ্বব্যাপী যথেষ্ট শক্তিশালী লোকালাইজেশন আন্দোলন গড়ে তোলার সম্ভব হয়। বিশ্বের ৫৮টি দেশের ১ হাজার ৮০০ এর বেশি ব্যক্তি, সংগঠন এবং গোষ্ঠী এখন পর্যন্ত IAL-এ যোগদান করেছে। IALবিভিন্ন মহাদেশের বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং ব্যক্তিদের একত্রিত করে ব্যবসায়ী নেতা এবং শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে শুরু করে কৃষক, সমাজ কর্মী এবং পরিবেশবিদরা একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে লোকালাইজেশনের তথ্য, জ্ঞান, মতামত ও সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি আদান-প্রদান করে থাকে।
লোকালাইজেশন উদ্দেশ্য হলো স্থানীয় সংস্কৃতির মধ্যে পণ্য বিকশিত করা। ওয়ার্ল্ড লোকালাইজেশন দিবসের লক্ষ্য পৃথিবীব্যাপী ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য লোকালাইজেশন আন্দোলনকে একটি শক্তিতে পরিণত করা এবং মানুষের খাদ্য ও পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় লোকালাইজেশন ব্যক্তি, প্রকৃতি এবং কমিউনিটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে তাদের সংযোগ পুনরুদ্ধার করার প্রয়োজন জাগিয়ে তোলা। বিশ্বব্যাপী লোকালাইজেশন আন্দোলনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে মানব মস্তিষ্ক থেকে বহুজাতিক কোম্পানির কর্তৃত্ববাদের উত্থান প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে স্থানীয় মানুষের জ্ঞান থেকে বীজ সংরক্ষণ, স্থানীয় খাবার পদ্ধতিগত রূপান্তরের মতো সাধারণ বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে ‘ওয়ার্ল্ড লোকালাইজেশন ডে’ পালন করা হয়। লোকালাইজেশন একটি মানব গল্প, যা সমাজের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে সংযোগ তৈরি করে এবং বৈচিত্র্যের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এটি একটি প্রগতিশীল, অনুপ্রেরণামূলক এবং জীবন অধিকার নিশ্চিত করার আন্দোলনের অংশ বটে। এই আন্দোলনকে সফল করতে কমিউনিটি, সংযোগ এবং স্থান তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে।
লোকাল ফিউচার দ্বারা উৎপাদিত পণ্য অর্থনৈতিতে লোকালাইজেশন দিকে একটি পদ্ধতিগত ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রচারের মাধ্যমে পরিবেশগত, সামাজিক এবং জনস্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধারের জন্য কাজ করে। আমরা যদি সমসাময়িক সামাজিক, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক সংকটের মূল কারণ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াই এবং অর্থনৈতিক ধারণাগুলোকে পুনর্বিবেচনা করে স্থানীয় অর্থনীতি ও কমিউনিটিগুলোকে পুনর্গঠনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ও জীববৈচিত্র্যের পুনরুদ্ধারের এই ইতিবাচক পরিবর্তনের আন্দোলনকে সবাই সমর্থন করে অংশগ্রহণের মাধ্যমে কাজ করি। তাহলে আমরা একসঙ্গে আমাদের স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারব।
লোকালাইজেশন প্রকৃতপক্ষে আমাদের ভবিষ্যৎ। Helena Norberg-Hodge এর লেখা `Local is Our Future' বইটিতে উল্লেখ রয়েছে; আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত সংকট ও সমস্যাগুলো কীভাবে একটি পদ্ধতিতে একই সঙ্গে সমাধান করতে পারে। তিনি সুস্পষ্ট করেছেন, লোকালাইজেশন বিষয়টি একে অপরের সঙ্গে (মানুষের সঙ্গে মানুষের), মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির ও স্থানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একটি সম্পর্ক। এটি একটি অত্যাবশ্যক নির্দেশিকা বটে। যা জনস্বাস্থ্য, পরিবেশগত সুরক্ষা ও স্থানীয় অর্থনীতি শক্তিশালীকরণ বিষয়ে আলোকপাত করেছে এবং যার মাধ্যমে জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবিলা করে প্রাণ-প্রকৃতিকে রক্ষা করে আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব। অর্থনৈতিক লোকালাইজেশনের একাধিক সুবিধা তুলে ধরে পুরস্কার জিতেছে `The Economics of Happiness’ ফিল্ম।
গ্লোবালাইজেশনের নামে বহুজাতিক কোম্পানির থাবার কারণে আমাদের স্থানীয় খাবার, শস্য বীজ ইত্যাদি হারিয়ে যাচ্ছে ও সমাজের মানুষের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং স্থানীয় অর্থনীতি হুমকির মধ্যে পড়ছে। তাই স্থানীয় শস্য বীজ ও খাবারের সংরক্ষণে পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। যাতে করে সামাজিক সম্পর্ক ও স্থানীয় অর্থনীতি শক্তিশালী হয় এবং মানুষের জীবনের ওপর বহুজাতিক কোম্পানির নেতিবাচক প্রভাব লাগাম টেনে ধরা এবং জলবায়ু বিপর্যয় রোধ করা যায়।
গ্লোবালাইজেশনের ফলে গ্লোবাল করপোরেশনগুলো বিশ্বব্যাপী তাদের মুনাফা বাড়ানোর জন্য এই নেতিবাচক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো নিয়মিতভাবে একই দেশ থেকে একই পণ্য আমদানি ও রপ্তানি করে। বিশ্বের লাখ লাখ ক্ষুধার্ত মানুষের ক্ষুধা নিবারণ করতে বা সাশ্রয়ী মূল্যে মানুষকে খাওয়ানোর জন্য নয়, বরং বিশ্বব্যাপী বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের মুনাফার পাহাড় বাড়ানোর জন্য এই ব্যবস্থার প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করছে। সম্প্রতি জানা যায়, পটুয়াখালী থেকে এক হাজার টন মুগডাল জাপানে রপ্তানি করা হবে। যেখানে বাংলাদেশ প্রতি বছর লাখ লাখ টন মুগডাল বিদেশ থেকে আমদানি করে, সেখানে আমরা কেন এই লঙ্কাকাণ্ড করতে যাচ্ছি। গ্লোবাল ফুড সিস্টেম মূলত পৃথিবীর সবচেয়ে দূষণকারী শিল্প, যা বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী। খাদ্যপণ্য দীর্ঘ দূরত্বের পরিবহন করতে খাদ্য সংরক্ষণ ও তাজা রাখতে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয় এবং শিল্পায়িত কৃষি অধিক কীটনাশক, ছত্রাকনাশক এবং অন্যান্য রাসায়নিক ব্যবহার করে থাকে, যার কারণে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ে। প্যাকেজিং করতে বাড়তি খরচ এবং পরিবহনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার করা হচ্ছে। যার ক্রয়ের সময় ব্যয়ভার বহন করতে হয় সাধারণ ভোক্তাকে। বর্তমান জীবনধারায় জ্বালানি সংকট সমাধানে লোকালাইজেশন অনেকখানি প্রয়োজন ও প্রাসঙ্গিক বটে।
শিল্পায়িত কৃষিতে বড় বড় মেশিন ব্যবহার করা হয়, ফলে বহু মানুষ চাকরি হারায়; মেশিনগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে বলে পৃথিবীব্যাপী কার্বন নিঃসরণের হার বাড়ছে। সরকারগুলো ইন্ডাস্ট্রি ও কারখানায় ভর্তুকি দেওয়ার কারণে রাসায়নিকভাবে তৈরি, কৃত্রিম ও শিল্পজাত খাবার সস্তা হয়ে থাকে। শিল্পায়িত কৃষি কারণে সাধারণ মানুষের কোনো প্রকার লাভ না হলেও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বড় মুনাফা হয়। স্থানীয় খাদ্য ব্যবস্থা প্রতি একর জমিতে অনেক বেশি খাদ্য উৎপাদন করলেও করপোরেট সুপারমার্কেটগুলো থেকে কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের বিক্রয়মূল্যের কেবলমাত্র ১০ শতাংশ বাড়িতে নিয়ে যেতে পারে। বিশ্বের কৃষি জীববৈচিত্র্যের ৯৫ শতাংশ ক্ষুদ্র কৃষক উৎপাদন করে থাকে। কৃষক স্থানীয় খাদ্য ব্যবস্থায় মাটি, বাস্তুতন্ত্র এবং জীববৈচিত্র্যের পুনরুদ্ধার করে টেকসই ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য সরবরাহ করে। সাধারণ মানুষ স্থানীয় কৃষকের বাজার থেকে খুচরা মূল্যে অনেক কম দামে খাদ্যপণ্য বাড়িতে নিয়ে যেতে পারে, যেহেতু তখন মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য থাকে না। এছাড়াও মানুষে মানুষে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে কমিউনিটিগুলো সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করে। লোকালাইজেশন আমাদের কমিউনিটি, সাধারণ মানুষ এবং কৃষকদের জন্য খাদ্য, নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্ব প্রদান করে।
লোকালাইজেশনের মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতির পুনঃস্থানীয়করণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। এটি জলবায়ু বিপর্যয় থেকে শুরু করে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষা পর্যন্ত সবকিছু সমাধান করতে সহায়তা করবে। অর্থনীতিতে গ্লোবালাইজেশনের নেতিবাচক প্রভাবগুলোকে প্রশমিত করে আমাদের কমিউনিটি এবং প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস প্রতিরোধ করতে পারি। প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, সমালোচনা ও গঠনমূলক বাণিজ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে ‘অর্থনৈতিক সাক্ষরতা’ বৃদ্ধি করা।
২০২২ সালে তৃতীয়বারের মতো সারা পৃথিবীর মানুষ ‘ওয়ার্ল্ড লোকালাইজেশন ডে’ আন্দোলন উদযাপন করতে এবং এই উদ্যোগকে সম্মান জানাতে (বিশেষ করে পরিবেশ সংরক্ষণ ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন, স্থানীয় অর্থনীতি এবং কমিউনিটিকে শক্তিশালী করতে) একত্রিত হচ্ছে। আমরা একই সঙ্গে লোকালাইজেশনের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে এবং পরিবেশের সঙ্গে আমাদের সংযোগ পুনরুদ্ধার করতে পারি। এর অর্থ হলোÑ তৃণমূলের সাধারণ মানুষ এবং নীতি-নির্ধারক স্তরের উদ্যোগের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও শক্তিশালী স্থানীয় অর্থনীতি, কমিউনিটি এবং বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার উৎসাহিত করা।
লোকালাইজেশন উদ্যোগের মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী এরই মধ্যে হাজার হাজার কৃষকের বাজার এবং খাদ্য সমবায় সমিতি থেকে শুরু করে স্থানীয় বিনিয়োগ স্কিম এবং স্থানীয় প্রচারণা ও ক্রয়-বিক্রয়, নগর কৃষি থেকে ইকো-ভিলেজ এবং কমিউনিটির মালিকানাধীন মাইক্রো-গ্রিড ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যদিও এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি কোনো সরকারি সমর্থন পায় না বলা চলে, তাই রাডারের মিটারের মতো মূলধারার গণমাধ্যমের মিটারের নিচে পড়ে থাকে। এজন্য মানুষ বিষয়টি সম্পর্কে এখনো এত বেশি জানতে পারেনি। ভিন্ন ভিন্ন পটভূমিতে পরিবেশ, জীবিকা, সাংস্কৃতিক ও জীববৈচিত্র্য এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর বিশ্ব অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাবের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে কয়েক ডজন দেশের চিন্তাশীল মানুষ ব্যাপকভাবে তথাকথিত অর্থনীতি ও গ্লোবালাইজেশনের বিরুদ্ধে এবং অর্থনীতি বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় অর্থনীতি শক্তিশালী করতে, কমিউনটির মানুষের সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে এক কণ্ঠে কথা বলেছে। তাই সবাইকে জ্বালানি সংকট সমাধান, সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়ন, স্থানীয় অর্থনীতি শক্তিশালীকরণ ও প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় আমাদের সর্বত্র লোকালাইজেশন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।
লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট [email protected]