মো. ফুয়াদ হাসান
ফিরে দেখা
তীব্র হচ্ছে বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট
জলবায়ু পরিবর্তন ও তার বিরূপ প্রভাব বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত বিষয়বস্তু। প্রতিনিয়ত পত্রপত্রিকায় এ বিষয়ে বিস্তার আলোচনা হচ্ছে। উঠে আসছে পক্ষে-বিপক্ষে হাজারো যুক্তি ও মতামত। তবে সবকিছুর পরও এর ফলাফল যেন শূন্যের কোঠা পেরোতেই চাচ্ছে না। মানুষের অমানবিক কর্মকাণ্ড প্রতিনিয়ত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে বিশ্বকে। সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে পৃথিবী জুড়ে বন্যা, ঝড়, খরা, দাবানলের মতো ঘটনা। নতুন করে ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে বিশ্ববাসীকে।
করোনার মহামারিকালে অর্থনীতি, সামাজিক ও মানবিক সব ক্ষেত্রে অসহনীয় দুর্ভোগ নেমে এলেও একটি জায়গায় বেশ সু-সংবাদ পেয়েছিল বিশ্ববাসী। করোনার তাণ্ডব থেকে বাঁচতে সংকীর্ণ হয়েছিল পৃথিবীর মানুষদের স্বাভাবিক দৈন্দিন কর্মকাণ্ড। এই অবারিত সুযোগ যতেষ্ট ব্যবহার করেছিল প্রাণিজগৎ। পৃথিবী জুড়ে নতুন মাত্রা পেয়েছিল স্থল ও জলের সব প্রাণিকুল। আমাদের মনে আশা জাগিয়ে ছিল বিভিন্ন জায়গায় প্রকৃতির সজীবতার খবরে। কিন্তু এ সু-সংবাদ খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। অসুস্থ পৃথিবী সুস্থ হতে না হতেই শুরু হয় বিশ্ববাসীর সেই চিরচেনা অমানবিক কর্মকাণ্ড। ফলাফল আবার পৃথিবীর দূষণ। পৃথিবী জুড়ে মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে অনাকাক্সিক্ষত নগরায়ণ, শিল্পায়নের প্রশ্নে বন উজাড় করার মতো ঘটনা, যা জলবায়ু পরিবর্তনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে।
গৃহকর্ম থেকে শুরু করে বিশ্ব কর্মকাণ্ড সবকিছু পরিবেশ দূষণে মারাত্মক অনুঘটক। কৃষিতে কীটনাশকের অপরিমিত ব্যবহার, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, নদীদূষণ, বনায়ন উজাড়সহ নামমুখী কর্মের ফলে দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। আধুনিক বিশ্বে উন্নত জীবনের চাহিদা জোগাতে পরিবেশের বিপযর্য় করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে। এতে আপাত দৃষ্টিতে উন্নয়ন মনে হলেও কালপরিক্রমায় পরিবেশসহ সব ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের নামে বিশ্বের সর্বত্র চলছে প্রকৃতি নিধনের মহাযজ্ঞ। উন্নয়ন পরিকল্পনায় আপাতদৃষ্টিতে যতটুকু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উপলব্ধি করা যায় তার চেয়ে বহু গুণ ক্ষতির কারণ উপলব্ধি হয় না স্বল্পসময়ে। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত এই প্রবৃদ্ধি আমাদের গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে দিন দিন। বর্তমান সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের নানামুখী প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবর মনে করিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতির নির্মমতা। পৃথিবী জুড়ে বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, ঝড়, ভূমিধস, দাবালন, নদীর নাব্যতা হ্রাসসহ নানামুখী সংকট যেন আমাদের কোণঠাসা করে তুলেছে। পৃথিবীর বুকে এই অনাকাক্সিক্ষত দুর্যোগ বিশ্ব অস্তিত্বে সংকট সৃষ্টি করছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে খাদ্য নিরাপত্তাহীন মানুষের সংখ্যা ৩৪ কোটি ছাড়িয়েছে। অতিমারি, সংঘর্ষ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ ও জাতিগত সংঘাত এ সংকটকে আরো ত্বরান্বিত করছে। অতিমারির আগে নিরাপত্তাহীন মানুষের সংখ্যা ছিল ১৩ কোটি, যা করোনা-পরবর্তী সংঘাত ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ১০ গুণ বেশি বাস্তুচ্যুত ও অনাহারির সংখ্যা বেড়েছে। এমনিতেই পৃথিবীতে উদ্বাস্তু ও অনাহারির সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে, তার ওপর খাদ্য সংকট সৃষ্টির শঙ্কা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। শুধু তাই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তীব্র খরায় ধুঁকছে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। এতে যেমন জীবনযাত্রার মান নেমে গিয়েছে অসহনীয় পর্যায়ে, সৃষ্টি হয়েছে সুপেয় পানির অভাব। বৈশ্বিক তীব্র খরায় মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া ও পণ্য যাতায়াত ব্যবস্থা, যা খাদ্যসহ নানামুখী বৈশ্বিক সংকটকে আরো ঘনীভূত করছে।
জাতিসংঘের তথ্য বলছে, বিশ্বের প্রায় ২৩০ কোটি মানুষ সুপেয় পানির সংকট থাকা দেশগুলোতে বসবাস করছে। এমতাবস্থায় জলবায়ু সংকট আরো প্রবল হলে বৈশ্বিক সুপেয় পানির সংকট আরো বহু গুণে বেড়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিসের তথ্য মতে, তাপমাত্রা সূচক যদি ৩৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়, তবে এটি বিপজ্জনক মনে করা হবে। আর যদি তা বেড়ে ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায় তাহলে সেটি হবে মারাত্মক বিপজ্জনক। মানুষের কর্মকাণ্ড প্রতিনিয়ত পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে, যা জলবায়ুর মারাত্মক ক্ষতি করছে। তাই শঙ্কা করা হচ্ছে ২১ শতকের মধ্যে চীন, জাপান, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ৩ থেকে ১০ গুণ বেশি বিপজ্জনক পরিস্থিতির জন্ম দেবে। জলবায়ুর এই অনাকাক্সিক্ষত পরিবর্তনের ফলে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা, খরা ও দাবনলের মতো ঘটনা, যা ব্যাহত করছে উৎপাদন ব্যবস্থা, ধ্বংস করছে প্রাকৃতিক সম্পদ ও বৃদ্ধি করছে বৈশ্বিক নানামুখী সংকট। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে বিশ্ববাজারে। তীব্র খরায় ব্রাজিলে কফি উৎপাদন কমছে আশঙ্কাজনক হারে। কলোম্বিয়ায় কফি উৎপাদন কমেছে ২২ শতাংশ। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ সংকট বাড়ছে। সরবরাহ সংকটে ভুট্টার দাম বেড়েছে ৭ শতাংশ। গত বছরের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে কৃষিপণ্যের দাম ৬ শতাংশ বেড়েছে। তীব্র তাপপ্রবাহ ও খরা সয়াবিন, গমসহ বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন কমাতে ভূমিকা রাখবে।
অতিমাত্রায় উষ্ণতা ও শৈত্যপ্রবাহ দুটোই কৃষির জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ দুটোয় বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে জলবায়ু অনাকাক্সিক্ষত এই পরিবর্তনের সঙ্গে কৃষি উৎপাদন খাত দ্রুত অভিযোজন হতে পারছে না। এজন্য বৈশ্বিক কৃষি উৎপাদন খাত ও বাজার ব্যবস্থায় সংকট দেখা দিচ্ছে। এমতাবস্থায় পৃথিবীর সুরক্ষার জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কাজ করা জরুরি। তাই সবুজ পৃথিবী ও জলবায়ু বন্ধুসুলভ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া সময়ের দাবি। বিশ্বনেতাদের মতানৈক্য ভুলে এই জায়গায় সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না যে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তাই পরিবেশ বিনষ্টকারী অনুঘটকগুলো খুঁজে বের করে সেসব নির্মূূলে কাজ করতে হবে। বিশ্বব্যাপী পবিবেশবিরোধী যে নগরায়ণ ও বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতা চলছে তা থেকে সরে এসে জলবায়ু তথা প্রাকৃতিক পরিবেশের বন্ধুসুলভ উন্নয়নে নজর দিতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বড় অনুঘটক উন্নত বিশ্ব হলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলো। বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম একটি দেশ, যা ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচের ২০১০ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইন্ডেক্স অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় শীর্ষেই রয়েছে বাংলাদেশ। এই সমীক্ষাটি ১৯৯০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ১৯৩টি দেশের ওপর চালানো হয়। ওই প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত ২০০৭ ও ২০০৮ সালের রিপোর্টেও বাংলাদেশকে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে উল্লেখ করে। গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, ২১০০ সাল নাগাদ সাগরপৃষ্ঠ সর্বোচ্চ ১ মিটার উঁচু হতে পারে, যার ফলে বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় ১৮.৩ শতাংশ এলাকা নিমজ্জিত হতে পারে।
এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতি বছর অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যা, টর্নেডো, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ভূমিকম্পসহ নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ছে উৎপাদন খাত। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরায় ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অনুন্নত, সনাতনী ও প্রকৃতিনির্ভর কৃষি দ্রুত অভিযোজন করতে পারছে না জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে। ফলে কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, সৃষ্টি হচ্ছে বাজার সংকট। তা ছাড়া দরিদ্র কৃষকদের ক্রমাগত লোকসান ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষিকাজে অনিহার সৃষ্টি করছে, যা দেশের উৎপাদন খাত ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এমতাবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তন হ্রাসে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। তা ছাড়া বৈশ্বিক এ সংকট আমাদের মতো দেশের জন্য মারাত্মক নেতিবাচক সংকেত বয়ে আনবে, যা কখনোই আমাদের কাম্য হতে পারে না।
লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
[email protected]