শহীদুল ইসলাম

  ৩১ আগস্ট, ২০২২

বৈশ্বিক মন্দা ও দেশীয় অর্থনীতি

বিশ্ব অর্থনীতি এখন এক অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রবেশ করেছে। ভুগছে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে। বিশ্বের প্রায় দেশ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হতে শুরু করেছে। সংকুচিত হচ্ছে বিশ্বের প্রায় দেশের অর্থনীতি। ধারণা করা হচ্ছে, বিশ্ব এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার দিকে দাবিত হচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এরই মধ্যে পরপর দুই প্রান্তিকে সংকুচিত হয়েছে। দ্বিতীয় বৃহত্তর অর্থনৈতিক দেশ যুক্তরাজ্যেরও অর্থনীতি প্রথম প্রান্তিকে সংকুচিত হয়ে দ্বিতীয় প্রান্তিকে সংকুচিত হতে যাচ্ছে। একই অবস্থা ইউরোপের অন্য দেশগুলোরও। ঘোষণা না দিলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে মন্দার কবলে পড়েছে বলে মনে করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভুগছিল, যা গত ৪০ বছরে রেকর্ড মূলস্ফীতি হিসেবে দেখা হয়। মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকনীতি সুদহার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেনি।

সাধারণত অর্থনৈতিক ধারণা অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকসমূহ নীতি সুদহার তথা মুনাফা বাড়িয়ে থাকে। এর ফলে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমে যায়। ফলে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে চলে আসে। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নীতি সুদহার বাড়িয়েও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না মূল্যস্ফীতি। বরং, বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি আরো সংকুচিত হচ্ছে। এতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রবল আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদদের মতে, চলতি বছরের শেষ কিংবা আগামী বছরের শুরুতে বিশ্বমন্দার ঝুঁকি আরো গুরুতর হবে। ব্লুমবার্গের অর্থনৈতিক মডেল অনুসারে ২০২৪ সালে মন্দা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা শতভাগ। জার্মানির ডয়েচে ব্যাংকের অর্থনীতিবিদদের ধারণা, মন্দা দেখা দিতে পারে ২৩ সালের মাঝামাঝিতে। সাধারণত কোন অর্থবছরে পরপর দুই প্রান্তিকে তথা ছয় মাসে অর্থনীতি সংকুচিত বা ঋণাত্মক (নিম্নমুখী) হওয়াকে মন্দা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

মূলত করোনাকালীন বিশ্ব অর্থনীতি এক সংকটের মুখে পড়ে। করোনা-পরবর্তী বিশেষ করে গত বছরের মাঝামাঝি থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের দিকে মনোযোগ দিয়েছিল বিশ্ব। ঘুরেও দাঁড়াচ্ছিল প্রায়। এরই মধ্যে হঠাৎ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বকে এক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়। ফলে এক ধরনের অনিশ্চিত সংকট পার করছে বিশ্ব। বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের ৩০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও ইউক্রেনের উৎপাদিত খাদ্যশস্য ঠিকমতো রপ্তানি করতে না পারার ফলে বিশ্ব সরবরাহজনিত সংকটের মুখে পড়ে। ফলে সরবরাহ সংকটজনিত কারণে এসব দেশের উৎপাদিত খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যায়। এরই মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ে আমদানিনির্ভর দেশসমূহ। দ্রব্যের দাম বাড়ার ফলে তাদের আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। চাপে পড়ে দেশগুলোর রিজার্ভে। ফলে দেশগুলো এক ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে। এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হলেও আরো দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাব্য তালিকায় রয়েছে প্রায় ৯টি দেশ। অর্থাৎ বলা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রায় পুরো বিশ্বকে ভোগাচ্ছে।

সর্বোপরি নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে, বিশ্ব অর্থনীতি একটি ভয়াবহ মন্দার মুখে পড়তে যাচ্ছে। আর স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের ওপরও। বাংলাদেশে এরই মধ্যে এর প্রভাব পড়া শুরু করছে। বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে আমাদের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ যা ২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে ২১-২২ অর্থবছরে ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে রেকর্ড পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতির মধ্যে পড়েছে। ২১-২২ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতির পরিমাণ ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। বাণিজ্য ঘাটতির ফলে টাকার মানের দরপতন ঘটেছে। ফলে চাপে পড়ে রিজার্ভ। রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৩৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। যদিও সংকট ঠেকাতে সরকার এরই মধ্যে আমদানি ব্যয় হ্রাস করতে ১২ থেকে ১৬টি পণ্য নিষিদ্ধ ও ১২৩টি পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক বাড়ানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর ফলে আমদানির পরিমাণও জুন মাসের চেয়ে জুলাইয়ে প্রায় ২ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার হ্রাস পেয়েছে। এলসি খোলার হার কমেছে প্রায় ৩ শতাংশ। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যয়ের লাগাম টানতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে থাকা কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সংকট কাটাতে সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের পথে হাঁটছে। কিছুটা সুফল পেতে শুরু করলেও অনিশ্চিত সংকটে সে সুফল কতটুকু ধরে রাখতে পারবে তা এখনই পরিষ্কার করে বোঝা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস রপ্তানি এবং প্রবাসী আয়। কোভিড মহামারি অতিক্রমের পর আমাদের রপ্তানিতে সুবাতাস বয়ে যাচ্ছে। যদিও গত তিন মাস আগের মাসগুলোর তুলনায় কমেছে। রপ্তানি আয়ের প্রধানতম খাত হচ্ছে পোশাকশিল্প। রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮২ শতাংশ-ই আসে পোশাকশিল্প থেকে। অর্থাৎ ২১-২২ অর্থবছরে এ খাত থেকে আয় এসেছে ৪ হাজার ২৬১ কোটি মার্কিন ডলার, যা রপ্তানি আয়ের ৮১ দশমিক ৮১ শতাংশ। পোশাক রপ্তানিতে ২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে ২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। কাঁচামাল আমদানি খরচ বাদ দিলে পোশাকশিল্প প্রকৃত রপ্তানি প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ২৪ শতাংশ। পোশাকশিল্প ছাড়াও আরো চারটি খাত রয়েছে, যেগুলো থেকে বাংলাদেশ প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। এগুলো হলো যথাক্রমে হোম টেক্সটাইল, চামড়া-চামড়াজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য এবং পাট-পাটজাত পণ্য। গত ২১-২২ অর্থবছরে এ চারটি খাত থেকে আয় এসেছে যথাক্রমে ১৬২ কোটি, ১২৫ কোটি, ১১৬ কোটি ও ১১৩ কোটি মার্কিন ডলার। অর্থাৎ রপ্তানিতে পোশাকশিল্পসহ এসব খাতের অবদান ৯১ দশমিক ৭২ শতাংশ। তবে কোভিড মহামারিকালে রেকর্ড পরিমাণ প্রবাসী আয় এলেও তা এখন কমে এসেছে। ২১-২২ অর্থবছরে যার পরিমাণ ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০-২১ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২৪ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যদিও ধারণা করা হচ্ছে, আগের অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরে প্রবাসী আয় বাড়তে পারে।

আসন্ন বৈশ্বিক মন্দার কারণে আমাদের রপ্তানিতে এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে পোশাক খাত নিয়ে; যা বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস। বাংলাদেশ রপ্তানি পণ্যের প্রধান বাজার ইউরোপ ও আমেরিকা। সাধারণত এসব দেশে মন্দা দেখে দিলে তার প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের রপ্তানিতে। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভুগছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। ফলে তৈরি পোশাক-চামড়াপণ্যসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যের চাহিদা কমেছে। ২১ আগস্ট গণমাধ্যমের তথ্যানুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক খুচরা বিক্রেতা ও বাংলাদেশের পোশাক পণ্যের বড় ক্রেতা ওয়ালমার্ট চলতি মাসে সারা বিশ্বের উৎপাদকদের দেওয়া শত শত কোটি ডলারের পণ্যের ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে। মূলত মূল্যস্ফীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা কেনাকাটা কমিয়ে দেওয়ায় খুচরা বিক্রেতারা পণ্য ক্রয় করতে পারছে না। ফলে ক্রয়াদেশ কমিয়েছে এসব কোম্পানি।

সর্বোপরি, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মন্দা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য শঙ্কার। পোশাক রপ্তানি হ্রাস পেলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার আয়ও হ্রাস পাবে। এদিকে আমাদের প্রবাসী আয়ও পর্যাপ্ত না। ফলে এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ আয় হ্রাস পাওয়া মানে রপ্তানিশিল্পে ধস নামা। ফলে এর প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে। এরই মধ্যে আমাদের অর্থনীতিতে এক ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে প্রায় ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ। পরিবহন ভাড়াও বেড়েছে ২২ শতাংশ। বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও। অর্থাৎ সামগ্রিক অর্থনীতির প্রতিটি খাতে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। এরই মধ্যে যদি বৈশ্বিক মন্দায় আমাদের রপ্তানি আয় কমে আসে, তা আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে; তা সহজেই বলা যায়। পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকা আমাদের দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে। যদিও অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, মন্দার কারণে কম মূল্যের পোশাকের চাহিদা বাড়তে পারে। বাংলাদেশ এখনো কম মূল্যের পোশাক রপ্তানি করে থাকে। ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়তে পারে। এতে পোশাক খাতে রপ্তানি বাড়লেও তা স্বস্তি দিতে পারবে বলে মনে হয় না।

সংকট উত্তরণে সরকার নিম্নোক্ত পরিকল্পনাসমূহ গ্রহণ করতে পারে। এক. আমদানি ব্যয় হ্রাস করা, অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর বন্ধ এবং সরকারি ব্যয় হ্রাসসহ সংকট উত্তরণে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা দ্রুত কার্যকরে আরো জোর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দুই. দেশে বর্তমান জ্বালানি মজুদের যে সক্ষমতা তা আরো দীর্ঘায়িত করে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি দেশে নিজস্ব গ্যাস আবিষ্কার, উত্তোলন ও ব্যবহারে অধিক মনোযোগী হওয়া অর্থাৎ স্থায়ীভাবে জ্বালানি উত্তোলনের ব্যবস্থা করতে হবে। তিন. আমদানিনির্ভরতা কমাতে আমাদের নিজস্ব উৎপাদন বাড়াতে হবে। চার. রপ্তানি বাড়াতে পোশাক খাতের পাশাপাশি অন্যান্য খাতকেও গুরুত্ব দিতে হবে। অর্থাৎ রপ্তানি বহুমুখীকরণের দিকে মনোযোগ দিতে। পাঁচ. বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা ও পাচার রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সর্বোপরি, সংকট কাটাতে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ

ফেনী সরকারি কলেজ, ফেনী।

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বৈশ্বিক মন্দা,দেশীয় অর্থনীতি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close