ড. মোহাম্মদ বজলুর রহমান
টেকসই উন্নয়নের জন্য জেনোমিক ইভালুয়েশন
মহাকাশে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ, কথাটি ভাবতেই গর্বে বুকভরে যায়। পৃথিবীর গুটিকয়েক শিল্পোন্নত দেশের যেখানে অবাধ বিচরণ ছিল, সেখানেও আজ ভাগ বসিয়েছে বাংলাদেশ। গত ২০১৪ সাল হতে প্রতিবেশী দেশসমূহ থেকে গবাদিপশু আমদানি ছাড়াই নিজস্ব গবাদিপশু দ্বারা কোরবানির বিশাল চাহিদা পূরণ নির্দেশ করে প্রাণিসম্পদের উন্নয়নেও বাংলাদেশ আজ পিছিয়ে নেই। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, দেশ আজ মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। অতি নিকট ভবিষ্যতে এ দেশ হতে মাংস রপ্তানি শুরু হবে। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নিজস্ব আইএসও সনদপ্রাপ্ত রেফারেন্স ল্যাবরেটরি চালু হয়েছে। দুধ উৎপাদনে আমরা কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও এখানে উন্নতির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। দুধ উৎপাদনে যেসব কারণ সরাসরি অন্তরায় হিসেবে কাজ করে তাদের মধ্যে নিম্ন কৌলিক মান অন্যতম। এ কথা অনস্বীকার্য, বিদেশ হতে আমদানিকৃত ষাঁড়ের বীজ দিয়ে কৃত্রিম প্রজননের ফলে দেশে কিছু ভালো মানের সংকর জাতের গাভি/বকনা তৈরি হয়েছে। এখানেও তৈরি হয়েছে একটি মারাত্মক সমস্যা। যথাযথ তথ্য সংরক্ষণের অভাবে কোনো গাভি/বকনাতে শতকরা কত ভাগ বিদেশি জাতের কৌলিক মান রয়েছে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তাছাড়া একই গাভিকে বিভিন্ন জাতের সিমেন দিয়ে কৃত্রিম প্রজননের ফলে একটি হযবরল অবস্থা তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে বড় ধরনের সমস্যা হলো একই ষাঁড়ের বীজ দিয়ে তার প্রজেনিকে প্রজনন, যাকে অন্তঃপ্রজনন বলা হয়। ফলে সম্ভবনাময় প্রজেনিসমূহের উর্বরতা ও দুধ উৎপাদন ক্ষমতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। অথচ দুগ্ধশিল্পে উন্নত দেশসমূহ যেকোনো প্রজেনির কমপক্ষে ৩ জেনারেশন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় তথ্যসমূহ সংরক্ষণ করেন এবং কৃত্রিম প্রজননের আগে সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে থাকেন।
ইদানীংকালে আমাদের দেশের সচেতন কিছু খামার মালিক প্রধানত প্রজেনির বাবা-মায়ের দুধ উৎপাদন তথ্য লিপিবদ্ধ করে রাখেন। অথচ গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন ও উৎপাদন দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কমপক্ষে ২০-২৫টি তথ্য সংরক্ষণ করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ৩ জেনারেশন পর্যন্ত ৩০৫ দিনের গড় দুধ উৎপাদন, দুধে ফ্যাট ও প্রোটিনের পরিমাণ, দুধে সোমাটিক কোষের পরিমাণ, কোনো প্রকার রোগের প্রবণতা, মেসটাইটিস রোগের কোনো ইতিহাস, বাছুর জন্মের সময়ে কোনো অস্বাভাবিকতা, গর্ভফুল আটকে যাওয়ার কোনো অতীত ইতিহাস ইত্যাদি তথ্য আবশ্যিকভাবে লিপিবদ্ধ থাকে। তাছাড়া প্রজেনি নির্বাচনের সময় তার দৈহিক কাঠামো, পায়ের আকার-আকৃতি, ওলানের গঠন ও অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ের ওপর ২৫টি তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়ে থাকে। এ কথা অনস্বীকার্য, খামার মালিকের পক্ষে এতগুলো তথ্য লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ করা একটি দুরূহ কাজ। তাছাড়াও আমাদের দেশে গাভি/বকনারও কোনো ইউনিক চিহ্নিতকরণ নম্বর নেই। গবাদিপশু চিহ্নিতকরণের জন্য কানের ট্যাগিং একটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত পদ্ধতি। অথচ আমাদের দেশের অধিকাংশ খামার মালিকরা তাদের গবাদিপশুর কানে ট্যাগিং করতে রাজি হন না। গবাদিপশু চিহ্নিতকরণ ও তথ্য সংরক্ষণের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ইতোমধ্যে ‘কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম সম্প্র্রসারণ ও ভ্রূণ স্থানান্তর প্রযুক্তি বাস্তবায়ন প্রকল্প (৩য় পর্যায়)’-এর মাধ্যমে গবাদিপশু চিহ্নিতকণের জন্য আধুনিক ট্যাগিং ও তথ্য সংরক্ষণের জন্য ডেটাবেইজ ও মোবাইল অ্যাপস তৈরির জন্য কাজ শুরু করেছে। খামার মালিকরা এই অ্যাপস ব্যবহারে সহজেই খামারের তথ্যসমূহ সংরক্ষণ করতে পারবেন এবং কৃত্রিম প্রজনন কর্মীরা এই অ্যাপসের মাধ্যমে অতিদ্রুত তার মুঠোফোনে গাভি/বকনার বাবা-মায়ের তথ্য দেখে পরবর্তী প্রজননের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
আমি আগেই উল্লেখ করেছি, বর্তমানে দেশে বেশ কিছু ভালো মানের শংকর জাতের গাভি/বকনা তৈরি হয়েছে। খামার মালিকরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় থাকেন তাদের এসব গাভি/বকনাকে পরবর্তী কৃত্রিম প্রজননের ক্ষেত্রে। তারা সর্বদাই চান আরো অধিক দুধ উৎপাদনে সক্ষম ষাঁড়ের বীজ দিয়ে প্রজনন করাতে। এ ক্ষেত্রে তারা অনেক সময় সরকারের ব্রিডিং পলিসি পুরোপুরি অনুসরণ না করেই ভিন্ন কোনো জাতের ষাঁড়ের সিমেন আমদানি করে থাকেন। অথচ সিমেন আমদানিতে শুধু দুধ উৎপাদন ক্ষমতা মুখ্য বিষয় হওয়া উচিত নয়। দুগ্ধশিল্পে উন্নত দেশসমূহ ষাঁড়ের সিমেন নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রধানত টোটাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স (Total Performance Index, TPI) ও নেট মেরিট (Net Merit, NM) নামক নির্দেশকসমূহের ওপর নির্ভর করে থাকে। ঞচও যৌথভাবে ভবিষ্যৎ প্রজেনির দেহের আকার-আকৃতি, ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত গুণাবলি কেমন হবে, তা নির্দেশ করে থাকে। অন্যদিকে ঘগ দ্বারা ষাঁড়ের ভবিষ্যৎ প্রজেনির উৎপাদন দক্ষতা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত গুণাবলি অন্তর্ভুক্ত করে তা আর্থিকভাবে লাভবান হবে কি না, এসব বিষয় ভালোভাবে বিবেচনা করে থাকে।
উপরোল্লিখিত দুটি নির্দেশক ছাড়াও ভবিষ্যৎ প্রজেনির দুধে ফ্যাটের পরিমাণ, প্রোটিনের পরিমাণ, ওলানের গঠন, পায়ের আকৃতি, দুধে সোমাটিক কোষের পরিমাণ এবং উর্বরতা দক্ষতা ইত্যাদি বিশদভাবে বিবেচনা করে থাকেন। বিদেশ হতে অধিক দুধ উৎপাদনক্ষম ষাঁড়ের বীজ আমদানি করে আমাদের দেশের গাভিতে প্রজনন করলেও অধিক দুধ উৎপাদনক্ষম বকনা বা ষাঁড় তৈরির অনেক ক্ষেত্রেই নিশ্চয়তা নেই। আমরা যাকে পরিবেশগত কারণ বলে থাকি, বৈজ্ঞানিক ভাষায় তা ইপিজেনেটিক পরিবর্তন নামে পরিচিত। অর্থাৎ ইপিজেনেটিক পরিবর্তনের কারণে আমরা কাক্সিক্ষত দুধ উৎপাদন পেতে নাও পারি, এ কথাটি আমাদের খামার মালিকদের মনে রাখতে হবে। আমাদেরও সময় এসেছে বিদেশ হতে ষাঁড়ের সিমেন আমদানির ক্ষেত্রে বর্ণিত বিষয়সমূহ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিবেচনা করা।
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অধিক বিবেচনার দাবি রাখে, তা হলো উক্ত ষাঁড়ে কোনো ক্ষতিকর হ্যাপলোটাইপ আছে কি না। হ্যাপলোটাইপ হলো একটি জেনেটিক ডিফেক্ট, যা হুবহুভাবে শুধু বাবা ষাঁড় অথবা মা গাভির ডিএনএ হতে বাছুরের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়। আমার জানা মতে, এ পর্যন্ত ৯ ধরনের হ্যাপলোটাইপ আবিষ্কৃত হয়েছে। গাভি ও ষাঁড় উভয়েরই ডিএনএ-তে একই ধরনের হ্যাপলোটাইপ উপস্থিত থাকলে এবং তাদের মধ্যে প্রজনন হলে বাছুর ভ্রূণ অবস্থায়ই অথবা জন্মের আগেই মারা যাবে। আর যদি শুধু গাভি অথবা ষাঁড়ে কোনো হ্যাপলোটাইপ উপস্থিত থাকে; তাহলে ওই হ্যাপলোটাইপ বাছুরে ক্যারিয়ার হিসেবে কাজ করবে এবং পরবর্তীতে কোনো ক্যারিয়ার ষাঁড়ের সিমেন দিয়ে প্রজনন করলে তাদের প্রজেনি ভ্রূণ অথবা জন্মের আগেই মারা যাবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, হ্যাপলোটাইপের উপস্থিতি ভ্রূণের মৃত্যু ঘটিয়ে খামারের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে থাকে। আমাদের দেশের অনেক খামারেই হয়তোবা এ ধরনের সমস্যা রয়েছে; যা হ্যাপলোটাইপের জন্যই কি না, তা গবেষণার দাবি রাখে।
মহাকাশ বিজয় দিয়ে যেমন এ লেখার অবতারণা করেছিলাম, তেমনি প্রাণিসম্পদের টেকসই উন্নয়নের জন্য আমাদেরও গবাদিপশু চিহ্নিতকরণ ও তথ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তির পরশ লাগাতে হবে। মহাকাশেই সংরক্ষণ করতে হবে ডিজিটালাইজড তথ্যভান্ডার, খামারিদের বাড়িতে নয়। ডিজিটালাইজড তথ্যভান্ডার চালুর সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও ন্যূনপক্ষে প্রজনন ষাঁড় নির্বাচনের ক্ষেত্রে জেনেটিক ইভালুয়েশন পদ্ধতি চালু করতে হবে, যাতে করে ভবিষ্যৎ প্রজেনি জন্ম নেওয়ার আগেই তাদের দুধ উৎপাদন দক্ষতা, পুনরুৎপাদন ক্ষমতা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে খামারিদের পূর্বাভাস দিতে পারি এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অনেক গবেষকই এসব প্রয়োজনীয় জেনেটিক ইভালুয়েশন করতে সক্ষম বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি।
লেখক : উপপরিচালক ও সাবেক ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট, কৃত্রিম প্রজনন ও ভ্রূণ স্থানান্তর প্রকল্প (তৃতীয় পর্যায়) ,প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, ফার্মগেট, ঢাকা।