রাশেদা আক্তার
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও প্রজন্মের পুষ্টিহীনতা
সুস্থ থেকে অসুস্থ, শিশু থেকে বৃদ্ধ সব মানুষের বেচে থাকার অপরিহার্য উপাদান হলো খাদ্য। এ খাদ্য শুধু পেটের ক্ষিদে নিবারণ করলে হয় না, শরীর ও বয়স অনুযায়ী প্রয়োজন হয় পুষ্টিকর খাবারের। পুষ্টিকর খাবার বলতে আমরা শর্করা, আমিষ, ভিটামিন, মিনারেলস, জিংক, আয়রণ ও ফসফরাস সমৃদ্ধ খাবারকে বুঝি। বড়দের চেয়ে বাড়ন্ত শিশুদের এসব খাবারের চাহিদা অনেক বেশি। বড়দের কর্মক্ষম রাখতে আর শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ সাধন ও হাড়ের গঠনসহ নানা প্রয়োজনে পুষ্টির দরকার হয়। কিন্তু বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পদতলে মানুষের জীবন পিষ্ট। পাগলা ঘোড়ার দৌড়ের মতো বাড়ছে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম। আর আয় না বাড়ার বিপরীতে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে দৈনন্দিন পারিবারিক চাহিদা মেটাতে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষেরা পূর্বের তুলনায় খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে—নয়তো শুধু ডাল ভাত দিয়ে কোনো রকম দিন পার করতে বাধ্য হচ্ছে। যার ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারে শিশুরা পুষ্টিহীনতার শিকার হচ্ছে।
ইউএসএআইডি বলছে, বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ গর্ভবতী মা ও শিশুরা আগে থেকেই পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। স্বাভাবিক সময়ে অপুষ্টির যে চিত্র করোনা ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তা আরো বাড়ছে। অপুষ্টির সঙ্গে বিভিন্ন রোগবালাই সংক্রমণের সম্পর্ক রয়েছে। অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কম। তাই বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশনসহ বিভিন্ন রোগব্যাধি বেড়ে যায়। সে সঙ্গে ব্রেইনের কর্মক্ষমতাও কমে যায় অনেকটা। গবেষণা সংস্থা সিপিডির মতে, স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন সূচকে উন্নতি হলেও পুষ্টি খাতে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এখনো অনেকটা পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। তার ওপর দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন দাম বাড়ার কারণে নিম্ন আয়ের মানুষেরা খাবারের পরিমাণ কমালে সামনে পুষ্টিহীনতার অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে। আমাদের দেশে গরিবের প্রোটিন বলা হয় ডিম ও দুধকে। কিন্তু এসব পণ্যে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ায় তা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত গরিব মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নাগালে নেই। ফলস্বরূপ, এর প্রভাব পড়ছে নিম্নআয়ের পরিবারের শিশু-কিশোরদের ওপর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ৫৪ শতাংশ প্রাক-স্কুলগামী শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে এবং ৫৬ শতাংশ শিশুর ওজন কম যার মূলে রয়েছে পুষ্টিহীনতা। আর এ অপুষ্টির কারণে আগামী প্রজন্ম তথা শিশুরা বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় পড়বে। আবার তাদের কর্মদক্ষতাও কমে যাবে, ফলে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে। কেননা আগামী প্রজন্মের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা হবে কর্মদক্ষতা, সৃজনশীলতা ও মেধার ভিত্তিতে। আমরা জানি একজন বাড়ন্ত শিশুর দৈনিক ১০০০ ক্যালরি শক্তির প্রয়োজন হয় যার পুরোটা পুষ্টিকর খাবারে পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশের মাত্র ৪৩ শতাংশ পরিবার এ পুষ্টির চাহিদা পূরণ করছে বলে ধারণা করা হয়। এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুকে বয়স অনুযায়ী পুষ্টিকর খাবার দিতে না পারলে শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশসাধনসহ শারীরিক সুস্বাস্থ্যই নিশ্চিত করা যায় না, যা মানসিক স্বাস্থ্যের সহায়ক হয়।
একটা সময় ছিল ১টা ডিমের ৭০ শতাংশ ক্যালরি কেবল একজন শিশু গ্রহণ করত কিন্তু বর্তমানে ডিমের চড়া দামের ফলে দুই থেকে তিনজনে ভাগ করে খাচ্ছে। এতে পরিপূর্ণ পুষ্টি সমৃদ্ধ হচ্ছে না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশ্ব একটি জটিল বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের দিকে নিমজ্জিত হচ্ছে। ক্রমে এ পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে আর সে সঙ্গে মুদ্রা স্ফীতির ও জ্বালানি তেলের সংকটে ফলে খাদ্যপণ্যের দামও হুহু করে বাড়ছে। এদিকে এসব বিরূপ পরিস্থিতির জন্য কৃশকায় শিশুর সংখ্যা বাড়তে পারে এমন আশাঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে শুধু এগুলোই খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার মূল কারণ নয়। খাদ্য দ্রব্যের চড়া দামের জন্য আরো অন্যান্য বিষয় জড়িত রয়েছে। যেমন মুনাফা লোভী চিন্তা, সুষ্ঠু বাজার মনিটরিং অনুপস্থিতি, দেশপ্রেমের অভাব, অমানবিকতা, দূর্নীতির কালো থাবা, চাহিদার তুলনায় কম উৎপাদন, যা পুষ্টিকর খাবারে নতুন করে চাপ সৃষ্টি করছে।যার প্রেক্ষিতে নিম্ন ও সুবিধাবঞ্চিত পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের পুষ্টিকর খাদ্য জোগানের মূলে আঘাত করছে।
সচরাচর বাংলাদেশে খাদ্যে ভেজালের মতো জঘন্য কাজ এমনিতে অপুষ্টিতে ভূমিকা রাখছে তার ওপর খাদ্যদ্রব্যের চড়া দাম যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। খাদ্যের দ্রব্যের দামের উত্তাপে ৪৩ শতাংশ মানুষ পূর্বের তুলনায় খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে আর এর প্রভাব পড়ছে শিশুদের পুষ্টিহীনতায়। এমনকি বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া নিম্ন মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীরাও প্রয়োজনীয় নিউট্রিশন জাতীয় খাবার কম খেতে বাধ্য হচ্ছে উচ্চমূল্যের জন্য। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও এমন নাজুক অবস্থায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষ দ্রব্যের বেসামাল দামে দিশাহারা। আর এভাবে ক্রমাগত খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়তে থাকলে তাদের জীবনযাত্রার ধরন পরিবর্তন নয়—বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়বে।
আজকের শিশু আগামী দিনের কর্ণধার। আজকের শিশুরাই ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দিবে জাতিকে। কিন্তু এই শিশুরা যদি পরিপুষ্ট ভাবে গড়ে না উঠে কিংবা তারা নিজেদের যোগ্য হিসাবে গড়ে তুলতে না পারে তাহলে কখনো দেশ সমৃদ্ধশালী হবে না।পরিপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক শক্তিসহ তাদের বুদ্ধিমত্তা ও কর্মদক্ষতার অভাবে তারা পারবে না ভার্চুয়াল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলাতে পারবে বিশ্বের সঙ্গে সৃষ্টিশীল প্রতিযোগী হতে। পুষ্টিবিদদের মতে শারীরিক ও মানসিক শক্তির জন্য পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজন হয় বেশি। কিন্তু আমাদের দেশে জাতীয়ভাবে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবার তার জোগান দিতে পারে না। আর কেউ কেউ পারলেও অসচেতনতার জন্য অনেক সময় পূর্ণাঙ্গ পুষ্টি পাওয়া যায় না। তাই শিশুদের সবল করে তুলতে এবং আগামীর সঠিক নেতৃত্ব বিনির্মাণে খাদ্যসহ বিভিন্ন মৌলিক চাহিদাগুলো আমজনতার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের দেশে দ্রব্যের দাম বাড়ার বহু অজুহাত রয়েছে, যার প্রধান হলো বিশ্ববাজারের অস্থিরতা। বিশ্ববাজারে কোনো পণ্যের দাম বাড়তে না বাড়তেই তা ছড়িয়ে পড়ে দেশের বাজারে আর হুহু করে বাড়ে দ্রব্যের দাম। উৎপাদন কম, মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম গুদামজাতকরণের মাধ্যমে ও প্রশাসনের মহাঘর্ভাতা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা ছলচাতুরী করে দফায় দফায় দাম বাড়িয়ে এ দেশে গণদুশমনী চলে। আর এ দামের তুলনায় দফায় দফায় নিম্নআয়ের মানুষের আয় বাড়ে না। ফলে বাধ্য হয়ে তাদের খাদ্যগ্রহণে কৃচ্ছ্রতা সাধন করতে হয়। আর কৃচ্ছ্রতা করলে মানুষের ক্যালরিতে টান পড়ে। খেটে খাওয়া মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাস এবং চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে আমরা যে উন্নত জাতি গঠনের কথা বলি তা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই দেশের জন্য আগামী প্রজন্মকে সুষ্ঠু ও সঠিক পুষ্টি নিয়ে নির্বিঘ্নে বেড়ে উঠতে হবে। আর নতুন প্রজন্মকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে, অবশ্যই খাবারের মতো মৌলিক চাহিদাগুলো নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের সামর্থ্য অনুযায়ী সহজলভ্য করতে হবে অথবা মজুরিবৃদ্ধির মধ্যদিয়ে ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম