এহসান বিন মুজাহির

  ২৭ আগস্ট, ২০২২

কতকাল পিছিয়ে থাকবে চা শ্রমিকরা

ফাইল ছবি।

চা শ্রমিকরা এদেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী। আমাদের দেশের অর্থনীতিতে চা শিল্প বৃহৎ একটি শিল্প। দেশের চা শিল্পাঞ্চলের ১৬৭টি চা বাগান জাতীয় অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশের চা উৎপাদনের পরিমাণ বছরে প্রায় ৯৬.০৭ মিলিয়ন কেজি। এর মূল শক্তি চা শ্রমিক ও কর্মচারীরা। তাদের শ্রমেই এ শিল্পের মালিকদের বড় বড় অট্টালিকা আর অভিজাত জৌলুস গড়ে উঠেছে। পরিত্যক্ত জমি নিজের শ্রম ও ঘাম দিয়ে আবাদ করে মূল্যবান চা উৎপাদন করে যাচ্ছেন চা শ্রমিকরা। তাদের চা পৃথিবীর ২৫টি দেশে রপ্তানি করা হয়। কিন্তু চা শ্রমিকরা সব নাগরিক সুবিধা ভোগের অধিকার সমভাবে প্রাপ্য হলেও তারা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার। এখনও জীবনমানে পিছিয়ে চা-শ্রমিকরা। বর্তমানে দেশের সকল চা বাগানের শ্রমিকরা তাদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বর্ধিত করে ৩০০ টাকা করার দাবিতে লাগাতার আন্দোলন করে চলেছেন। চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বর্ধিত করে ১৪৫ টাকা করা হলেও তা মানেননি শ্রমিকরা। এ শিল্পে ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা দৈনিক মজুরি নির্ধারণ করা হলেও চা শ্রমিকরাই থাকবেন নিন্ম মজুরিপ্রাপ্ত।

এবার চা-বাগান শ্রমিকদের মুজরি বাড়ানোর আন্দোলন থেকে বোঝা গেলো তারা কত অবহেলিত ও বঞ্চিত। বাংলাদেশের অন্যান্য আর্থিক খাতে মজুরি চা-শ্রমিকদের আর্থিক মজুরির অন্তত তিনগুণ। সরকার গঠিত নিম্নতম মজুরি বোর্ড দেশের বিভিন্ন শিল্প খাতে কর্মরত শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করে থাকে। বর্তমানে দেশে ৩১টি শিল্পখাত এরমধ্যে সর্বনিন্ম মজুরি হলো চা শিল্পে। এ শিল্পে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি মাত্র ১২০ টাকা। এতো অল্প মজুরিতে আর কোন শিল্পে কর্মরত নেই কোন শ্রমিক। চা-শ্রমিকরা কী করে এত কম মজুরিতে কাজ করে পরিবার নিয়ে বেঁেচে আছেন? বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস ৫০ বছরের হলেও চা শ্রমিকদের শ্রমের ইতিহাস প্রায় ২০০ বছরের। বছরের পর বছর ধরে এসব চা বাগানে কর্মরত লক্ষাধিক চা শ্রমিক দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও এখনও তাদেরকে মজুরি বৈষম্যসহ নানা বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে। প্রায় দুইশ বছর ধরে চা শ্রমিকদের ঘামে শ্রমে প্রতি বছর চা উৎপাদনরে লক্ষ্য মাত্রা ছাড়িয়ে গেলেও তাদের ছেড়ে যায়নি দারিদ্রতা।

এখনও প্রতিদিন ১২০ টাকার মুজরি দিয়ে পরিবার নিয়ে তারা মানবেতর জীবন পরিচালনা করছেন। প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাগানে যারা কাজ করে তাদের অধিকাংশই নারী শ্রমিক। কিন্তু তাদের নিজস্ব ভূমি থেকে শুরু করে জীবন যাত্রার কাঙ্খিত কোন পরিবর্তন আজও হয়নি। স্বল্পমজুরি, ন্যুনতম স্বাস্থ্যসেবার অভাব, মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা, শিক্ষার অভাব অপুষ্টি আর রোগের শিকার চা-বাগানের নারী ও শিশুরা। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে কর্মরত চা শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার। এর মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ ভাগের উপরে নারী চা- শ্রমিক রয়েছেন। আর এই চা জনগোষ্টির সংখ্যা সাত লাখ। কর্মক্ষেত্রে নারীদের বড় সমস্যা হলো নারীদের প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে বিভিন্ন বাঁধার মুখে পড়তে হয়। একেকটি সেকশনে বৃষ্টির সময় ছাউনি থাকে না। ফলে বৃষ্টি গায়ে মেখেই কাজ করাতে গিয়ে ঠাণ্ডাজনিত নানা রোগে ভূগতে হয়। তারা যেটা চান সেটা হচ্ছে তাদের দৈনিক মজুরি বৃদ্ধি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময় এখন তারা যে টাকা পান সেটি দিয়ে না ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারেন, না নিজেরা ভালো কিছু খেতে পারেন।

২০১৯ সালে সিলেট অঞ্চলের চা-বাগানগুলোর স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম জরিপটি চালায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। এই জরিপে দেখা গেছে, অপুষ্টির কারণে চা-বাগানের ৪৫ শতাংশ শিশুই খর্বাকার, ২৭ শতাংশ শীর্ণকায়। স্বল্প ওজনের শিশু ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এই জরিপের তথ্য অনুযায়ী ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ৪৬ শতাংশ কিশোরীর, মা হয়ে যাচ্ছে ২২ শতাংশ। এ ছাড়া ন্যুনতম স্যানিটেশন-সুবিধা নেই চা-বাগানের ৬৭ শতাংশ পরিবারের। এর আগে ২০১৮ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) মৌলভীবাজারের চা-বাগানগুলোর নারীদের ওপর একটি গবেষণা চালায়। এতে দেখা যায়, প্রায় ১৫ শতাংশ নারী জরায়ু ক্যানসারে ভুগছেন। ভূমি অধিকার প্রদান এবং জীবন চলার উপযোগী করে বেতন বৃদ্ধি এখন চা শ্রমিকদের প্রধান দাবি। চা শ্রমিকের ইতিহাস থেকে জানা যায়, পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে চীন ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও চায়ের প্রচলন ছিল না।

১৮৫৪ সালে বাংলাদেশের সিলেটের মালনীছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সে সময় বৃহত্তর সিলেটে চা বাগান তৈরির জন্য ভারতের আসাম, উড়িষ্যা, বিহার, উত্তর প্রদেশ, ঝাড়খন্ড, উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু দরিদ্র আদিবাসীদেও ট্রেনে করে নিয়ে আসে সিলেট অঞ্চলে। এরপর তাদের নিয়ে শুরু হয় পাহাড়-জঙ্গল পরিষ্কার করে চা-গাছ রোপনসহ নানান কাজ। চা বাগান করতে গিয়ে হিংস্র প্রাণীর কবলে পড়ে কত শ্রমিকের জীবন গেছে তার কোনো হিসাব নেই। ভূমিসহ নানান সুযোগসুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের নিয়ে আসা হলেও বাস্তবে ঘটে ভিন্ন ঘটনা! বাগান শ্রমিকদের অত্যধিক খাটানো হতো, তাদের বাসস্থান নিম্নমানের এবং মজুরি ব্রিটিশ মালিকদের মুনাফার তুলনায় খুবই নগণ্য। ভূমি তো নয়-ই, সামান্য বাসস্থানের ব্যবস্থাটাও নিজেদের করে নিতে হয়। এছাড়া ব্রিটিশদের জুলুম তো ছিলই। তাদের অব্যাহত নির্যাতনের প্রতিবাদে তৎকালীন চা শ্রমিক নেতা পন্ডিত গঙ্গাচরণ দীক্ষিত ও পন্ডিত দেওসরণ ‘মুল্লুকে চল’ (দেশে চল) আন্দোলনের ডাক দেন। ১৯২১ সালের ২০ মে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার চা শ্রমিক সিলেট থেকে হেঁটে চাঁদপুর মেঘনা স্টিমার ঘাটে পৌঁছান। তারা জাহাজে চড়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইলে ব্রিটিশ সেনারা গুলি চালিয়ে শতশত চা শ্রমিককে হত্যা করে মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। যারা পালিয়ে এসেছিলেন তাদেরকেও আন্দোলন করার অপরাধে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এরপর থেকেই প্রতি বছর ২০ মে চা শ্রমিক দিবস হিসেবে দিনটি পালন করছেন চা শ্রমিকরা।

বর্তমান দ্রব্যমুল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে ৩০০ টাকা মজুরির দাবি কি অযৌক্তিক! চা-শ্রমিকেরা ৩০০ টাকা মজুরি দাবি করলেও মালিক পক্ষ শ্রমিকদের সাথে আলাপ আলোচনায় বসে হয়তো মজুরি বিষয়ে সমঝোতায় আসা যেতো। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরাসরি মালিকপক্ষ সমঝোতার বৈঠকে বসেননি। গণমাধ্যমে দেখেছি প্রশাসন এবং শ্রমিক নেতারা দফায় দফায় বসছেন, রাতে শ্রমিক নেতারা মেনে নেন, দিনে আবার করেন সাধারণ শ্রমিকেরা ধর্মঘট! প্রশাসন, মালিকপক্ষ এবং শ্রমিক নেতাদের কোনো আশ্বাসে চা শ্রমিকেরা বিশ্বাসী নয়। একাধিকবার শ্রম দপ্তর, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের উদ্যোগে শ্রমিকদের সাথে বৈঠক হলেও সকল বৈঠক কার্যত ব্যর্থতায় পর্যবেসিত হয়েছে। সাধারণ শ্রমিকদের দাবি তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে নতুন মজুরি নির্ধারণ হলেই বাগানের কাজে ফিরবেন। সাধারণ শ্রমিকেরাও প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার অপেক্ষার রয়েছেন। তাদের দাবি একমাত্র প্রধানমন্ত্রী সরাসরি মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণা দিলেই তারা রাজপথ ছাড়বে, নতুবা কর্মবিরতি অব্যাহত রাখবে, প্রয়োাজনে জীবন দেবে। চা শ্রমিকদের চলমান সংকট নিরসন থেকে দ্রুতই উত্তরণে প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি নির্দেশনা দিতে হবে।

মনে রাখতে হবে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাই প্রজাতন্ত্রের নাগরিক। এখানে কোনো জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করা চলবে না। চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীদের জীবন মানোন্নয়নে সরকারকেই বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। চা শ্রমিকদের প্রতি সদয় আচরণ ও তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হওয়া পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, সকলের দায়িত্ব। অবহেলিত ও অনগ্রসর এ জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, তাদের সামাজিক ন্যায় বিচার নিশ্চিতকরণ, পারিবারিক ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে সরকার এবং বাগান মালিকপক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : প্রিন্সিপাল, শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল, মৌলবীবাজার [email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কতকাল পিছিয়ে,চা-শ্রমিকরা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close