রেজাউল করিম খোকন

  ২৭ আগস্ট, ২০২২

অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় বিচক্ষণতা প্রয়োজন

প্রতীকী ছবি।

অর্থনীতির ওপরে চাপ বাড়ছে। আছে, অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির মধ্যে। ঘুরে দাঁড়াতে হলে ব্যবসা খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি ও রফতানি আয় বাড়াতে নানা উদ্ভাবনী ও টেকসই উপায় খুঁজে বের করতে হবে। বর্তমানে আমরা দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। কেউ কেউ মনে করেন, বৈদেশিক চাপের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটজনক পরিস্থিতি আমাদের চাপে ফেলেছে। কর-জিডিপি অনুপাত এখন মাত্র ৯ শতাংশের মতো। এটি যদি ১৪-১৫ শতাংশ হতো, তাহলে সরকারের আরও বেশি খরচ করার সামর্থ্য থাকত, যা অর্থনীতিকে একধরনের স্বস্তি দিত।

সরকারের নীতি প্রণয়নে একধরনের স্বচ্ছতা ও সমন্বয়ের অভাব আছে। বর্তমান পরিস্থিতির উত্তরণে দুই-তিন বছরের জন্য ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক অর্থনৈতিক নীতি সমঝোতা হলে দুই ধরনের উপকার হবে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থার কাছে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে দর-কষাকষি সহজ হবে। দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতে রাজনৈতিক উত্তাপপূর্ণ কর্মকাণ্ডের সময়ে অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সৃষ্ট এই নীতি সমঝোতা অর্থনীতিকে সুরক্ষা দেবে। সরকার অবশ্য কিছু কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে । যেমন, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, সরকারি ব্যয় সাশ্রয়, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহি আনা। এসব পদক্ষেপ প্রয়োজনীয় হলেও যথেষ্ট নয়। এসব উদ্যোগ বিচ্ছিন্ন, অসম্পূর্ণ, অপর্যাপ্ত এবং ধারাবাহিকতা নেই।

পিছিয়ে পড়া বিপন্ন মানুষই দুর্দশার সবচেয়ে বড় ভাগীদার। এ মুহূর্তে নিম্নমধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের জীবনমান রক্ষা করা বড় অর্থনৈতিক দায়িত্ব। সরকারের ঘোষিত ‘ফ্যামিলি কার্ড’ ব্যবস্থাকে দ্রুততার সঙ্গে ও দুর্নীতিমুক্তভাবে চালু করা দরকার। টিসিবির মাধ্যমে চালসহ অন্যান্য নিত্যপণ্য জেলা পর্যায়ে বিক্রি করা দরকার। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ও সংখ্যা বাড়াতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নানা ধরনের অসংগতি আছে। যেমন, উপযুক্ত লোকেরা এ সুবিধা পাচ্ছেন না। উপযুক্ত লোক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বৈষম্যমূলকভাবে বাছাই করা হয়। আবার যাঁদের সুবিধাভোগীর আওতায় আনা হয়, তাঁরা অপর্যাপ্ত বা কম ভাতা ও পণ্য পাচ্ছেন। কোভিডের পর যুব বেকারত্ব আরও প্রকট হয়েছে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছে। আইএমএফের কাছে ঋণ নেওয়া নিয়ে এক ধরনের আলোচনা-সমালোচনা আছে। আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার সময় এসেছে। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি- এসব ক্ষেত্রে এক ধরনের আর্থিক সমর্থন প্রয়োজন। বাংলাদেশ ৪৫০ কোটি ডলার চেয়েছে, সেটা যৌক্তিক। কারণ, আইএমএফের কাছে ঋণ নেওয়া শুধু টাকার জন্য নয়; সংস্কার ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার জন্যও দরকার। আইএমএফ সম্পর্কে তাঁদের মনেই আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, যাঁরা এত দিন অর্থনীতির উন্নয়নের উচ্ছ্বাস নিয়ে ছিলেন। এর ভেতরে যে কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো রয়ে গেছে, তা অস্বীকার করে গেছেন। আইএমএফ সৃষ্টিই করা হয়েছে এ ধরনের প্রতিকূল সময়ে সাহায্য করার জন্য। করোনা মহামারি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে এ বছরটি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য হতে পারত মাইলফলক। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে সংকটে রূপ দিল ছয় মাস অতিবাহিত হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের ওপর হামলা শুরু করে রাশিয়া। জ্বালানি ও কৃষিপণ্যে গুরুত্বপূর্ণ এই দুই দেশ। ফলে সে দিন থেকেই অস্থির হয়ে ওঠে বিশ্ববাজার। তেল-গ্যাস, খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়তে থাকে হু হু করে। যুদ্ধের কবলে পড়ে বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমেই খেই হারাতে শুরু করে। বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাসে বারবার কমাতে থাকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এখন আশা করছে, বিশ্ব প্রবৃদ্ধি হবে ৩.২ শতাংশ। যেখানে বছরের শুরুতে পূর্বাভাস ছিল প্রবৃদ্ধি আসবে প্রায় ৫ শতাংশ।

ওইসিডির হিসাবে বৈশ্বিক উৎপাদন ও বাণিজ্যের মাত্র ২ শতাংশ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। কিন্তু রাশিয়া হচ্ছে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কৃষিপণ্যের অন্যতম বৃহৎ রপ্তানিকারক দেশ। একইভাবে উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশ ইউক্রেনের খাদ্যশস্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ইউরোপের রুটির ঝুঁড়ি বলা হয় এ দেশটিকে। যুদ্ধের কারণে এসব পণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হয় এবং জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে চার দশকে সর্বোচ্চ হয়। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ঘন ঘন সুদের হার বাড়াতে থাকে, যা প্রকারান্তরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শ্লথ করে দেয়।যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ এ বছর চার দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। সুদের হার বাড়ানোয় শক্তিশালী হচ্ছে ডলার। এতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মুদ্রার ব্যাপক দরপতন হচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতি আরো অসহনীয় করে তুলছে। বিশ্বের উন্নত ও উদীয়মান বেশির ভাগ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু জুলাই মাসেই প্রায় এক হাজার ২০০ বেসিস পয়েন্ট সুদের হার বাড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতির এই ধারা থেকে এটা স্পষ্ট, বিশ্ব অর্থনীতি আবারও সংকোচনের দিকে এগোচ্ছে। বিশ্ব সম্ভবত একটি মন্দার প্রান্তে চলে এসেছে। সর্বশেষ মন্দার দুই বছর পরই আবার হোঁচট খেল অর্থনীতি।

জ্বালানি-সংকট নিয়ে ভয়ের মধ্যে আছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশি ব্যবসার প্রতিযোগিতা সক্ষমতার মূল উপাদান হচ্ছে জ্বালানি। বর্তমান জ্বালানি-সংকটে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য কীভাবে এগিয়ে যাবে, সেটিই বড় বিষয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই বড় চ্যালেঞ্জ। তবে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করতে সরকারের কার্যকর হাতিয়ার নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নীতি সুদহার বাড়ালেও বাংলাদেশ ব্যাংকের হাত-পা নয়-ছয় সুদহারে বাঁধা। অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় আরও বেশি বিচক্ষণতা প্রয়োজন। আমাদের দেশে অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় বৃত্তের বাইরে একধরনের চিন্তা করা হয়। বলা হয়, আমরা ব্যতিক্রম। কিছু ভিন্নতা থাকলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির বেসিক একই। আর আমরা তো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন নই। ফলে আমাদের বুঝতে হবে, কখন কোথায় কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে।

যত দিন ধরে ব্যবসার সহজ করার কথা বলা হচ্ছে , তত দিনে সহজ তো দূরে, ব্যবসা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে। গত বছর মার্চে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। তারপর জ্বালানির দামও বাড়ে। সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে। কাঁচামালের দাম শতভাগ বেড়েছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার পরও চলতি অর্থবছর উৎসে কর দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা আর চাপ নিতে পারছে না। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমলে দেশেও দাম সমন্বয় করা হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে । সবার একই কথা, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে আর আমাদের দেশে কেন বাড়ছে। কবে দাম সমন্বয় করা হবে। বিগত কয়েক মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬-৭ শতাংশ। চলতি মাসে ঠিকভাবে গণনা করলে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে উঠে যাবে। এটি ভয়ের কিছু নয়। যুক্তরাজ্যেও মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ১ শতাংশ। সমস্যা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি যখন দ্রুত সমন্বয় করতে হয়, তখন মজুরির ওপর চাপ পড়ে। মজুরি বাড়ানোর জন্য চা-বাগানের শ্রমিকেরা আন্দোলন করছেন। কাল হয়তো পোশাক শ্রমিকেরা নামবেন। পরশু হয়তো সরকারি কর্মচারীরা। একসঙ্গে সবাই নামলে বিপদ।

এটা হতে দেওয়া যাবে না। আগেই মজুরি সমন্বয় করতে হবে। সরকার সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। তবে চালের উৎপাদন কম হয়েছে। বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় আমনের উৎপাদন ভালো হবে না। বোরোতেও ক্ষতি হয়েছে। ফলে চালের দাম বাড়বে। বাজারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ, চাহিদার তুলনায় চালের ঘাটতি আছে। আমদানিও পর্যাপ্ত হয়নি। চালের দাম, মাছের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ সত্যিই কষ্টে আছেন। বাজারে এখন মোটা চালের কেজি ৫৫ টাকায় উঠেছে, যা এক মাস আগের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি।সবাই বলছেন, সাম্প্রতিক কালে এই দর সর্বোচ্চ।চালের বিকল্প খাদ্য আটার দামও এক মাসে বেড়েছে ২০ শতাংশ। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে মানুষ ব্যয় সাশ্রয়ের অংশ হিসেবে মাঝারি চাল থেকে সরে মোটা চাল কেনা শুরু করে।

চাল দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য। চালের দাম বাড়লে তা মূল্যস্ফীতির ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। এ কারণে এই পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা দেখা যায়। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ইশতেহারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। চালের দাম যে বাড়ার প্রবণতা শুরু হয়, তা আর কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে তা তেমন একটা কাজে লাগেনি। দাম বাড়তে বাড়তে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। টিসিবি এক কোটি পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে যে তিনটি পণ্য দেয় (ভোজ্যতেল, ডাল ও চিনি) তার সঙ্গে চালও যোগ হবে। আর বেসরকারিভাবে চাল আমদানি বাড়ানো হবে। এক কোটি দরিদ্র পরিবারের বাইরে আরও এক কোটি সীমিত আয়ের পরিবার দরিদ্র হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। সরকার যে সহায়তা দেয়, তা এই ঝুঁকিতে থাকা এক কোটি পরিবারের কাছে পৌঁছায় না। ঢাকায় চাল বিক্রির ট্রাকের পেছনে ভিড় বাড়ছেই। বাজারে চালের দাম অনেক বেশি। মোদ্দাকথা, বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় আরও বেশি বিচক্ষণতা প্রয়োজন। আমরা তো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন নই। ফলে আমাদের বুঝতে হবে, কখন কোথায় কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
অর্থনীতি,অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা,বিচক্ষণতা প্রয়োজন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close