মো. আরাফাত রহমান

  ২৪ আগস্ট, ২০২২

দেশের সিংহভাগ আমিষের উৎস মাছ

ফাইল ছবি।

বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে বিপুল পরিমাণ সামুদ্রিক সম্পদের অধিকারী। বাংলাদেশের প্রায় ৪১,০০০ বর্গমাইল অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে, যা দেশটির আয়তনের ৭৩ ভাগ। অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যাসম্পন্ন বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র ও উন্নয়নশীল দেশ। পূর্বে বাংলাদেশের মানুষ স্থলজ আমিষের উপর অধিক নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু শিল্পায়ন ও নগরায়নের ক্রমাগত প্রক্রিয়া সীমিত স্থল এলাকাই অধিগ্রহণ করে ফেলছে। তাই এখন বিস্তৃত বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রগর্ভে উৎপাদিত আমিষ ছাড়া চাহিদা পূরণের খুব বেশি উপায় অবশিষ্ট নেই। বাংলাদেশীদের খাবারের ৮০ শতাংশের বেশি আমিষ আসে মাছ থেকে।

পৃথিবীতে প্রায় ৩০-৪০ হাজার মাছের প্রজাতি পাওয়া যায়। বাংলাদেশে ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ এবং ২৬০ প্রজাতির স্বাদু পানির মাছ পাওয়া যায়। এছাড়াও ১২-এর অধিক প্রজাতির চাষকৃত বিদেশী মাছ চাষের জলাশয়ে এবং ৭০-এর অধিক জাতের বিদেশী বাহারী মাছ এ্যাকুয়ারিয়ামে পাওয়া যায়। আইইউসিএন (২০০৩) এর তথ্যানুসারে বাংলাদেশে স্বাদুপানির ৫৪ প্রজাতির মাছ হুমকির সম্মুখীন। এর মধ্যে ১২ প্রজাতির মাছ ভয়ঙ্কর বিপদাপন্ন এবং ২৮ প্রজাতির মাছ বিপদাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে চার শত প্রজাতির অধিক মাছ পাওয়া যায়। মাছের দিক দিয়ে বাংলাদেশ খুব সমৃদ্ধ।

মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশ সামনের কাতারে অবস্থান করছে। মাছে ভাতে বাঙালি তাই নদী মাতৃক বাংলাদেশের চিরাচরিত প্রবাদ। প্রায় চার শতের অধিক নদী, অসংখ্য খাল, বিল, হাওর, বাওর, ডোবা, নালার বাংলাদেশে পাওয়া যায় নানা রং ও স্বাদের মাছ। আকার আকৃতিতে এরা যেমন বিচিত্র, নামগুলোও তেমনি নান্দনিক। বৌরাণী, গুলশা, তপসে, চিতল, কাকিলা, কই, শিং, পাবদা আরও কত কি! অধিকাংশ বাণিজ্যিক মাৎস্যজীবীরাই তাঁদের কাজে অনেক বেশি দক্ষ ও উদ্ভাবনী। তাঁদের কিছু অংশ আবার ভোঁদড়ের সাহায্য নিয়ে থাকেন, যেগুলো পানির নিচে সাঁতার কেটে মৎস্যজীবীদের জালের অভিমুখে মাছ তাড়িয়ে নিয়ে এসে অনেকটা রাখালের মতো দায়িত্ব পালন করে থাকে। স্থানীয় চাহিদা পূরণে সাধারণত মিঠাপানির মাছই বেশি ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশে জনপ্রতি বাৎসরিক মাছ গ্রহণের পরিমাণ ২২.৫০ কেজি। ২০২০-২১ অর্থ বছরে মাছের উৎপাদন হয়েছে ৪৫ লাখ ৩ হাজার টন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের মাছের চাহিদার পরিমাণ দৈনিক মাথাপিছু ৬০ গ্রাম। বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের রক্ষিত বন্যপ্রাণীর তালিকার তফসিল ১ অনুযায়ী ২৫টি প্রজাতি এবং তফসিল ২ অনুযায়ী ২৭টি প্রজাতির, মোট ৫২ প্রজাতির মাছকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ আইন অনুসারে এই ৫২ প্রজাতির মাছ শিকার, বিক্রয় ও বিপণন বাংলাদেশের আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।

তফসিল ১ এ অন্তর্ভূক্ত প্রজাতিগুলো হল: পাখনামাথা হাতুড়ি হাঙ্গর, দক্ষিণি হাতুড়ি হাঙ্গর, মসৃণ হাতুড়ি হাঙ্গর, জেব্রা হাঙ্গর, বাদামিদাগি বাঁশ হাঙ্গর, মুইচিয়া হাঙ্গর, কানি হাঙ্গর, তিমি হাঙ্গর, চোখা হাঙ্গর, থুট্টি হাঙ্গর, কালা হাঙ্গর, রেশমি হাঙ্গর, চওড়ামুখি হাঙ্গর, থুটা হাঙ্গর, দাগিলেজ হাঙ্গর, বাঘা হাঙ্গর, গাঙ্গেয় হাঙ্গর, ফৌরি হাঙ্গর, চোখানাসা পীতম্বরী, দানব পীতম্বরী, সবুজ করাতি হাঙ্গর, লম্বাদন্তী করাতি হাঙ্গর, ছুরিদন্তী করাতি হাঙ্গর, দেশি বড় বাইন ও পাতি সমুদ্র ঘোড়া। তফসিল ২-এর মাছগুলো হল: তিলা শোল, লাল-পাখনা মহাশোল, সোনালী মহাশোল, ভাঙ্গন মাছ, নানদিনা, ঘোড়া মুইখা, দানব বাঘাইড়, চেনুয়া, কোঠা কুমিরের খিল, তেলোটাকি, তারা বাইম, নাপিত কই, নাফতানি, কুইচা, রিঠা, দেশি বোল, জয়া হিরালু, বাংলা রাণী, তিলা বিশতারা, গাঙ মাগুর, ধাইন, লম্বালেজি পদ্মমামনি, বেনেটের হাউশপাতা, নীলচিত্রা হাউশপাতা, চিত্রা শঙ্খচিল, দাগি শঙ্খচিল কাঁটালেজি ও দেওমাছ।

বঙ্গে স্বাদু পানির মৎস্য প্রজাতিসমূহের বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা শুরু হয় ১৮২২ সালে। সর্বশেষ বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ-এর ২৩ নং খন্ডে ১৭টি বর্গের অধীন ৬১টি পরিবারের ২৫১টি প্রজাতিকে স্বাদুপানির মাছ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাদুপানির মাছ প্রজাতিগুলো হল: দেশি চিতল, ফলি, নানচিল কোরাল, দেশি বড় বাইন, দেশি বামোশ, হলুদ কামিলা, দেশি কামিলা, পাতি কামিলা, লম্বা পাখনার সাপ বাইন, সুবর্ণা কাচকি, গণি চাপিলা, বড় চোখা, দেশি চৌকা ইলিশ, চন্দনা ইলিশ, সোনালী দাগি ওলুয়া, মেঘা ওলুয়া, দেশি সুইয়া, গাঙ্গেয় ফাসা, তেলি ফাসা, বাঁকা চোয়াল ফাসা, তিলা শোল, গজার, তেলোটাকি, টাকি, শোল, দেশি মলা, ফ্যাকাসে মলা, মোটামাথা কার্প, ছোট পিয়ালী, মোরারী, বর্ণ কোকসা, সাকু কোকসা, তিলা কোকসা, পাহাড়ি কোকসা, বাংলা এলং, কাতল, দেশি উর্তি, রূপালী কাচনি, দেশি লাউবুছা, মৃগেল কার্প, টাটকিনি, পাহাড়ি কালা বাটা, গোঁফালো নিপাতী, জেব্রা আঞ্জু, বড় ছেবলি, বাংলা ছেবলি, দেশি দাড়কিনা, পাথুরে ঘর পোয়া, চোষক ঘর পোয়া... সিলভার কার্প, ভাঙন বাটা, ঘনিয়া, কালিবাউশ, কাতল কুশি, গনি, নানদিনা, ঘোড়া মুইখা, কালো কার্প, কসুয়াতি, লোহাছুরা, থুইতা পুঁটি, চোলা পুঁটি, কাঞ্চন পুঁটি, গিলি পুঁটি, মলা পুঁটি, ফুটানি পুঁটি, সরপুঁটি, জাত পুঁটি, টেরি পুঁটি, তিত পুঁটি, দেশি বোল, পাতি ডারকিনা, গাঙ্গেয় ডারকিনা, রূপালী চেলা, নারকেলি চেলা, ফুল চেলা, ঘোড়া চেলা, সোনালী মহাশোল, লাল-পাখনা মহাশোল, বালিটোরা, নদী পাথুরে তিতারী, বালিচাটা, নদী বালিচাটা, গাং গুতুম, বিভানী বালিচাটা, করিকা বালিচাটা, বিজয়া দারি, বাংলা রাণী, ফুটকি রাণী, জালি রাণী, বর্মি পুঁইয়া, অনন্ডলের পুঁইয়া, মরিচা পুঁইয়া, লোকতাক পুঁইয়া, গোয়ালপাড়া পুঁইয়া, কলি পুঁইয়া, পাহাড়ি পুঁইয়া, লাল পিরানহা, পিরাপিটিংগা, তিস্তা টেংরা, বামন টেংরা, গাং টেংরা, কেরালা টেংরা, গুলসা টেংরা, কাবাশী টেংরা, নুনা টেংরা, বাজুরী টেংরা, এশীয় ডোরা টেংরা, গুরা টেংরা, তল্লা আইড়, গুজি আইড়...

বোয়ালী পাবদা, মধু পাবদা, কালা পাবদা, বোয়াল, কাজুলি, কাজলি, বাচা, মুড়ি বাচা, বাচুয়া বাচা, দেশি বাতাসী, ধাইন, থাই পাঙ্গাশ, দেশি পাঙ্গাশ, ছোট শিংঘী, গাঙ্গেয় বাঘাইর, দানব বাঘাইড়, দেশি জাংলা, গাঙ্গেয় জাংলা, ইউসুফের জাংলা, দেশি তেলচিটটা, সিলেটি তেলচিটটা, কেয়াকাঁটা টেংরা, কোশী কুতাকানতি, সিলেটি কুতাকানতি, কোশী টেংরা, চেনুয়া, বট টেংরা, গাঙ্গেয় কুতাকানতি, বাদামী কানি টেংরা, কালো কানি টেংরা, ধূসর-সাদা কানি টেংরা, শয়ের কানি টেংরা, মাগুর, ঝিল শিং, চাকা ভেকা, বট শিংঘী, গাং ঘাঘড়া, দাড়িহীন কাটাবুখা, সৈনিক আপুইয়া, গাঙ মাগুর, চোষক মুখী, নীল কানপোনা, মোহনার বেচী, কারা কুমিরের খিল, নল কুমিরের খিল, কোনা কুমিরের খিল, কোঠা কুমিরের খিল, কুইচা, বাংলা কুনচি, মুর বাইল্লা, দেশি ভেটকি, নামা চান্দা, কাঁটা চান্দা, লাল চান্দা, রাঙা চান্দা, কমলা পাখনা, টাক চান্দা, পাতি টাক চান্দা, খুতনী চান্দা, ভোতানাক টাক চান্দা...

আটলান্টিক তিনলেজা কই, রূপালী সাগর মেনী, সাদা দাতিনা, কইতর পোয়া, কই বোলা, তিলা বিশতারা, গাঙ্গেয় ভেদা, নাপিত কই, তেলাপিয়া, নাইলোটিকা, বাটা, চ্যাপ্টামাথা খরোল, খর খুলা, দেশি তপসে, ক্রান্তিয় বাইল্ল্যা, চেওয়া বেলে, বোডার্টের ডাহুক, সোনালিডোরা নুনা বাইলা, বড়মুখা বেলে, বড়চোখা বেলে, তীরকেশরী নুনা বাইলা, জলি চেওয়া, সাদা ফোঁটা ডাহুক, তীক্ষ্ন লেজা চেওয়া, হাঁটুনি দারাক, ফুটকি চিত্রা বাইলা, লাল চেওয়া, রাজা চেওয়া, হাঁসঠুঁটি বাইলা, কালো ফুটকি বাইলা, বাদামী ভুট বেলে, লুটিয়া গোবি, দেশি কই, কই বান্দি, বড় খইলশা, লাল খইলশা, নাফতানি, চুনা খইলশা, তারা বাইন, তারা বাইম, গুচি বাইম, শাল বাইম, বারা দৈত্য ছেরবাতি, লম্বা স্কেলী কুকুর জীব, বাংলা কুকুর জিব, লম্বা কুকুর জিব, আঙুলঠোঁটি কুকুর জিব, ডানচৌকা সারবটি, পানপাতা সরবতি, কাকিলা, একঠোঁটা, বাদামি-সবুজ একঠোঁটা, পাতি পটকা এবং গাঙ্গেয় পটকা।

বাংলাদেশের সংরক্ষিত মাছ বলতে বোঝানো হয় সে সব মাছকে বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। উক্ত আইনে মাছগুলো বাংলাদেশের ভূ-খন্ডে সংরক্ষিত বন্যপ্রাণী হিসেবে বিবেচিত হবে। সংরক্ষিত বন্যপ্রাণীর ক্ষেত্রে সকলকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কেননা উক্ত আইনের ৬ ধারা মোতাবেক এই প্রজাতির বন্যপ্রাণী শিকার বা বন্যপ্রাণীর অংশবিশেষ অথবা এসব হতে উৎপন্ন দ্রব্য দান, বিক্রয় বা কোনো প্রকারে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা অন্য কারো নিকট হস্তান্তর করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

উক্ত ধারা লঙ্ঘন করলে বিচারক্রমে ৩৯ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি এক বছরের কারাদন্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারেন। কোন ব্যক্তি একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে শাস্তির পরিমাণ দ্বিগুণ হবে। আরো উল্লেখ রয়েছে আইনের ৪১ ধারা ১/২ মোতাবেক যে কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোন অপরাধ সংঘটনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করলে বা উক্ত অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা প্রদান করে থাকলে এবং উক্ত সহায়তা বা প্ররোচনার ফলে অপরাধটি সংঘটিত হলে, উক্ত সহায়তাকারী বা প্ররোচনাকারী তাহার সহায়তা বা প্ররোচনা দ্বারা সংঘটিত অপরাধের জন্য নির্ধারিত দন্ডে দন্ডিত হবেন।

লেখক : সহকারি কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
দেশের সিংহভাগ,আমিষের উৎস মাছ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close