রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৩ আগস্ট, ২০২২

মধ্যপ্রাচ্যে বেইজিংয়ের বিনিয়োগ কৌশল 

ফাইল ছবি

বিশ্বের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মানদণ্ডে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে এরই মধ্যে চীন স্থান করে নিয়েছে এবং আমেরিকাকে পেছনে ফেলে স্থানটি দখলে রাখতে অব্যাহত চেষ্টা করে চলেছে। এজন্য অর্থনৈতিক বিকাশ ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে অর্থনীতির সব শাখায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করছে। বিশ্বের বাজারগুলো চীনের উৎপাদিত পণ্যের বাজারে পরিণত হয়েছে। আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে দেশটি অর্থনীতিতে আমেরিকাকে পেছনে ফেলে দেওয়ার লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে বলে ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন চীনা নেতা শি জিন পিং।

শুধু অর্থনীতিই নয়, ক্রমবর্ধমানভাবে সামরিক বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি, ন্যাভাল ফোর্সের জন্য উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন ইত্যাদি সংযোজন, নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করে সমরাস্ত্রের আধুনিকায়ন পারমাণবিক অস্ত্রের উৎপাদন, বিপণন, নিজেদের ভূখ-ের বাইরে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ গ্রহণে সক্ষম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। চীনের মূল লক্ষ্য হলো একুশ শতকের বিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ, বিশ্বে রাজনৈতিক নীতি-নির্ধারণী ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব প্রদানের জন্য দেশকে উপযোগী করে তোলা। অর্থাৎ একুশ শতকের গেম অব গ্রেট পাওয়ারস প্রতিযোগিতার জন্য সক্ষমতা অর্জন করে আমেরিকাকে টপকে বিশ্ব রঙ্গমঞ্চের শীর্ষ নেতৃত্বের স্থান অলংকৃত করাই হলো চীনের চূড়ান্ত লক্ষ্য।

ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাত নিরসনে চীন এখন অনেক বেশি সোচ্চার হয়ে উঠেছে। বেইজিং বিনিয়োগ কৌশল পাল্টে সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করেছে। চীনের ‘শতাব্দীর প্রকল্পে’ বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে। এক দশকেরও কম সময় আগে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) ঘোষণা করেছিলেন। সমুদ্র ও সড়কপথে চীনের সঙ্গে ইউরোপ ও এশিয়াকে বাণিজ্য সূত্রে গাঁথার প্রকল্প বিআরআই। চীনের আনুষ্ঠানিক ভাষ্য হলো, বিআরআই বেইজিংয়ের সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির সরাসরি সংযোগ।

এখন বেইজিং বিনিয়োগ কৌশল পাল্টে সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করেছে। অনেক সমালোচকের যুক্তি হলো, বিআরআই হলো ভিন্ন নামে ঋণফাঁদ। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয় এই যুক্তির পক্ষে আরো শক্ত ভিত্তি জুগিয়েছে। তবে এ ধরনের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বিআরআইয়ের বৃহত্তর যে ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য, সেটা ধরতে ব্যর্থ হয়। বিশ্বের অন্যান্য ধনী দেশের মতো চীনও আগ্রাসী ঋণ দিতে আগ্রহী। বিশ্ব অর্থনীতি এভাবেই কাজ করে। আরো কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, বিআরআই প্রকল্প কীভাবে চীনের ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের বাহন হিসেবে কাজ করে এবং কীভাবে সেটা মধ্যপ্রাচ্যের দিকে পথ বদল ঘটছে। বৈশ্বিক তেলবাণিজ্যের ক্ষেত্রে ডলারের যে আধিপত্য, তাতে করে চীন তার সেই লক্ষ্য পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ কারণেই চীন সৌদি আরামকোর বড় অংশের শেয়ার কিনতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয়নি। মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নোঙর গুটিয়ে নেওয়ার এই মূল্যবান সময়ে বিআরআই প্রকল্পে বিনিয়োগ করার অর্থ হলো- চীন তার লক্ষ্য অর্জনে এক ধাপ এগিয়ে গেল।

উপসাগরীয় দেশগুলোর প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান ও মিসরের মতো মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো বিআরআই। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীন মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে উপসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরো আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। সৌদি আরবের রাষ্ট্র মালিকানাধীন তেল কোম্পানি সৌদি অ্যারামকো শেয়ার বিক্রির উদ্যোগ নিলে চীনের বিনিয়োগকারীরা বড় অংশের শেয়ার কিনতে উঠেপড়ে লেগেছিল। বিআরআই প্রকল্পের মাধ্যমে চীন সম্প্রতি সৌদি আরবে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে।

অন্যান্য দেশের মতো রাশিয়ায় তাদের বিনিয়োগ কমেছে। দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বিআরআই প্রকল্প থেকে গত মাসে রাশিয়ায় এক টাকাও বিনিয়োগ করা হয়নি। ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে রাশিয়ার সঙ্গে নতুন কোনো চুক্তিও হয়নি। একই সময়ে সৌদি আরবে ৫৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগের চুক্তি করেছে বেইজিং। এই চুক্তিগুলোর পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়ে অস্পষ্টতা আছে। কেননা অনেক কিছুই জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, এর অনেকগুলোই জ্বালানি খাতে। এ থেকে স্পষ্ট হচ্ছে, চীন কীভাবে বিআরআইকে মধ্যপ্রাচ্যে তার দীর্ঘমেয়াদি উচ্চাকাক্সক্ষা পূরণের কাজে ব্যবহার করছে। রাশিয়া থেকে দ্রুত সরে আসা এবং মধ্যপ্রাচ্যের দিকে মনোযোগ দেওয়ার এ ঘটনা বিআরআই প্রকল্পের নমনীয়তাকে সামনে নিয়ে আসে।

এখন ইউক্রেন সংঘাতের কারণে রাশিয়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবলে। আবার সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উষ্ণ ও শীতল ধরনের। এ অবস্থায় নিজেদের অবস্থান সংহত করার জন্য বেইজিং বিআরআই তহবিলের অর্থ মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ে যাচ্ছে। বিআরআইকে চীনের সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির সংযোগ তৈরির প্রকল্প হিসেবে দেখার পরিবর্তে এটিকে বাকি বিশ্বে চীনের ভূরাজনৈতিক আকাক্সক্ষার বিনিয়োগ হিসেবে দেখা প্রয়োজন। ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে নিজেদের স্বার্থ অনেকটাই গুটিয়ে নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাম্প্রতিক সৌদি আরব সফরে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ যে খুব প্রবল নয়, সে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈশ্বিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শক্ত করে পা রাখার চেষ্টা বহুদিন ধরেই করে আসছে চীন।

যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে বিশ্বে এক নম্বর শক্তি হতে চায় চীন- বেইজিংয়ের এই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয়। বিআরআই প্রকল্পের অর্থায়ন কোথায় যাচ্ছে, সেটা চীন কী করতে যাচ্ছে সেটা বোঝার একটা সূত্র। এমনকি রাশিয়া ও চীনের মতো দেশের সঙ্গে সৌদি আরবের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক তৎপরতার দিকে খেয়াল করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। মজার ব্যাপার হলো, বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়া ও চীন দুই দেশের পরিচিতিই সৌদি স্বার্থের বিরোধী পক্ষ হিসেবে। মধ্যপ্রাচ্যের জটিল সমীকরণের কারণে সেই দুই দেশ দৃশ্যত কোনো পক্ষের সঙ্গে পুরোমাত্রায় তিক্ততা রাখতে চায় না। স্বভাবতই সৌদিবিরোধী শক্তিগুলো এ ব্যাপারে আরো নেতিবাচক হয়ে উঠতে পারে।

উপরন্তু আরব দেশগুলোর বর্তমান সংকটের জন্য চীনা মিত্রদের অনেকে দায়ী করে সৌদিকেই। সৌদি আরবের বিরোধী পক্ষ প্রকাশ্যেই অঙুলি নির্দেশ করছে, সৌদি সামরিক জোটে যেসব দেশ রয়েছে, তাদের অনেকের বিরুদ্ধে আইএস লালনের অভিযোগ আছে। তারা শিয়া-সুন্নি বিভাজনে ভূমিকা রেখেছে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধে তাদের ভূমিকা স্পষ্ট ছিল না। মার্কিনদের ফিলিস্তিন বিরোধী ভূমিকায় সৌদি আরবকে নীরব থাকতে দেখা গেছে। সৌদি-ইসরায়েল যোগাযোগ এখন স্বাভাবিক কূটনীতিতে পরিণত হয়েছে। এ রকম একটি জটিল আবহে সৌদি আরবের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতিতে চীন সামরিকভাবে জড়িয়ে পড়তে চলেছে। কে জানে, এই সিদ্ধান্ত আরব বিশ্বের ভুল রাজনীতির সঙ্গে চীনের ভবিষ্যৎকে যুক্ত করে ফেলবে কি না।

এরই মধ্যে চীনা অর্থনৈতিক সহযোগিতায় মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। চীন মধ্যপ্রাচ্যের কমপক্ষে পাঁচটা রাষ্ট্রের সঙ্গে কম্প্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ (সিএসপি) বা বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ২০১৫ সালে ইরাক, ২০১৬ সালে সৌদি আরব এবং ২০১৮ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল চীন। সর্বশেষ ইরানের সঙ্গে অনুরূপ কৌশলগত অংশীদারত্ব চুক্তি সই করেছে গত মাসে। ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চীনের এ চুক্তি চীন-ইরান সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ইরানী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাইয়েদ খাতিবজাদেহ-চীন ও ইরানের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদি স্বাক্ষরিত এ চুক্তিকে, পরবর্তী কোয়ার্টার শতাব্দীর জন্য উভয় রাষ্ট্রের সম্পর্কের ‘পূর্ণাঙ্গ রোড ম্যাপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারত্ব-হলো একটা সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিদেশ নীতির হাতিয়ার। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সুরক্ষা সহযোগিতার জন্য রোড ম্যাপ চুক্তি স্বাক্ষর করে চীন এটা নিশ্চিত করতে চেয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়াবে না বা অনুরূপ কোনো বিরোধে উসকানি দেবে না। মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা চীনের অর্থনৈতিক বাণিজ্যের জন্য অপরিহার্য এ কারণে যে, চীনের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য তেলের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চীন প্রতিদিন হরমুজ প্রণালি দিয়ে তিন মিলিয়ন ব্যারেল তেল আমদানি করে থাকে। কাজেই মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের জন্য হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে চীনা অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে পড়বে। এ চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে চীন-ইরানের মধ্যেকার বন্ধুত্বের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ট হবে এবং এতে করে উভয় রাষ্ট্রের বিরাজমান বাণিজ্যের জটিলতা নিরসন হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হলো বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

অন্যদিকে, তেহরানভিত্তিক সাংবাদিক ও ইরান বিষয়ক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফাতিমা করিম খান ওই চুক্তিকে গেম চেঞ্জার হিসেবে দেখছেন না। তবে চীনকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের আরো স্থিতিশীল পথ খুঁজে পাওয়ার পথে প্রথম পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম একটা পথ হিসেবে দেখছেন।’ তার মতে, ‘চীন ট্রেনটায় পা রাখার অপেক্ষায় রয়েছে এবং এতে অনেক আশাবাদ অত্রাঞ্চলে আমেরিকার প্রতিস্থাপন বা বিকল্প হিসেবে চীনের উত্থান ঘটবে। এ অঞ্চলে আরো বৃহত্তর ভূমিকা পালন সম্পর্কে তাদের ভবিষ্যতের রাজনৈতিক স্বার্থের ইঙ্গিত দিয়ে চীনা কর্মকর্তারা সম্প্রতি বলেছেন, ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যেকার বিরোধ মীমাংসায় সরাসরি আলোচনায় চীন মধ্যস্থতা করবে। মস্কোভিত্তিক ইউরেশিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক এসরাফ ইয়ালিন কিছিলির মতে, আমেরিকান শক্তির অব্যাহত উপস্থিতি প্রতিহত করার জন্য চীন উদীয়মান শক্তি হিসেবে ‘ইরান ও রাশিয়া’ উভয়ের সঙ্গেই কৌশলগত জোট গড়ে তুলতে চায়।’ আর, এভাবেই চীন আগামী আন্তর্জাতিক বিশ্বের নেতৃত্বের আসন অলংকৃত করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার কাজটা সম্পন্ন করে চলেছে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট [email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বিনিয়োগ কৌশল,মধ্যপ্রাচ্য
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close