মোহাম্মদ মারুফ মজুমদার

  ২৩ আগস্ট, ২০২২

দেশীয় অর্থনীতিতে বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব

ফাইল ছবি

একুশ শতকের তৃতীয় দশক তথা ২০২২ সাল সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে ঘটনাবহুল ও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কেননা, এ বছরটির বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে পৃথিবী এক নব্য শীতল লড়াইয়ের বহুপক্ষীয় মেরূকরণের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে, তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে চীনের কথা। সম্প্রতি মার্কিন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরকে কেন্দ্র করে বিষয়টা আরেকটু জটিল হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। স্বভাবতই, বৈশ্বিক রাজনীতির হালচাল প্রতিনিয়তই পরিবর্তনীয় ও সম্ভাবনাময় হওয়ার ফলে অগ্রিম সমাধান দেওয়া বেসম্ভব। তবে এক্ষেত্রে চীনের কাক্সিক্ষত বিআরআইয়ের বিপরীতে কোয়াড এবং অকাসের কার্যকারিতা যে যোজন হারে ব্যস্তাণুপাতিক হবে তা বলাই বাহুল্য। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে পররাষ্ট্রনীতি অনুসারে দুই পরাশক্তির সঙ্গে সমানুপাতিক তথা ভারসাম্য সম্পর্ক বজায় রাখা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে তা বলা মুশকিল।

চলমান ইউক্রেন সংকটকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন-রাশিয়া তথাকথিত প্রক্সিযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে তার শেষ হবে কবে? তা নিয়ে বিশ্লেষণের অন্ত নেই। অনেকে একে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামে আখ্যায়িত করছেন। এক্ষেত্রে উভয় সংকটে রয়েছে চীন; সেক্ষেত্রে কৌশলগত উপায় অবলম্বন করাই উত্তম হবে। যুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে সমর্থনের ক্ষেত্রে বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো বাংলাদেশকেও নীরব ভূমিকা পালন করা উচিত। কেননা, তদানীন্তন ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়াকে দখল করেই যে যুদ্ধের আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে তা ন্যাটো সম্প্রসারণশীল ও ইউরোপে প্রভাব বিস্তার করার উদ্দেশ্য নিয়ে আগানো পশ্চিমাদের অনেক আগে বোঝা উচিত ছিল। পুতিনের দাবার শেষ চালে হয়তো প্রতিপক্ষকে এক মহাসংকটে ফেলার সম্ভাবনাই বেশি; যার উত্তরণকল্পে দক্ষ কূটনীতিক চাল ছাড়া আশু সমাধান সম্ভব নয়। নয়তো, যেভাবে এই যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে তাতে এটি একটি সর্বব্যাপী লড়াইয়ে রূপ নিতে পারে। যা হতে পারে এক অনিশ্চিত যুদ্ধযাত্রা। মনে রাখা জরুরি, এ যুদ্ধের যদিও শেষ হয়; তার রেশ বহন করতে হবে পরবর্তী বিশ্বকে। এতে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হবে উন্নয়নশীল দেশগুলো।

কথায় আছে, যুদ্ধে জড়ানোর ভালো সময় বলতে আদতে কিছু নেই বিষয়টি মূলত সম্ভাব্য পরিবেশ-পরিস্থিতি ও জাতীয় স্বার্থের দিক বিবেচনাকল্পের সিদ্ধান্ত। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপট যে একেবারেই বৈরী, সে কথা বলতে দ্বিধা নেই। দীর্ঘ দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজত্ব করা অতিমারির করালগ্রাস থেকে বৈশ্বিক অর্থনীতির সচল রূপ ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে চলমান ইউক্রেন সংকট। কোভিডকালীন উৎপাদন-বিপণনব্যবস্থা, অগণিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ায় বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাবের দরুন জাতীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ দেশগুলোর আগের রূপে ফিরিয়ে আনতে নিত্য খাবি খাচ্ছে। প্রাকৃতিক এই সংকট কাটিয়ে বিশ্ব যখন মন্থরগতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঠিক এমন সময় ইউক্রেন সংকট গতিকে যোজন হারে কমিয়ে দেয়। প্রশ্ন জাগতে পারে কীভাবে?

জেনে রাখা ভালো, বিশ্ব অর্থনীতিতে রাশিয়ার অবদান মাত্র ৬ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও চলমান সংকটে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অবশ্যই বিরূপ প্রভাব ফেলবে। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, ১৯৭৩ সালে যখন বিশ্বজুড়ে ‘তেল সংকট’ দেখা দেয় তখন বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যের অবদান রাশিয়ার চেয়ে কম ছিল। তবু তেল সংকটের এক ভয়াবহ নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয়। কেননা জ্বালানির জন্য অল্প কিছু তেল, গ্যাস রপ্তানিকারক দেশের ওপর বিশ্ব নির্ভরশীল। আর এটাই হচ্ছে, বৈশ্বিক রাজনীতিতে রাশিয়ার প্রধান দাবার ঘুঁটি। দেশটির গ্যাস ও জ্বালানি তেলের মজুদ এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ পৃথিবীর প্রায়ই সব দেশে তাদের সরবরাহে রাশিয়াই একমাত্র তা বললে ভুল হবে না। এ অবস্থায় ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার সৃষ্ট সমস্যায় জন্য রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধের দরুন নব্য মানবসৃষ্ট সংকট তৈরি হওয়ার পাশাপাশি বৈশ্বিক অর্থনীতির সাপ্লাই চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যার বেশিরভাগ ভুক্তভোগী হচ্ছে আমদানিনির্ভর তথা উন্নয়নশীল দেশগুলো। কেননা, ইউক্রেন সংকট এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ফলে তার মিত্র দেশগুলোর একই আচরণ, সুইফট সিস্টেম থেকে রাশিয়াকে বাদ দেওয়া, রাশিয়ার জ্বালানি সরবরাহের পথ বন্ধ ইত্যাদির ফলে বৈশ্বিক বাজারে মুদ্রার দরপতন যেখানে অনাকাক্সিক্ষত হারে ডলারে আকস্মিক মান বৃদ্ধির কারণে আমদানিনির্ভর দেশগুলোর অর্থনৈতিক ব্যয় সংকোচন হওয়ার বেগতিক মানবসৃষ্ট সমস্যা তৈরি হতে বাকি আর রইল কই।

এছাড়া ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ০.৭ শতাংশ মুনাফা বৃদ্ধি করায় ডলারের মজুদ বাড়ছে এবং বাজারে ডলার সংকট চলছে। ফলস্বরূপ, ডলারের বিপরীতে অন্যান্য মুদ্রার দরপতন হয়েছে। ফিনপ্রসো ডট কোরের তথ্য মতে, ইউরোতে দরপতন ১৩.৬৯ শতাংশ, রাশিয়ার রুবলে ৩৫ শতাংশ, পাকিস্তানি রুপিতে ২০.৭৪ শতাংশ, ব্রিটিশ পাউন্ডে ১২.২৪ শতাংশ, জাপানি ইয়েনে ১৫.৪৪ শতাংশ, চীনা ইউয়ান ৪.৯৮ শতাংশ, ভারতীয় রুপিতে ৬.১১ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশের টাকা এখনো ৩.৬৫ শতাংশ নিয়ে মোটামুটি একটা অবস্থানে আছে। মোটামুটি থাকার কারণ হলো আমাদের রিজার্ভ জনসংখ্যা অনুপাতে খুবই অপ্রতুল। দরপতন হলে ফল কী? মুদ্রাস্ফীতিই হবে সমাধান, যা এই মুহূর্তে ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করবে। সবাই আমদানিতে সংকুচিত হবে। ফলে আমাদের রপ্তানিও কমবে। সৃষ্ট এই সংকট বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব খাটাবে? ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ার দূরত্ব প্রায় ৪ হাজার ৩০০ কিলোমিটার আর ইউক্রেনের প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার। এ সত্ত্বেও পূর্ব ইউরোপীয় এই দুই দেশের দ্বন্দ্ব বাংলাদেশের বাজারে তেল, গমসহ অন্যান্য অনেক খাদ্যশস্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখন একটি ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধে’ রূপলাভ করেছে। যার প্রভাব এসে পড়তে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। চীন, আমেরিকা, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে পরিমাণ আমদানি-রপ্তানি হয় তার দশ ভাগের এক ভাগ হয় রাশিয়ার সঙ্গে আর ইউক্রেনের সঙ্গে নেই বললেই চলে। অঙ্কের বিচারে ইউক্রেন যুদ্ধ খুব একটা প্রভাব না ফেললেও প্রকৃত অর্থে বাস্তব প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। কেননা এ যুদ্ধে বাংলাদেশের জিডিপি, রপ্তানি আয় হ্রাস, খাদ্যদ্রব্য ও জ্বালানির দামের পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতি অনেকাংশে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিষয়টা আরেকটু স্পষ্ট করে বললে, রাশিয়া সমগ্র পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ গম ও তুলা সরবরাহ করে থাকে। তেলের ক্ষেত্রে সারা দুনিয়ায় ব্যবহৃত প্রতি ১০ ব্যারেল তেলের এক ব্যারেল উৎপাদিত হয় এবং জ্বালানি তেল উৎপাদনে তৃতীয় বৃহত্তম।

যদি তেল, গ্যাস ও জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয় তাহলে ইউরোপের বড় একটি অংশ অচল হয়ে যাবে। কেননা, যুদ্ধ পূর্ববর্তী নর্ড স্ট্রিম-১-এর পর, নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইন নির্মাণের পথে হাঁটছিল রাশিয়া ও জার্মানি। নতুন এই প্রকল্প চালু হলে ইউরোপে যেমন রাশিয়ার গ্যাসের আমদানি বাড়বে তদ্রƒপ জ্বালানির ক্ষেত্রে মস্কোর ওপর আরো নির্ভরশীল হয়ে পড়বে এ অঞ্চল। তবে রাশিয়া-ইউক্রেনে হামলা চালালে এই প্রকল্প আর সামনের দিকে এগোবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে বার্লিন। জ্বালানি ব্যবহারে মারাত্মক সংকটে পড়বে সমগ্র ইউরোপ। জানা জরুরি, অর্থনীতির বিরূপ প্রভাব অনেকটা বাটার ফ্লাই ইফেক্টের মতো যা পৃথিবীর একপ্রান্তে ক্ষতিগ্রস্ত হলে পৃথিবীর সমগ্র দেশ তাতে আক্রান্ত হয়। রাশিয়ার সঙ্গে আমদানিনির্ভর অন্যসব দেশের তুলনায় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বাংলাদেশ অনেকখানি এগিয়ে থাকার ফলে যে পরিমাণ সার, গম, খাদ্যশস্য আমদানি করে, তদ্রƒপ বাংলাদেশও তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। কিন্তু বর্ণিত সংকটের কারণে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে বিশাল এক ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

এছাড়াও, সৃষ্ট ইউক্রেন সংকটের ফলে যে রাশিয়া বিভিন্ন দিক থেকে যে নিষেধাজ্ঞা পেল, তাতে বাংলাদেশের ওপর কতটুকু প্রভাব পড়বে? ইউরোপে বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতের অর্ধেকের বেশি বা ৬৪ শতাংশ তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে, ইউরোপে ব্যবহৃত প্রতি তিনটা ডেনিম বা জিন্সের পোশাকের একটি তৈরি হয় বাংলাদেশে। সৃষ্ট ইউক্রেন সংকটের বেগতিক রাশিয়া ইউরোপে তেল, গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করে দেয় তবে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে মন্দাভাব আসার আশঙ্কা বহন করছে। এতে করে তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে এবং কমে যাবে বাংলাদেশে তাদের দেওয়া নতুন অর্ডারের পোশাকের মূল্য এবং সংখ্যা। ফলস্বরূপ, যতখানি ধস নামতে পারে গার্মেন্ট শিল্পে বরং দ্বিগুণ বিরূপ প্রভাব পড়বে দেশীয় অর্থনীতিতে। বর্ণিত পরিস্থিতিতে মুদ্রার দরপতনে গম, খাদ্য শস্য, প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করা জটিল হওয়ার পাশাপাশি রপ্তানি শিল্পের প্রধানতম উৎস পোশাক যার অন্যতম বাজার ইউরোপীয় দেশগুলোতে রপ্তানির কিয়দংশ ভাটা পড়ার সম্ভাবনা বেশি। এক্ষেত্রে সরকারের নি¤েœাক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে সম্ভাব্য সমাধান। যথা প্রথমত, দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদদের নিয়ে একটি পরিষদ গঠন করা। এক্ষেত্রে ভর্তুকি, বাজেট সংশোধন, ব্যয় সংকোচন, ঋণ পরিশোধ ও গ্রহণ সম্পর্কিত সবকিছুরই একটা ভালো পরিকল্পনা গ্রহণ করা যাবে। দ্বিতীয়ত, মুদ্রা পাচার রোধে প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তৃতীয়ত, দেশের ১৮০০টি প্রকল্পের মধ্যে যেগুলোতে গুড রিটার্ন আসবে তার তালিকা করে বাকিগুলো বন্ধ রাখা। চতুর্থত, জনগণের জন্য সরকার কর্তৃক ভর্তুকির ক্ষেত্রে ভারসাম্য নীতি গ্রহণ করা। পঞ্চমত, রাজস্ব কর আদায়ে সচেতন হতে হবে যা থেকে বড় বড় রাঘ বোয়ালরা যাতে বেরিয়ে না যায়।

মনে রাখতে হবে, দেশের এই ক্রান্তিকালে মন্থর অর্থনীতিকে গতিশীল করার অভিপ্রায়ে সময় থাকতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না গ্রহণ করলে অদূর ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না। সর্বোপরি, সময় থাকতে সাধন করতে হবে; নয়তো অর্থনীতির এই দুষ্ট চক্রের দুর্বিপাকে পড়ে নিত্য খাবি খাওয়া থেকে বেড়িয়ে আসার আর কোনো পথ খোলা থাকবে না।

লেখক : শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
অর্থনীতি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close