ডা. আওরঙ্গজেব আরু

  ১৪ আগস্ট, ২০২২

শোক এখন জনতার শক্তি ও জাগরণের উৎসবিন্দু 

ডা. আওরঙ্গজেব আরু। ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

‘এসেছে কান্নার দিন, কাঁদো বাঙালি কাঁদো/জানি, দীর্ঘদিন কান্নার অধিকারহীন ছিলে তুমি/হে ভাগ্যাহত বাংলার মানুষ, আমি জানি/একুশ বছর তুমি কাঁদতে পারোনি। আজ কাঁদো/আজ প্রাণ ভরে কাঁদো, এসেছে কান্নার দিন/দীর্ঘ দুই-দশকের জমানো শোকের ঋণ/আজ শোধ করো অনন্ত ক্রন্দনে’। কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর কবিতায় এভাবেই বলেছেন শোকাবহ আগস্টের কথা। রক্তের অক্ষরে লেখা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। বাংলাদেশ ও বাঙালির জন্য গভীর মর্মস্পর্শী শোকের দিন। মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের কালিমালিপ্ত বেদনাবিধূর শোকের দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির মুক্তির মহানায়ক, চিরন্তন প্রেরণার উৎস, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ হত্যা করা হয়। সেদিনের সেই শোক হয়ে গেছে চিরদিনের। সেই শোক জেগে আছে রক্তরাঙা ওই পতাকায়, সেই শোক অনির্বাণ এখনো বাংলায়। নদীর স্রোতের মতো চির বহমান এই শোকপ্রবাহ। ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এই হত্যাকাণ্ডে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী, মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র সহদোর শেখ আবু নাসের, জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, দ্বিতীয় পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র নিষ্পাপ শিশু শেখ রাসেল, নবপরিণীতা পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণি, স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক ও জাতির পিতার ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছোটো মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, দৌহিত্র সুকান্ত আব্দুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আব্দুল নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ ও কর্তব্যরত আরো কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী নৃশংসভাবে নিহত হন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতীক। তিনি বাংলার মাটি ও মানুষের পরম আত্মীয়, শত বছরের ঘোর নিশীথিনীর তিমির বিদারী অরুণ, ইতিহাসের বিস্ময়কর নেতৃত্বের কালজয়ী স্রষ্টা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খুনিরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে ঘৃণ্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। দীর্ঘ ২১ বছর বাঙালি জাতি বিচারহীনতার কলঙ্কের বোঝা বহন করতে বাধ্য হয়। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকার বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে নিয়মতান্ত্রিক বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২০১০ সালে ঘাতকদের ফাঁসির রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই’। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সব ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েও ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করেন। জাতির পিতা চেয়েছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে জয় করে বিশ্বসভায় একটি মর্যাদাবান ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। সারাবিশ্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল।

একটি অবহেলিত ভূখণ্ডের ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে দীর্ঘ ২৩ বছর লাগাতার আন্দোলন-সংগ্রাম করে ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতা অর্জন করার মতো নেতা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই বিরল নেতা। শেখ মুজিব প্রজাপ্রেমী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। যে মানুষটি কখনোই বাঙালিকে অবিশ্বাস করেননি, বাঙালি তার বিরুদ্ধাচরণ করতে পারে স্বপ্নেও ভাবেননি, সেই শুদ্ধ চিত্তের জননেতাকেই কতিপয় স্বার্থপর-ঘাতক বাঙালি সপরিবারে হত্যা করেছে যা শুধু বাঙালির ইতিহাসেই নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও একটি কলঙ্কজনক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। আগস্টের এই বেদনার দিনে ধিক্কার জানাই সেইসব ঘৃণ্য নরপশুদের, যারা বাঙালি জাতিকে কলঙ্কিত করেছে।

ঘাতক দল ভেবেছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে তাঁর নাম ইতিহাস থেকে চিরতরে মুছে ফেলবে। কিন্তু তাদের সে স্বপ্ন সফল হয়নি। যে বাড়িতে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য-সহ শাহাদাৎ বরণ করেছিলেন, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের সেই বাড়িটি এখন জাতির অন্যতম আবেগময় স্মৃতিচিহ্নে পরিণত হয়েছে। আর তিনি বাঙালি জাতির অফুরন্ত প্রেরণা হয়ে জন-মানুষের বুকের গভীরে লালিত হচ্ছেন। ঘাতকরা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার যে পথ বহু কষ্টে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন, সেখান থেকে দেশকে বিপরীতমুখী করার উদ্দেশ্য ছিল তাদের বড়ো একটি লক্ষ্য। তাদের লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত করা। মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর অবদান খাটো করা এবং যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্যে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেটা নস্যাৎ করে দেওয়া। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে শুরু হয় এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। একটা সময় ছিল যখন বঙ্গবন্ধুর নামও জাতীয় প্রচার মাধ্যমে উচ্চারণ করা যেত না। ইতিহাস থেকে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কের নাম মুছে ফেলার সর্বাত্মক চেষ্টা হয়েছিল। তরুণদের দীর্ঘকাল জানতে দেওয়া হয়নি মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুকে শুধু অস্বীকার করাই নয়, নানাভাবে তাঁর সম্পর্কে মিথ্যা বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে। স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভে বঙ্গবন্ধুর অবদান অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু কুচক্রীদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে। এ দেশের অস্তিত্বের সঙ্গে যাঁর নাম জড়িয়ে আছে, দেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় যাঁর স্থান, কোনো ষড়যন্ত্র, কোনো হুকুম বা ফরমান দিয়ে ইতিহাস থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলা যায় না। খাটো করা যায় না তাঁর অনন্য অবদান। দেশকে তিনি ভালবেসেছেন অকৃত্রিমভাবে, দেশের মানুষও তাঁকে দিয়েছে হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা। তাই খুনী, ঘাতকচক্র ও তাদের পৃষ্ঠপোষকের সব চক্রান্ত, চেষ্টা, তৎপরতা ব্যর্থ হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু শারীরিকভাবে আজ না থাকলেও মানুষের হৃদয়জুড়ে তাঁর অবস্থান। বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে স্বদেশের মাটি আর মানুষকে এমন গভীর ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধেছেন, যে বন্ধন কোনোদিন ছিন্ন হওয়ার নয়। কবির ভাষায় :

‘এই বাংলার আকাশ বাতাস, সাগর, গিরি ও নদ / ডাকিছে তোমার বঙ্গবন্ধু, ফিরিয়া আসিতে যদি / হেরিতে এখনও মানব হৃদয়ে তোমার আসন পাতা / এখনও মানুষ স্মরিছে তোমারে, মাতা পিতা বোন ভ্রাতা।’

‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা / গৌরী মেঘনা বহমান / ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান...।

লেখক : শিক্ষক, চিকিৎসক, কলামিস্ট।

কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ, কেন্দ্রীয় কমিটি।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
শোক এখন জনতার শক্তি,জাগরণের উৎসবিন্দু
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close