মো. আতিকুর রহমান

  ১০ আগস্ট, ২০২২

রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের লাগাম টানুন

ছবি : সংগৃহীত।

দেশে রাজনীতির ছদ্মাবরণে যে বাণিজ্য চলছে, তার সঙ্গে প্রধান কয়েকটি রাজনৈতিক দল জড়িত। রাজনীতি নামের এ ইজারানীতির ফলে দেশের গণতন্ত্র, সুশাসন ইত্যাদি বিষয় দিন দিন অন্ধকারের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হচ্ছে। বর্তমানে সংসদে আমলা ও ব্যবসায়ীদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এরা নির্বাচনে যে পরিমাণ টাকা খরচ করে, তার কয়েক গুণ বেশি অর্থ উপার্জনের চেষ্টা চালায়। রাজনীতি করে এ দেশে কেউ বিত্তবৈভরের মালিক হয়নি, এমন ঘটনা বর্তমানে বিরল। তাই রাজনীতিকে ইজারানীতি বললেও ভুল বলা হবে না বলেই অনেকের বিশ্বাস।

বর্তমানে রাজনীতি ইজারানীতিতে পর্যবসিত হওয়ায় সুস্থ ও গণতান্ত্রিক ভাবধারার রাজনীতি একপ্রকার তিরোহিত হচ্ছে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে আদর্শ ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের মারাত্মক অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশের রাজনীতিতে সর্বদা এখন ‘ধর-মারও-খাও’ ভাব বিরাজ করছে, যা সাধারণ জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে প্রধান অন্তরায়।

যদিও বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বা রাজনীতির ইজারানীতি নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। নব্বইয়ের পরে যে ‘গণতান্ত্রিক পর্বের’ যাত্রা শুরু হয়েছিল, তখন অধিকাংশ জনগণ আশা করেছিলেন, এবার আমাদের রাজনীতি ক্রমশ গণতান্ত্রিক, সুস্থ ও ইতিবাচক হয়ে উঠবে। কিছুটা সময় মোটামুটি ভালো চললেও পরবর্তীকালে তা ধীরে ধীরে দূষিত হতে থাকে। ক্রমে ক্রমে মূল ধারার রাজনীতি লুটপাটের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এই রাজনীতিকে এখন ‘দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি’ অনেকেই বলে থাকেন। তবে এটাও সত্য সব রাজনৈতিক দল, নেতা বা কর্মীরা রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে যুক্ত নন। বড় দু-তিনটি দল, তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের একটি অংশ, সংসদ সদস্যদের একটি অংশ, অঙ্গসংগঠনের নেতানেত্রীদের একটি অংশ এই দূষণ ও দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে জড়িত। এরাই সরকারকে করছে প্রশ্নবিদ্ধ। মূল দলের তুলনায় সংখ্যায় তারা কম হলেও দলে ও সরকারে তারা খুব প্রভাবশালী। অনেক দুর্বৃত্ত দলের নীতিনির্ধারণেও এরা জড়িত। তাদের দাপটে, সন্ত্রাসে, অর্থবিত্তের ক্ষমতায় ও আত্মীয়তার জোরে দলের নীতিবান, সৎ, সজ্জন ও নিবেদিতপ্রাণ নেতা ও কর্মীরা প্রায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। তাদের অনেকে রাজনীতি থেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছেন।

বর্তমান রাজনীতিতে কালোটাকা ও পেশিশক্তির প্রভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। অবৈধ অর্থ উপার্জনে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দেশে হত্যা, গুম, সন্ত্রাস ও লুটপাটের রাজনীতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা টেন্ডারবাজি ও নিয়োগ বাণিজ্যসহ অন্যান্য উপায়ে অবৈধ অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্টি করছে। নিজ নিজ স্বার্থ চরিতার্থে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল, এমনকি হত্যা করতেও দ্বিধা করছে না, যা প্রকৃত অর্থেই দুঃখজনক।

যদিও বাস্তবতা হলো আমাদের দেশে একশ্রেণির শিক্ষিত ও সচেতন মানুষ রয়েছেন, যারা এই দূষিত ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হয়ে তাদের আজ্ঞাবহ দাস হয়ে নির্দেশনা পালনে ব্যস্ত থাকেন। সব সময় সরকারের অংশীদার হয়ে নিজেদের মুনাফা নিশ্চিত করেন। এই ধারার অবসান হওয়া জরুরি হলেও লুটেরা পুঁজির আধিপত্যের সামনে তা কতটা ইতিবাচক হতে সক্ষম হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে।

যদিও আশার কথা, পুরো শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর তুলনায় এদের সংখ্যা খুবই কম। বাকি সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী স্বাধীন চিন্তা ও মতামত প্রকাশ করতে পারেন। কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি তারা অনুগত নন। হয়তো অনেকে একটি দল সমর্থন করেন। সেই দলকে ভোটও দেন। কিন্তু দলের সমালোচনা করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। নিজের পদোন্নতি বা বৈষয়িক কোনো লাভের জন্য তারা দল সমর্থন করেন না বা ভোট দেন না। দেন নীতিগত কারণে, মনের তাগিদে।

আমাদের বড় দু-তিনটি দল নানা অগণতান্ত্রিক কাজে ব্যাপৃত, নানা সন্ত্রাসী কাজে মদদ দেয়। দলীয় নেতারা দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও আরো নানা অপকর্ম করেন। প্রায় দেখা যায়, তার প্রতিবাদে শিক্ষিত-সচেতন জনগোষ্ঠী তেমন সোচ্চার নন। তারা নেতাদের এই অপকর্মগুলো দেখেন, বুঝতেও পারেন। কিন্তু নিজেদের পরিমণ্ডলে বা প্রকাশ্য সভায় অপকর্মের প্রতিবাদ করেন না। জোরালো ভাষায় নিন্দা করেন না। সুযোগ থাকলেও রুখে দাঁড়ান না। এক অদ্ভুত নির্লিপ্ততা ও উদাসীনতায় তারা আক্রান্ত। শিক্ষিত ও সচেতন জনগোষ্ঠীর খুব ক্ষুদ্র একটি অংশ অপরাজনীতির প্রতিবাদ বা সমালোচনা করে লেখালেখি করেন বা কথা বলেন। বাকিরা যে অপরাজনীতিতে ক্ষুব্ধ হন না, তা নয়। তারাও ক্ষুব্ধ। কারণ, তাদের আশপাশে প্রতিদিন অপরাজনীতির নানা প্রকাশ তারা দেখতে পান। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তারা নীরব থাকেন।

অন্যদিকে দিন যতই যাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের বিপরীতমুখী বক্তব্য জনমনে শঙ্কা বাড়াচ্ছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে সংলাপ হচ্ছে কিন্তু এখন পর্যন্ত আস্থার জায়গা অর্জিত হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক সংঘাত ও হানাহানি হওয়ার মতো যে পরিস্থিতি হাতছানি দিচ্ছে, আমরা তা দেখতে চাই না। আমাদের প্রত্যাশা দেশে সুস্থ ও পরিচ্ছন্ন ধারার রাজনীতি যাতে প্রতিষ্ঠিত হয় সে লক্ষ্যে সবার কাজ করা উচিত।

এ কথাটি সত্য। আমাদের অনেক বড় বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষক দুর্নীতি ও সামগ্রিক অপরাজনীতির বিরুদ্ধে কোনো কথাই বলেন না। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, পুঁজিবাদ, ধনতন্ত্র ইত্যাদির বিরুদ্ধে কথা বলেন। প্রবন্ধ লেখেন। নিঃসন্দেহে এগুলো খুব প্রয়োজনীয় বিষয়। কিন্তু দেশের রাজনীতি যদি সুস্থ না হয়, গণতান্ত্রিক না হয়, বিচারব্যবস্থা যদি পক্ষপাতমুক্ত না হয়, জাতীয় সংসদ যদি কার্যকর না হয়, সরকারি প্রশাসন-প্রতিষ্ঠান যদি নিয়মনীতি বাদ দিয়ে পরিচালিত হয়, তাহলে বুদ্ধিজীবীদের দাবি ও প্রত্যাশা বাস্তবায়ন সব সময় অসম্ভব থেকে যেতে বাধ্য।

আমরা প্রায় দূষিত রাজনীতির জন্য রাজনীতিবিদদের দোষারোপ করি। নিন্দা করি। দূষিত রাজনীতি ও দুর্বৃত্ত নেতাদের যারা প্রশ্রয় দেয়, আমরা তাদেরও সমালোচনা করি। কিন্তু নিরপেক্ষ নাগরিকও কি এজন্য কম দায়ী? আবশ্যই না। কারণ আমরা সবাই ভোট দিয়েই তো তাদের নেতা বানিয়েছি। আমাদের ভোটে জয়লাভ করেই তারা সরকার গঠন করেছে। আমরা তো তাদের ভোট না দিয়ে প্রত্যাখ্যান করিনি। অযোগ্য লোকদের নেতা ও সাংসদ করার জন্য আমরাও কি কম দায়ী? আজ যদি দেশের সব সুশিক্ষিত ও সচেতন মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে দুর্নীতি ও অপরাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেন, নিয়মিত প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করতেন, তাহলে দুর্নীতি ও অপরাজনীতি এতটা বিস্তার লাভ করত না। দেশের সাধারণ জনগণ ও নাগরিক সমাজ তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে বলেই আজ সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ ও দুর্বৃত্ত ব্যক্তিরা দেশের নেতা হতে পেরেছে। অযোগ্য ব্যক্তিরা দেশের কর্ণধার হয়ে উঠেছে। রাজনীতি আর লুটপাট আজ সমার্থক হয়ে গেছে। এই রুগ্ণ পরিবেশে সৎ, সজ্জন, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। তাদের সেবা থেকে দেশ আজ বঞ্চিত। এ অবস্থার অবসান হওয়া জরুরি। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রাজনীতি নামের ইজারানীতি সর্বাগ্রে বন্ধ করতে হবে। তাই, দেশে সুস্থধারার রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে দেশের বৃহত্তর নাগরিক সমাজ সঠিক সিদ্ধান্ত সময়মতো গ্রহণ করবেন এমনটিই কাম্য।

লেখক : কলামিস্ট ও সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা, বিইউএফটি

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন,লাগাম টানুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close