ড. অরূপ রতন চৌধুরী

  ০৬ আগস্ট, ২০২২

ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান নিষিদ্ধ হোক

ফাইল ছবি।

আমাদের ছোটবেলায় অগ্রজদের সামনে অনুজরা ধূমপান বা নেশাজাত দ্রব্য সেবন করত না। মূলত সেই সময়ে সমাজে কালচার ছিল যে, বড়দের সামনে ধূমপান করা চরম বেয়াদবি। আড়ালে-আবডালে সিগারেট সেবনের পরেও হঠাৎ বড়দের সামনে পড়ে যাওয়া, সেটা আলাদা বিষয় ছিল। তখন সেটা হয় ফেলে দিত, নতুবা আড়াল করে রাখত। বড়দের সম্মানে ধূমপানরত ব্যক্তি সিগারেট আড়াল করতে গিয়ে হাত পুড়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটত। সভ্যসমাজে পারিবারিক শিক্ষা ও নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষের থেকে এমন আচরণ আকাক্সিক্ষত। কিন্তু বর্তমানে আমাদের অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। সামাজিক রীতিনীতির চরম অবক্ষয়ের কারণে অনেক সামাজিক ও পারিবারিক শিষ্টাচার অবলীলায় লঙ্ঘন করতে দেখা যাচ্ছে। ‘ধূমপান’ শিষ্টাচার লঙ্ঘনের প্রক্রিয়া উসকে দিচ্ছে।

সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৭ সালের তথ্য মতে, দেশে ৩৫.৩ শতাংশ (৩ কোটি ৭৮ লাখ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপান, তামাক সেবন করে। এর সঙ্গে আরো একটা অংশ রয়েছে যারা এই গণনার বাইরে। অর্থাৎ শিশু-কিশোরদের মধ্যেও এই বদঅভ্যাস রয়েছে, যা অত্যন্ত মারাত্মক অশনিসংকেত! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত ‘Global School Based Student Health Survey-2014’ গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সি শিশু-কিশোরদের মধ্যে তামাক ব্যবহার করে ৯ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্বে এ সংখ্যা ৩ কোটি ৮০ লাখ (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০২১)!

কৌতূহল কিংবা প্ররোচনায় যে শিশু-কিশোরটি ধূমপান দিয়ে নেশার জগতে পা রাখছে, জীবনে সাফল্যের পথকে পায়ে ঠেলে বিপথগামী হচ্ছে, তার জন্য কে বা কারা দায়ী? আমরা তার খোঁজ রাখছি না। মূলত, এর জন্য দায়ী মৃত্যু বিপণনকারী তামাক কোম্পানিগুলো। এরা কৌশলে বিজ্ঞাপন ও নানান প্রলোভনে তামাকের মাধ্যমে আমাদের শিশু-কিশোরদের ক্ষতিকর নেশার জগতে ঠেলে দিচ্ছে।

আজকের দিনে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সবাই কম-বেশি রেস্টুরেন্টে খাবার খায়। উল্লেখ্য, এসব জায়গায় ইদানীংকালে তরুণদের যাতায়াত তুলনামূলক বেড়েছে, যা ‘সুযোগ’ হিসেবে ব্যবহার করছে তামাক কোম্পানিগুলো। তরুণদের কাছে জনপ্রিয় এসব রেস্টুরেন্টে কোম্পানিগুলো স্পন্সরের মাধ্যমে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ Designated Smoking Zone তৈরি করে দিচ্ছে। এসব স্থানে তামাকের বিজ্ঞাপনও প্রচার করতে দেখা যাচ্ছে। রেস্টুরেন্টে খাবার ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সময় কাটানোর স্থান সেখানে ধূমপানের স্থান রাখায় সেখানে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ থাকে না। কারণ, অধিকাংশ রেস্টুরেন্টে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ আশপাশের স্থানকে সুরক্ষিত রাখছে না। ধূমপানের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে। ফলে পরোক্ষ ধূমপানে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী, শিশু ও অধূমপায়ীরা। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস্) ২০১৭-তে দেখা যায়, কর্মক্ষেত্রে ৪২.৭ শতাংশ, গণপরিবহনে প্রায় ৪৪ এবং ৪৯.৭ শতাংশ মানুষ রেস্তোরাঁয় পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। বাড়ি, গণপরিবহন, কর্মক্ষেত্র ও জনসমাগমস্থল মিলিয়ে এ সংখ্যা প্রায় ৮ কোটি! বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৬১,০০০ শিশু পরোক্ষ ধূমপানজনিত বিভিন্ন অসুখে ভোগে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে পৃথিবীতে বছরে ১২ লাখ মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করে (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) অনুসারে আমাদের দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণীত হয়েছে। বাংলাদেশ এ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী প্রথম দেশ। এফসিটিসির ধারা ৮ ও এ-সংক্রান্ত গাইডলাইন অনুযায়ী, পরোক্ষ ধূমপানের শিকার থেকে অধূমপায়ীদের রক্ষায় ‘পূর্ণাঙ্গ ধূমপানমুক্ত নীতিমালা’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

২০০৫ সালে প্রণীত (২০১৩ সালে সংশোধিত) ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন’ অনুসারে পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ। তবে কিছু পাবলিক প্লেস এবং একাধিক কামরার পাবলিক পরিবহনে (ট্রেন, স্টিমার ইত্যাদি) ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বা Designated Smoking Zone রাখার কথা বলা হয়েছে, যা তামাক নিয়ন্ত্রণের একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণ, জনবহুল পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপানের স্থান পরোক্ষ ধূমপানে ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর প্রধান শিকার নারী ও শিশুরা। উপরন্তু, অধূমপায়ী এবং এসব স্থানে সেবা প্রদানকারী সেবাকর্মীরাও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছের। কারণ গবেষণা বলছে, আচ্ছাদিত ধূমপান এলাকার আশপাশের স্থান কখনোই ধোঁয়ামুক্ত হয় না। এই তামাকের ধোঁয়ায় ৭০০০-এর বেশি ক্ষতিকর রাসায়নিক রয়েছে, যার মধ্যে ৭০টি ক্যানসার সৃষ্টি করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পরোক্ষ ধূমপান অধূমপায়ীদের হৃদরোগের ঝুঁকি ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায় শতকরা ২০ থেকে ৩০ ভাগ। শিশুদের ‘সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিন্ড্রোম’ রোগেরও কারণ পরোক্ষ ধূমপান। পক্ষান্তরে, কর্মক্ষেত্র, রেস্তোরাঁসহ সব পাবলিক প্লেসকে ১০০% ধূমপানমুক্ত করা সম্ভব হলে কর্মীদের হৃদরোগে আক্রান্তের ঝুঁকি ৮৫ ভাগ হ্রাস পায়। এই মানুষগুলোর শ্বাসতন্ত্র ভালো থাকে এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুলাংশে কমে যায়। ধূমপানমুক্ত পরিবেশে ধূমপায়ী কর্মীর সিগারেট সেবনের মাত্রা দিনে গড়ে ২ থেকে ৪টা পর্যন্ত হ্রাস পায়, যা গবেষণায় প্রমাণিত।

উল্লেখ্য, বর্তমান আইনে পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপানমুক্ত সাইনেজে ‘ধূমপান হইতে বিরত থাকুন, ইহা শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ বার্তা উল্লেখ আছে। শাস্তিযোগ্য অপরাধ যেকোনো স্থানেই উচিত নয়, তা সংঘটিত হোক, যেটা কারোরই কাম্য নয়। সুতরাং, ধূমপানের জন্য জনবহুল স্থানে আলাদা করে স্থান বরাদ্দ করতে হবে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করেই ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান নিষিদ্ধ করা হোক। এতে ধূমপায়ীরা ধূমপান ত্যাগে উৎসাহিত হতে পারে এবং সুরক্ষিত থাকবে অধূমপায়ীরা।

সার্বিক দিক বিবেচনায় বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি অধিকতর শক্তিশালী করার মাধ্যমে পরোক্ষ ধূমপান থেকে অধূমপায়ীদের রক্ষায় পদক্ষেপ নিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে, বিশ্বে এটি নতুন নয় বরং আমরাই এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছি। বিশ্বে ৬৯টি দেশ আচ্ছাদিত পাবলিক প্লেসে ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। বিমানবন্দরে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে ৪২টি দেশে। তাও ভালো আমরা এ পর্যায়ে এসে শুরু করতে পেরেছি। এখন এই প্রক্রিয়া যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন এবং বাস্তবায়নে যেতে হবে। কারণ, প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত দেখতে চান।

ধূমপায়ীদের ধূমপান হতে বিরত রাখতে ‘শতভাগ ধূমপানমুক্ত স্থান’ একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। তাই পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপানের নির্ধারিত স্থান নিষিদ্ধ করতে হবে। এজন্য বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের (ধারা ৭ ও ৭ক) বিলুপ্ত করা উচিত। এতে করে প্রধানমন্ত্রীর ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ ঘোষণা বাস্তবায়ন ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা পাবে, যা দীর্ঘ মেয়াদে দেশের স্বাস্থ্য খাতে অসংক্রামক রোগের চাপ ও চিকিৎসা ব্যয় কমাবে। আগামী প্রজন্ম হবে সুস্বাস্থ ও সুনাগরিকের গুণাবলি সম্পন্ন দক্ষ ও কর্মক্ষম জনবল। যারা জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

লেখক : অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ধূমপান,নির্ধারিত স্থান,নিষিদ্ধ হোক
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close