গোপাল অধিকারী
নিরাপদ সড়কের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে
শুক্রবারে আমার চোখে দেখা সবচেয়ে মর্মান্তিক শিরোনাম ‘ছুটির দিনে ঘুরতে বেরিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন ১১ জন।’ তারা চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী। স্থানীয় একটি কোচিং সেন্টারের উদ্যোগে চাঁদা তুলে খৈয়াছড়াা ঝরনায় পিকনিক করতে গিয়েছিলেন তারা। শুক্রবার (২৯ জুলাই) দুপুর পৌনে ২টার দিকে মিরসরাইয়ের বারতাকিয়া রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তাদের বহনকারী মাইক্রোবাস। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো পাঁচজন। তাদের মধ্যে চারজন শিক্ষক ছিলেন। বাকিরা শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ছয়জন এসএসসি পরীক্ষার্থী, বাকি চারজন একাদশ শ্রেণির ছাত্র। কি মর্মান্তিক ঘটনা! তবে কি কেউ বেড়াতে যাবে না? ঘটনাটি এমন নয়। সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপনে ভ্রমণেরও প্রয়োজন আছে। তবে এমন দুর্ঘটনার শেষ কোথায়? আমরা কি দিন দিন অনিরাপদ হতে চলেছি? আমরা কি পারি না নিজের জীবনকে নিরাপদ রাখতে? এক সেকেন্ডে ঝরে গেল ১১টি সম্পদ। তাদের সামনে ছিল সীমাহীন ভবিষ্যৎ। আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের সম্পদ।
এখানেই শেষ নয় প্রতিদিনই বিভিন্ন শিরোনামে সড়কে ঝরে পড়ছে দেশের গুণী, বিশিষ্ট ও সাধারণ নাগরিক। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধসহ রয়েছে বিভিন্ন বয়সের। অনেক লেখা ও অনেক দেখা থাকলেও প্রতিদিন বাদ যাচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনার মর্মান্তিক প্রতিবেদন, চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে না পাঠকদের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর। তদন্ত কমিটি করলেও হচ্ছে না তার সঠিক সুরাহা। এ ঘটনার আগেও লেভেলক্রসিংয়ে আরো দুর্ঘটনা ঘটেনি তেমনটা নয়।
বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) রাত ৯টার দিকে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা গোপালগঞ্জগামী টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেসের সঙ্গে একটি মিক্সার মেশিন ও শ্রমিকবাহী ভটভটির সংঘর্ষ হয়েছে। এতে ভটভটিতে থাকা পাঁচ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো কয়েকজন। ঘটনার জন্য তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছে। আগেও তদন্ত কমিটি হয়েছে, তবু কেন দুর্ঘটনা বাড়ছে প্রশ্ন রয়ে যায়। কেন অরক্ষিত থাকছে রেলপথÑ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
তথ্যমতে, সারা দেশে রেলপথে ক্রসিং আছে ২ হাজার ৮৫৬টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬১টিরই অনুমোদন নেই। আবার ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ ক্রসিংয়ের মধ্যে ৬৩২টি ক্রসিংয়েই গেটম্যান নেই। জানা গেছে, গত প্রায় চার বছরে সারা দেশে রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১ হাজার মানুষ। আহত ও পঙ্গু হয়েছেন দেড় হাজারের বেশি মানুষ। রেল দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি হয়, তার ৮৯ শতাংশই অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ের কারণে ঘটে। রেলওয়ের লেভেল ক্রসিংগুলোর (বৈধ-অবৈধ) প্রায় ৮৪ শতাংশই অরক্ষিত। আর এসব ক্রসিংয়ে প্রায়ই ঝরছে সাধারণ মানুষের প্রাণ। অথচ এসব ক্রসিং নিরাপদ করার বিষয়টি কর্তৃপক্ষের অগ্রাধিকারে নেই।
সড়ক দুর্ঘটনায়গত জুন মাসে নিহত হয়েছেন ৫২৪ জন। এর মধ্যে ২০৪ জনই নিহত হয়েছেন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। এর আগের মাসে (মে ২০২২) সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৪১ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জুন মাসে দেশের সড়কে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৬৭টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫২৪ জন এবং আহত ৮২১ জন। নিহতদের মধ্যে নারী ৬৮ জন এবং শিশু ৭৩ জন। ১৯৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ২০৪ জন, যা মোট নিহতের ৩৮.৯৩ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১০৭ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা নিহতের ২০.৪১ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৮৬ জন বা ১৬.৪১ শতাংশ। এ সময় ৮টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৯ জন নিহত, ১৬ জন আহত হয়েছেন এবং ৩ জন নিখোঁজ রয়েছেন। ১৮টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত এবং ৪ জন আহত হয়েছেন। দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ ২৬.২২, যাত্রীবাহী বাস ৯.৮৩ শতাংশ, মোটরসাইকেল ২৬.৭৩ শতাংশ, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা-হিউম্যান হলার) ১৮.৭৮ শতাংশ, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন-(নসিমন-ভটভটি-টমটম-মাহিন্দ্র-চান্দের গাড়ি) ৬.৪৩ শতাংশ। দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে ১১৭টি। এসব দুর্ঘটনায় ১৩৯ জন নিহত হয়েছেন। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ১৩টি দুর্ঘটনায় ১৪ জন নিহত হয়েছেন। একক জেলা হিসেবে ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। সড়ক দুর্ঘটনায় গত জুন মাসে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৭ দশমিক ৪৬ জন করে নিহত হয়েছে। মে মাসে প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছিলেন ২১ জন। অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে দুর্ঘটনা। করোনা মহামারির মধ্যেও সরকারি হিসাবেই গত এক বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। অথচ করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গত বছর কয়েক ধাপে দেশে ৮৫ দিন গণপরিবহন চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ ছিল। এর পরও পুলিশের হিসাবে ২০২০ সালের তুলনায় দেশে ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু এক হাজারের বেশি বেড়েছে। সুতরাং এই দুর্ঘটনা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হচ্ছে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় যারা প্রাণ হারান, তাদের মধ্যে ৬৭ শতাংশই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্ষম (১৫-৬৪ বছর বয়সি)। আর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাবে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। সুতরাং দুর্ঘটনা মর্মান্তিকের পাশাপাশি আঘাত করছে অর্থনীতিকেও। সড়ক দুর্ঘটনার কারণ, ধরন, স্থান ও সমাধানের উপায় সবই আছে কিন্তু তার বাস্তবায়ন কেন হচ্ছে না প্রশ্নটা হয়তো আমার মতো সবারই। অনিরাপদ সড়ককে নিরাপদ করতে হলে সড়কের পাশাপাশি রেলকে নিরাপদ করতে হবে। সেই সঙ্গে পথচারীকেও নিরাপত্তা ও নিরাপদ চলা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। আর এই সামষ্টিক দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।
রেল-সংশ্লিষ্ট তথ্য মতে, বিগত এক যুগে রেলওয়েতে ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। অথচ রেলওয়ের লেভেলক্রসিংয়ের দুর্ঘটনা রোধকল্পে তেমন কোনো বড় অঙ্কের অর্থের প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখা যায় না। রেলে এ পর্যন্ত যে বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে এবং চলমান যে বরাদ্দ আছে এর ১ শতাংশের কম বিনিয়োগ করলেও রেলপথ নিরাপদ হয়ে যায়। কিন্তু রেলের কর্মকর্তাদের এসব প্রকল্পের দিকে মনোযোগ নেই। যে কারণে একটি দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আরো একটি দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ে ছোট একটি সতর্কীকরণ নোটিস টাঙিয়ে কর্তৃপক্ষ দায় সারে। কিন্তু একবারও ভাবে না এটি ক্রসিং নামের মৃত্যুফাঁদ। যখনই দুর্ঘটনা ঘটে তখন দায়ী ব্যক্তিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ঢাকঢোল পিটিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু তদন্ত কমিটির রিপোর্টের সুপারিশ অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে রেলপথ আছে ২ হাজার ৯৫৫ কিলোমিটার। এই রেলপথের ওপর দিয়ে কোথাও কোথাও সড়ক চলে গেছে। রেল আর সড়কের এই সংযোগ স্থলকেই লেভেলক্রসিং বলা হয়। এগুলোকে বৈধ-অবৈধ, পাহারাদার আছে (ম্যানড), পাহারাদার নেই (আনম্যানড) এভাবে শ্রেণিবিন্যাস করে রেল কর্তৃপক্ষ। যেসব ক্রসিংয়ে পাহারাদার আছেন, সেগুলোতে লোহার প্রতিবন্ধক থাকে। পাহারাদার ট্রেন আসার সংকেত পেয়ে প্রতিবন্ধক নামিয়ে অন্য যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে পাহারাদার ভুল না করলে যানবাহনের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষ হওয়ার সুযোগ নেই। পাহারাদার ও প্রতিবন্ধক থাকা লেভেক্রসিংয়ে তাই দুর্ঘটনাও খুব কম। পাহারাদার নেই এমন ক্রসিং অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ে মৃত্যু বেড়েই চলেছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সড়ক ও রেলপথের অনিরাপদ দিকগুলো নিরাপদ করতে সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে। তবে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। সড়ক হবে নিরাপদ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট