মো. আতিকুর রহমান

  ২৯ জুলাই, ২০২২

অরক্ষিত রেলক্রসিং যেন মরণফাঁদ 

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ।

বাংলাদেশ রেলওয়ে হচ্ছে বাংলাদেশের একটি রাষ্ট্র-মালিকানাধীন ও রাষ্ট্র-পরিচালিত রেল পরিবহন সংস্থা। বিগত ১৯৯০ সাল থেকে এই সংস্থাটি রেল মন্ত্রণালয়ের অধীন নিজের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে মোট ২৫ হাজার ৮৩ জন নিয়মিত কর্মচারীসহ মোট ২৯৫৫.৫৩ কিমি রুট নিয়ে দেশে রেল চলাচল করছে। মূলত এই রেলই দেশের পরিবহন ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান মাধ্যম।

প্রতিদিন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেশে অরক্ষিত রেলক্রসিং নিয়ে যেসব তথ্য সামনে আসে তা অত্যন্ত ভীতিকর। সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সারা দেশে ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথে বৈধ ক্রসিংয়ের সংখ্যা ১ হাজার ৪১২টি; এর মধ্যে ৯৪৬টিতে, অর্থাৎ ৬৭ শতাংশে কোনো গেট নেই! এমনকি নেই যান নিয়ন্ত্রণের কোনো কর্মীও। নেই সংকেত বাতি। এ ছাড়া রেললাইনের উপর দিয়ে স্থানীয় লোকজন অবৈধ স্থাপনা, হাটবাজার, রাস্তা নির্মাণসহ বিভিন্ন সংস্থার কাজে সমন্বয়হীনতার কারণে হিসাবের বাইরেও আরো বিপুলসংখ্যক মরণফাঁদ তৈরি হয়েছে, যা রেলের সার্বিক নিরাপত্তা ও পুরো পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহতার দিকে ধাবিত করছে।

তথ্য মতে, ২০০৪-২০০৫ সালের শেষে বাংলাদেশে ১ হাজার ৬১০টি লেভেল ক্রসিং ছিল। ২০২০ সালের হিসাবে দেশে মোট লেভেল ক্রসিং ২ হাজার ৮৫৬টি, যার মধ্যে ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ এবং ১ হাজার ৩৬১টি অনুমোদনহীন। ক্রসিংগুলোর (বৈধ-অবৈধ) প্রায় ৮৪ শতাংশ অরক্ষিত। পূর্বাঞ্চল রেলে মোট ১ হাজার ৩৭৭টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে, যার মধ্যে ৮১১টি অবৈধ। পশ্চিমাঞ্চলে মোট ১ হাজার ৪৭৯টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে, যার মধ্যে ৫৫০টি অবৈধ। বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ধারণা করা হয় যে, বাংলাদেশে ঘটা রেল দুর্ঘটনার ৭২ শতাংশ মানব-ত্রুটিজনিত, ২৩ শতাংশ যান্ত্রিক ত্রুটিজনিত এবং বাকি ৫ শতাংশ অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং এবং যানবাহন চালক ও পথচারীদের অসতর্কতার সঙ্গে রেলক্রসিং পারাপারের কারণে ঘটে। মানব-ত্রুটিগুলোর মধ্যে রয়েছে লোকোমাস্টার, স্টেশনমাস্টার ও পরিচালকের ত্রুটি বা অবহেলা এবং বেপরোয়াভাবে ট্রেন চালানো। যান্ত্রিক ত্রুটি ঘটে লোকোমোটিভের ত্রুটি, ত্রুটিযুক্ত ট্র্যাক ও সিগন্যাল পদ্ধতির কারণে।

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ৩১ জন এবং গত ১০ বছরে তিন শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শুধু যে অবৈধ লেভেলক্রসিংয়েই দুর্ঘটনা, প্রাণহানি ও সম্পদহানি ঘটছে তা নয়, বৈধ ক্রসিংগুলোতেও হরহামেশা ঘটছে দুর্ঘটনা। এমন এক বাস্তবতায় ত্রুটিপূর্ণ লেভেলক্রসিংগুলো যত দ্রুত সম্ভব সুরক্ষিত করতে হবে। বছরের পর বছর ধরে এগুলো অরক্ষিত থাকলেও দেখা গেছে, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ পরস্পরের ওপর দোষ চাপিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে, যা কাম্য নয়।

বর্তমানে রেলে দুর্ঘটনার প্রায় ৯৫ শতাংশই ঘটছে বিভিন্ন লেভেলক্রসিংয়ে। এর প্রধান কারণ হলো অন্তত ৮৫ শতাংশ বৈধ লেভেলক্রসিংয়ে নেই কোনো প্রহরী। পাশাপাশি রেলে যত্রতত্রভাবে বেড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা, হাটবাজারগুলোর অবস্থা আরো ভয়াবহ করছে রেলসেবা ব্যবস্থাকে। কারণ সেগুলোয় কোনো প্রতিবন্ধক দণ্ড পর্যন্ত নেই। দেশের অসংখ্য অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ে শুধু নামকাওয়াস্তে যেটি করা হয়েছে তা হলো একটি নোটিস টাঙিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে রেল বিভাগ।

লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার জন্য পথচারী ও যানবাহনের চালকরাও দায় এড়াতে পারেন না। সাধারণত দুই কারণে রেলপথে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় ও ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে। ট্রেনের নিচে কাটা পড়লে রেল কর্তৃপক্ষ কোনো দায় নেয় না; উল্টো মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। অন্যদিকে, লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দায় এড়ানোর চেষ্টা করা হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, দুর্ঘটনার কারণে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় ঘটে। এ কারণে যাত্রী ভোগান্তি বাড়ে; উপরন্তু রেলওয়েকে লোকসান গুনতে হয়। দুর্ঘটনা রোধে ও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে লেভেলক্রসিংগুলো অবশ্যই সুরক্ষিত করতে হবে। লেভেলক্রসিং অতিক্রমকালে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। নিয়ম-কানুন ও আইন সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিয়ে কর্তৃপক্ষ লেভেলক্রসিংগুলো সুরক্ষিত করার পদক্ষেপ নেবে, এটাই প্রত্যাশা।

রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের নিচে গাড়িচাপা পড়া ও ধাক্কা খেয়ে ছিটকে প্রাণহানির ঘটনাও কম নয়। গত এক বছরে রেলক্রসিংয়ে ৩৩টি দুর্ঘটনায় ৭৪ জন নিহত হয়েছেন। আর এই সংখ্যা রেললাইনে কাটা পড়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের হিসাব বাদেই। রেলওয়ের তথ্য অনুসারে, সারা দেশে অনুমোদনহীন রেলক্রসিংয়ের বেশির ভাগই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সড়কে। আরো আছে পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) সড়কে। সরকারের কমবেশি পাঁচটি সংস্থা রেললাইনের উপর সড়ক নির্মাণ করার কারণে রেলক্রসিং সৃষ্টি হয়েছে।

দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬৭ শতাংশ অরক্ষিত রেলক্রসিং থাকাসহ বিভিন্ন ত্রুটির কারণে দেশে একের পর এক রেলদুর্ঘটনা ঘটছে, এগুলো যেমন আমলে নিতে হবে ঠিক তেমনি রেলক্রসিং সুরক্ষিত করা এবং দুর্ঘটনা এড়াতে সামগ্রিক পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে। একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটবে এবং মানুষ চলে যাবে না ফেরার দেশেÑ এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে রেলক্রসিং সুরক্ষিত করাসহ যাত্রীদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যা আস্থা অর্জনসহ রেলের সেবার মানোন্নয়নে অধিক জরুরি। রেল কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলোর দিকে অধিক দৃষ্টি দেবেÑ এমনটাই কাম্য।

লেখক : সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা, বিইউএফটি

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
অরক্ষিত,রেলক্রসিং,মরণফাঁদ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close