সাদিকুর সাত্তার আকন্দ

  ২৮ জুলাই, ২০২২

ব্যবসায়িক দলিল বিষয়ক কথকতা

বৈধপন্থায় যেকোনো কাজ শুরু করার ক্ষেত্রে প্রয়োজন একটি অনুমোদন বা স্বীকৃতির। কাজের ধরন অনুযায়ী এই অনুমোদনের বিভিন্ন নাম হয়ে থাকে। ব্যবসা আইনসিদ্ধভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় কিছু দলিল প্রয়োজন হয়। প্রাথমিক অবস্থায় ব্যবসা শুরুই হয় ট্রেড লাইসেন্স বা বাণিজ্য অনুমোদন সনদ দিয়ে। ব্যবসায় শুরু করার জন্য ট্রেড লাইসেন্সটি নিতে হয় স্থানীয় সরকারের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান হিসেবে ট্রেড লাইসেন্স সরবরাহ করে থাকে। সিটি করপোরেশন কর বিধান-১৯৮৩-এর মাধ্যমে বাংলাদেশে ট্রেড লাইসেন্সের সূচনা ঘটে। ব্যবসায়ের প্রথম ও অবিচ্ছেদ্য একটি দলিল হচ্ছে ট্রেড লাইসেন্স। উদ্যোগ ও ব্যবসার বৈধতার প্রতীক হচ্ছে ট্রেড লাইসেন্স। ব্যবসায়ের অনেক অত্যাবশ্যকীয় দলিল রয়েছে যেগুলো ট্রেড লাইসেন্সের ওপর ভিত্তি করেই একজন উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীকে প্রদান করে থাকে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

ট্রেড লাইসেন্সকে একটি উদ্যোগের বীজ রোপণের সঙ্গে তুলনা করলে বিষয়টি খুব বাড়াবাড়ি হবে না। একটি ট্রেড লাইসেন্স পেতে গেলে একজন উদ্যোক্তাকে কতগুলো বিধি বা নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অফিস বা দোকান ভাড়ার চুক্তিপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি, অফিস বা দোকান ব্যবসায়ীর নিজের জায়গায় হলে ইউটিলিটি বিল এবং হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধের ফটোকপি। একজন উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীকে অবশ্যই বাণিজ্যিক স্থাপনায় অফিস বা দোকান গড়ে তুলতে হবে। যে ব্যক্তি ব্যবসার স্বত্বাধিকারী তার জাতীয় পরিচয়পত্র এবং সঙ্গে তিন কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি নিয়ে নির্দিষ্ট ফর্মে আবেদন করতে হবে। সেক্ষেত্রে কখনো কখনো টিআইএন সনদও প্রয়োজন হতে পারে। অংশীদারি ব্যবসার ক্ষেত্রেও স্বত্বাধিকারী ফার্মের মতোই কিছু ডকুমেন্ট দরকার হয়। অফিস বা দোকান ভাড়ার চুক্তিপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি, জায়গাটি অংশীদারদের কারোর নিজের হলে ইউটিলিটি বিল এবং হোল্ডিং টেক্স পরিশোধের ফটোকপি সঙ্গে ৩০০ টাকার দলিলে অংশীদারি ব্যবসার চুক্তিপত্র, এ ক্ষেত্রে ম্যানেজিং পার্টনারের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ও তিন কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি অত্যাবশ্যকীয়।

গঠনগত দিক থেকে লিমিটেড কোম্পানির সঙ্গে স্বত্বাধিকারী ব্যবসা ও অংশীদারি ব্যবসার কয়েকটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সেজন্য লিমিটেড কোম্পানির ট্রেড লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল যেমন কোম্পানির সার্টিফিকেট অব ইন-করপোরেশন, মেমোরেন্ডাম ও আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন, ম্যানজিং ডিরেক্টরের জাতীয় পরিচয়পত্র ও তিন কপি ছবি দরকার হয়। বর্তমান সময়ে টিআইএন সনদ এমনকি ট্যাক্স রিটার্নের কপিও দরকার হয়। ব্যবসায়ের গঠনগত দিক তথা শ্রেণি বিভাগের ওপর ভিত্তি করে যেমন কিছু কাগজপত্র ট্রেড লাইসেন্সের জন্য দরকার হয়; ঠিক তেমনি ব্যবসায়ের ধরন অনুযায়ীও কিছু সনদ বা ছাড়পত্র প্রয়োজন হয় ট্রেড লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে। কোনো প্রতিষ্ঠানের ফ্যাক্টরির ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহের বেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের কপি, প্রস্তাবিত কারখানার ম্যাপ, পাশর্^বর্তী স্থাপনার মালিকের অনাপত্তিনামা ও ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র, সিএনজি স্টেশন বা দাহ্য পদার্থ ব্যবসার ক্ষেত্রে বিস্ফোরক অধিদপ্তর বা ফায়ার সার্ভিস ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র প্রয়োজন হয়। ক্লিনিক বা প্রাইভেট হাসপাতালের ক্ষেত্রে ডিরেক্টর জেনারেল-স্বাস্থ্য কর্তৃক অনুমতিপত্র এবং প্রিন্টিং প্রেস ও আবাসিক হোটেলের ক্ষেত্রে ডেপুটি কমিশনার কর্তৃক অনুমতিপত্র অত্যাবশ্যকীয়।

ব্যবসায়ের আরো ধরন রয়েছে যেমন ওষুধ ও মাদকদ্রব্যের ক্ষেত্রে ড্রাগ লাইসেন্সের কপি এবং ট্রাভেলিং এজেন্সির ক্ষেত্রে সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষের অনুমতি অত্যাবশ্যকীয় বলে গণ্য হয়। অর্থাৎ ট্রেড লাইসেন্সপ্রাপ্তির ফর্ম পূরণের আগে ব্যবসায়ের গঠনগত ও ধরন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সনদ ও ছাড়পত্র অত্যাবশ্যকীয়। তারপর একজন উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীকে ফর্ম পূরণের ধাপগুলোকে অনুসরণ করতে হবে। ব্যবসাটি ছোট হলে একজন উদ্যোক্তা ‘আই ফর্ম’ আর ব্যবসাটি বড় হলে ‘কে ফর্ম’ নামে একটি ফর্ম সংগ্রহ করবে। ট্রেড লাইসেন্সের ফি ভ্যাটসহ জমা দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে রসিদ সংগ্রহ করতে হবে। ব্যবসায়ের ধরন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদন ফর্মটি পূরণ করে সঙ্গে ব্যাংক ফি জমা রসিদটি সংযুক্ত করে স্থানীয় সরকারের অফিসে জমা দিতে হবে।

স্থানীয় সরকারের অধিভুক্ত আঞ্চলিক অফিস থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা ব্যবসায়িক কেন্দ্রটি পরিদর্শন করে অফিসে রিপোর্ট করবেন। পূর্ববর্তী প্রতিটি ধাপ সঠিকভাবে সম্পূর্ণ হলে চূড়ান্ত পর্যায়ে ট্রেড লাইসেন্স পাওয়া যাবে, সেই আঞ্চলিক অফিস থেকে। প্রাপ্ত ট্রেড লাইসেন্সটি দিয়ে সারা বাংলাদেশ জুড়ে ব্যবসা করা যাবে। তবে প্রতি অর্থবছরে অবশ্যই লাইসেন্সটি নবায়ন করতে হবে। ট্রেড লাইসেন্সপ্রাপ্তির পর উদ্যোক্তা নিজেকে একজন বৈধ ব্যবসায়ী হিসেবে দাবি করতে পারবেন। ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহের পর একজন উদ্যোক্তার জন্য জরুরি হলো ওই লাইসেন্সের নামে অর্থাৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে একটি চলতি হিসাব খোলা। যেহেতু অর্থ একটি ব্যবসায়ের রক্ত সঞ্চালনের সঙ্গে তুলনীয়; সেহেতু একটি চলতি হিসাব ব্যবসায়ের ধমনির কাজ করবে। ব্যবসায়ের শ্রেণি বা ধরন অনুযায়ী চলতি হিসাব খুলতে বিভিন্ন ডকুমেন্ট লাগে। প্রত্যেক ব্যাংক কর্মকর্তাই উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীদের এ বিষয়ে অবগত করে থাকেন।

বৈধ ও হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্সের কপি সঙ্গে উদ্যোক্তার প্রতিষ্ঠানের সিল চলতি হিসাব খোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি ডকুমেন্ট। অনলাইনে চলতি হিসাব খোলার ক্ষেত্রেও কমপক্ষে ট্রেড লাইসেন্স ও প্রতিষ্ঠানের সিল অবশ্যই লাগবে। চলতি হিসাবটি চালু করার আগে নির্দিষ্ট পরিমাণে টাকা সর্বনিম্ন ২০০০ টাকা ওই হিসাবে জমা রাখতে হবে। এটা বাধ্যতামূলক। একটি চলতি হিসাব সুন্দরভাবে দুই বছর পরিচালনা করতে পারলে অর্থাৎ লেনদেন নিয়মিত করলে পাশাপাশি ব্যবসায়ের ট্রেড লাইসেন্সটি সময়মতো নবায়ন করলে ব্যাংক বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওই চলতি হিসাবের বিপরীতে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহী হয়ে থাকে। ব্যাংক হিসাব হয়ে যাওয়ার পর একজন উদ্যোক্তার উচিত একটি ব্যক্তিগত টিন সার্টিফিকেট সংগ্রহ করা। উদ্যোক্তার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানটি যদি লিমিটেড কোম্পানি হয়ে থাকে; সেক্ষেত্রে কোম্পানির একটি টিন সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হবে। কারণ কোম্পানি আলাদা একটি সত্তা। টিআইএন বা টিন সার্টিফিকেট বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। টিন সনদ পেতে গেলে একজন উদ্যোক্তার অবশ্যই নিজের এনআইডি কার্ড ও এনআইডি কার্ডের নাম্বার, আবেদনকারীর নাম, আবেদনকারীর পিতা ও মাতার নাম, আবেদনকারীর স্বামী অথবা স্ত্রীর নাম, আবেদনকারীর বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা প্রয়োজন হয়। অবশ্যই তথ্যগুলো জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী হতে হবে।

সব উদ্যোক্তাই চান তাদের কিছু ব্র্যান্ড থাকবে। সেই ব্র্যান্ডনাম খচিতপণ্য ভোক্তা বা ক্রেতারা ব্যবহার করবেন। সেজন্য একজন উদ্যোক্তা প্রত্যাশা তার পণ্যের নাম বা ব্র্যান্ডটি নিবন্ধিত হোক। যাকে ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন বলে। ট্রেডমার্ক নিবন্ধন পেতে হলে প্রথমে বাংলাদেশের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রার বরাবরে পণ্যের ধরন অনুযায়ী আবেদন করতে হবে। আবেদনের সঙ্গে প্রয়োজনীয় আবেদন ফি জমা দিতে হয়। কত ধরনের পণ্যের বা সেবার জন্য নিবন্ধন চাওয়া হয়েছে, তার ওপর নির্ভর করে নিবন্ধন ফি কত হবে। তবে প্রথমেই পণ্য ও সেবার আন্তর্জাতিক শ্রেণি বিভাগ অনুযায়ী পণ্য কোন শ্রেণিভুক্ত, তা আবেদনে লিখতে হবে। আন্তর্জাতিক নাইস এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী পণ্যের শ্রেণি জেনে নিতে হবে। আবেদন জমা দেওয়ার পর পরীক্ষা করে দেখা হয়। আবেদন ত্রুটিপূর্ণ বা আপত্তিকর হলে লিখিত জানিয়ে দেওয়া হবে। তখন উদ্যোক্তা বা আবেদনকারী জবাব প্রদান এবং শুনানির সুযোগ পাবেন। জবাব সন্তোষজনক না হলে আবেদনটি প্রত্যাখ্যাত হবে।

ট্রেডমার্ক হয়ে যাওয়ার পর বাধ্যতামূলক কিছু পণ্যের জন্য বিএসটিআই সনদ নেওয়া অতীব জরুরি। বিএসটিআই সনদ পেতে হলে উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীকে তার প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্সের কপি, ট্রেডমার্ক আবেদনের কপি, টিআইএন বা টিন সার্টিফিকেটের কপি দাখিল করতে হয়। তাছাড়া পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির তালিকা, উৎপাদনের প্রসেস ফ্লো চার্ট, কারখানার লেয়াউট, পণ্যের মোড়কে থাকা সব তথ্যাবলি ও পণ্য উৎপাদনের উপাদানগুলোর তালিকা প্রস্তুত করে বিএসটিআই লাইসেন্সের আবেদন ফর্ম সংগ্রহ করতে হবে। আবেদন ফর্ম যথাযথভাবে পূরণ করে নির্ধারিত আবেদন ফি জমা দিতে হবে। আবেদন ফি প্রদানের পর সব কাগজপত্র একত্র করে বিএসটিআইয়ের ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারে জমা দিতে হবে। এরপর সাধারণত ১-২ মাসের মধ্যে বিএসটিআই কর্মকর্তারা উদ্যোক্তার কারখানা পরিদর্শন করবেন। কর্মকর্তারা কারখানার উৎপাদিত পণ্য থেকে কিছু পণ্য স্যাম্পল হিসেবে সিল করবেন এবং কারখানার আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো যাচাই করে দেখবেন। এরপর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট টেস্টিং ফি প্রদানপূর্বক ওই কর্মকর্তাদের সিলকৃত পণ্য পুনরায় বিএসটিআইয়ের ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারে গিয়ে জমা প্রদান করতে হবে। পরবর্তীতে বিএসটিআই ল্যাবে পণ্যের পরীক্ষা করা হবে এবং মান যাচাই করা হবে। বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত মানের সঙ্গে যদি উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীর উৎপাদিত পণ্যের মান সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়; তবে কর্তৃপক্ষ চূড়ান্ত লাইসেন্সের জন্য জানাবে। চূড়ান্ত লাইসেন্স ফি প্রদানের মাধ্যমে একজন উদ্যোক্তা পেয়ে যাবেন তার কাক্সিক্ষত পণ্যের বিএসটিআই লাইসেন্স।

লেখক : শিক্ষক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ব্যবসায়িক,দলিল
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close