ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন
প্রকৃতি সংরক্ষণে আমাদের করণীয়
প্রতি বছর ২৮ জুলাই পালিত হয় বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস ২০২২। এই দিবসটি উদ্যাপনের মূল লক্ষ্য হলো প্রকৃতির রক্ষা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের জন্য সর্বোত্তম উপায়টি বেছে নেওয়া। এ দিবসটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ আমরা আমাদের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছি। উন্নয়নমূলক কাজে প্রতিনিয়ত বৃক্ষনিধন প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত করছে। নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে পাখিসহ বিভিন্ন উদ্ভিদনির্ভর প্রাণীদের আশ্রয়স্থল ধ্বংস হচ্ছে, পরিবেশে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে, যা আগামী দিনে আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপ। ব্যাপক হারে নগরায়ণ এবং শিল্পায়নের ফলে কল-কারখানা এবং গৃহস্থালির বর্জ্য যথাস্থানে না ফেলা, অধিক হারে যানবাহন ব্যবহার, খাদ্যচাহিদা মেটাতে কৃষিজমিতে অধিক পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার, নদী ভরাট, কাজের জন্য গ্রামীণ মানুষদের শহর অভিমুখী হওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকাণ্ড প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে ব্যাপক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অসংখ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছি আমরা। মানবজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আমাদের প্রকৃতি সংরক্ষণের দিকে সোচ্চার হতে হবে। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ এবং উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবে।’ সুতরাং অধিক হারে বৃক্ষরোপণ, শিল্পায়নের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু সংরক্ষণ, পরিবেশ দূষণ রোধে সচেতন হওয়া ইত্যাদি সোচ্চারমূলক কার্যক্রমই পারে প্রকৃতি সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে। প্রকৃতি সংরক্ষণের ফলে সমৃদ্ধ হবে দেশ, সমৃদ্ধ হবে জাতি। আজকের বিষয় নিয়ে কলাম লিখেছেন জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা গবেষক ডা. এম এম মাজেদ তার কলামে লেখেন... প্রকৃতি মানুষ ছাড়া বাঁচতে পারে, মানুষ প্রকৃতি ছাড়া বাঁচতে পারে না। আবার প্রকৃতি মানুষ থেকে কিছুই না নিয়ে বাঁচতে পারে, মানুষ পারে না। এমনিভাবে প্রকৃতির মধ্যেও আছে রকমভেদ। প্রকৃতির প্রাণকেন্দ্র পৃথিবীর মূল সম্পদ হলো ভূমি, পানি ও পরিবেশগত বৈচিত্র্য। আর পরিবেশ বৈচিত্র্যের অন্যতম কারিগর উদ্ভিদ। পৃথিবীর মোট উদ্ভিদ প্রজাতির ভেতরকার ২৫ ভাগই বৃক্ষ। আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ অমূল্য বৃক্ষ ছাড়া কল্পনা করা অবান্তর। তাই ইসলাম এই প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণে জনসচেতনতা তৈরিতে কালজয়ী নির্দেশনা প্রদান করেছে। আজ দুই বছর ধরে করোনা ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে আনা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে বিজ্ঞানীদের জন্য। তাহলে সে সময় আমরা চিকিৎসাবিজ্ঞানের যতই উন্নয়ন করি না কেন, অসংখ্য অজ্ঞাত অণুজীবগুলোর বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মানবজাতির সুরক্ষা নিশ্চিত করা অসম্ভব। এসব সুদূরপ্রসারী ফলাফল থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে আমাদের এখনই প্রকৃতি সংরক্ষণের সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে, এ ক্ষেত্রে একমাত্র উপায় প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগানো। এ ক্ষেত্রেও আমাদের মধ্যে বদ্ধ গতানুগতিক ধারণা কাজ করে যে, গাছের প্রয়োজন মূলত অক্সিজেনের জন্য।
আর পৃথিবীর বেশির ভাগ অক্সিজেন আসে সামুদ্রিক শৈবাল থেকে এবং গাছ যদি অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে দেয় তবু আমাদির চাহিদার ঘাটতি হবে না। তাই আমাদের জানা উচিত যে গাছ পৃথিবীতে মূলত শীতলতা এবং গ্রিনহাউস প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রয়োজন। কিন্তু গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে গাছ নির্বাচন একটি বিষয়। যেমন আামাদের দেশে অর্থনৈতিক লাভের জন্য প্রচুর পরিমাণে ইউক্যালিপটাসগাছ লাগানো হয়। কিন্তু ইউক্যালিপটাসগাছ প্রকৃতির জন্য এত টা ক্ষতিকর যে পানির স্তর নিচে নামিয়ে দেয় এবং এর দহনও বায়ুকে দূষিত করে সে সম্বন্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকেরই অজানা। সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে এবং প্রতিজন যদি এই একটি দিনে একটি করে গাছ ফুল বা সৌন্দর্যবর্ধনকারী ছোটখাটো গাছ ব্যতিরেকে মেহগনি, অশ্বত্থ, বট, নিমজাতীয় বহু বর্ষজীবী পরিবেশের ভারী উপকারী গাছ লাগায় হোক, সেটা পৈতৃক জমি বা সরকারি জমিতে, তাহলে আমার ধারণা মতে এটা একটা মাইলফলক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারবে। পৃথিবীর সাড়ে সাত বিলিয়ন মানুষ যদি একটি করে উপকারী গাছ লাগায় তবে কয়েক দশকের মধ্যেই আমরা প্রাকৃতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে পারি। ইন্টারন্যাশনাল গ্লোবাল বার্ডেন ডিজিজ প্রজেক্টের প্রতিবেদনে বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর ক্ষেত্রে বায়ুদূষণকে ৪ নম্বরে দেখানো হয়েছে। বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর ৫৫ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্যকর পদক্ষেপ ও জনসচেতনতা না বাড়ালে ভবিষ্যতে ভয়াবহ বায়ুদূষণে পড়বে বাংলাদেশ। এ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৭টির লক্ষ্যমাত্রার প্রায় প্রতিটির সঙ্গেই পরিবেশ সম্পর্কিত বিষয় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত। বিশেষভাবে যেসব লক্ষ্যমাত্রা সরাসরি সম্পর্কিত, সেগুলো হলো : এসডিজি-২, খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টির উন্নয়ন ও কৃষির টেকসই উন্নয়ন; এসডিজি-৩, সবার জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা; এসডিজি-৬, সুপেয় পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা; এসডিজি-৭, সবার জন্য জ্বালানি বা বিদ্যুৎ সহজলভ্য করা; এসডিজি-১১, মানব বসতি ও শহরগুলোকে নিরাপদ ও স্থিতিশীল রাখা; এসডিজি-১২ সম্পদের দায়িত্বপূর্ণ ব্যবহার; এসডিজি-১৩, জলবায়ু বিষয়ে পদক্ষেপ; এসডিজি-১৪, টেকসই উন্নয়নের জন্য সাগর, মহাসাগর ও সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণ ও পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করা; এসডিজি-১৫, ভূমির টেকসই ব্যবহার; এসডিজি-১৬, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক সমাজ, সবার জন্য ন্যায়বিচার, সবস্তরে কার্যকর, জবাবদিহি ও অংশগ্রহণমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা; এবং এসডিজি-১৭, টেকসই উন্নয়নের জন্য এসব বাস্তবায়নের উপায় নির্ধারণ ও বৈশ্বিক অংশীদারত্বের স্থিতিশীলতা আনা। কাজেই এসডিজির বাস্তবায়নে পরিবেশের প্রত্যক্ষ প্রভাব প্রতিভাত হচ্ছে।
প্রকৃতি হলো সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে ও মানুষের লাগামহীন দূষণমূলক কর্মের ফলে প্রতিনিয়তই ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি। যে পরিবেশ মানুষকে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে নিজের সবটুকু দিয়ে লালনপালন করছে এ সমাজের মানুষকে, অন্যদিকে সে নির্মম মানুষগুলোই নির্বিচারে ধ্বংস করছে প্রকৃতি। যার ফলে প্রকৃতি দিন দিন ভয়ানক রূপ ধারণ করছে। বাতাসে ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে লাগামহীনভাবে ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে পৃথিবীর আবহাওয়া। শুধু তা-ই নয়, পরিবেশ দূষণের ফলে জলজ প্রাণীদের জলে থাকতে কষ্ট হয় কারণ তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন পায় না। উদ্ভিদরা সতেজ থাকতে পারছে না। বন-জঙ্গল অবাধে উজাড় হচ্ছে, ফলে বাসস্থান সংকটে পড়ছে বন্যপ্রাণীগুলো। পরিবেশের বিপর্যয়ের প্রভাবে অনেক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়, দাবানল, সুনামি, বন্যা, খরা প্রভৃতির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের হার বাড়ছে বিশ্বজুড়ে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বেড়েই চলেছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। আর সে কারণে তলিয়ে যাচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলগুলো। এ বিষয়ে ২০০৭ সালের জাতিসংঘেঘর জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্যানেলে বলা হয়েছিল, ২০৫০ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা ১ মিটার পর্যন্ত বাড়বে। এর ফলে মালদ্বীপ নামক দেশটি পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাবে। এমনকি বাংলাদেশের উপকূলের ১৭ শতাংশ ভূমি চলে যাবে সমুদ্রে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের মাটিতে বাড়ছে লবণাক্ততা ও বাড়ছে বন্যা। মাটির গভীরে পানির স্তর নেমে যাওয়াই দেখা দিচ্ছে সুপেয় পানির সংকট। ঋতুবৈচিত্র্যের ওপর পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে মারাত্মক প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে সাম্প্রতিককালে।
পরিশেষে বলতে চাই, পরিবেশের সংরক্ষণের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করার জন্য বছরব্যাপী বিভিন্ন দিনে ও নামে দিবস পালন করা হয়ে থাকে। স্মরণ রাখতে হবে, শুধু দিবস পালনের মাধ্যমে যেন দায়িত্ববোধ শেষ না হয়ে যায়। দিবস পালনের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি-বেসরকারিভাবে ব্যাপক গবেষণা ও অনুসন্ধান চালাতে হবে। আর প্রকৃতি সংরক্ষণের দায়িত্ব শুধু সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোনো সংস্থানের নয়। এ দায়িত্ব প্রতিটি ব্যক্তির বা প্রতিটি নাগরিকের। কেননা, প্রকৃতি আমাদের আশ্রয়দাতা, আমাদের অক্সিজেনের উৎস। তাই সময় থাকতেই আসুন সবাই নিজে সচেতন হই, অপরকে সচেতন করি, প্রকৃতিকে রক্ষা করি। সবাই একসঙ্গে আওয়াজ তুলি, ‘প্রকৃতিকে ভালোবাসুন, প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করুন’। প্রকৃতি আর প্রকৃতির মধ্যেই আমাদের বসবাস। তাই প্রকৃতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদেরই। বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবসে এটাই হোক সবার প্রত্যয়।
লেখক : প্রাবন্ধিত ও কলামিস্ট