আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা

  ২৬ জুলাই, ২০২২

জাতীয় সুখের প্রতি গুরুত্ব দিন

ফাইল ছবি

দেশকে ভালোবাসা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। প্রাকৃতিক পরিবেশ ঠিক রেখে প্রতিটি নাগরিকের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু সেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেন জিডিপি নির্ভর না হয়। কারণ জিডিপির মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রকাশ শুভঙ্করের ফাঁকি ছাড়া আর কিছুই নহে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ধরুন কোনো একটি দেশে পাঁচজন মানুষ বাস করেন, ১ জনের ১০টি বিমান আছে, তিনি ওই বিমানগুলো দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করেন। আপনি একটি গড় অঙ্ক (জিডিপির) করে তাত্ত্বিকভাবে প্রচার ও প্রকাশ করলেন, যে এমুক দেশে পাঁচজন মানুষের যাতায়াতের জন্য ১০টি বিমান আছে। ওই বিমানগুলো দিয়ে দেশের মানুষরা যাতায়াত করেন। বাস্তবিকভাবে দেখা যায়, শুধু একজন মানুষেরই ১০টি বিমান আছে এবং একজন মানুষই ওই বিমানগুলো দিয়ে যাতায়াত করে থাকেন, যা শতকরা হিসাবে ২০ ভাগ মানুষ বিমানের মালিক ও বিমানে যাতায়াত করেন।

আরো দেখা যাচ্ছে, শতকরা হিসাবে ৮০ ভাগ মানুষের কোনো বিমান নেই ও তারা (৮০ ভাগ মানুষ) বিমানে যাতায়াত করেন না। কিন্তু আপনি তাত্ত্বিকভাবে প্রচার ও প্রকাশ করলেন শতকরা ১০০ ভাগ মানুষের বিমান আছে এবং শতভাগ মানুষ বিমানে যাতায়াত করেন, যা একটি প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নহে। অন্য আরেকটি উদাহরণ দ্বারা আরো সুন্দরভাবে বোঝানো যায়। একটি পাটিগণিত অঙ্কে বলা হলো, কোনো ঘরের দরজা হাফ ওপেন সমান হাফ ক্লোজ (অর্ধেক খোলা সমান অর্ধেক বন্ধ), তাহলে প্রমাণ করে যেকোনো ঘরের দরজা ফুল ওপেন সমান ফুল ক্লোজ (সম্পূর্ণ খোলা সমান সম্পূর্ণ বন্ধ)। তাত্ত্বিকভাবে তা প্রমাণ করা গেলেও বাস্তবিকভাবে প্রমাণ করা যাবে না। প্রমাণ করা সম্ভবও নহে। সম্ভব কি! এজন্য পৃথিবীর অনেক দেশই জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রচার ও প্রকাশ থেকে ফিরে এসেছে। এর অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে ভুটান। ভুটানে জিডিপিকে প্রবৃদ্ধি হিসেবে গণ্য করা হয় না। কারণ আয়ই সুখের একমাত্র অর্থনৈতিক নিয়ামক নয়। বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, সামাজিক অসাম্য সুখের মাত্রাকে প্রভাবান্বিত করে; এগুলো মানবিক ও সামাজিক দুর্যোগও বটে। এজন্যই মোট জাতীয় উৎপাদন থেকে ভুটান এখন মোট জাতীয় সুখের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

২০২০ সালের জুন মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) জানিয়েছিল, ওই সময় পর্যন্ত দেশে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের কাতারে নতুন করে যুক্ত হয়েছে। এরপর প্রতিষ্ঠানটি আর নতুন কোনো জরিপ করেনি, করলে তাদের হিসাবেও দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়া মানুষের সংখ্যা আগের চেয়ে বেশিই দেখাত। সাম্প্রতিক বেসরকারি সংগঠন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (বিআইজিডি) গবেষণায় প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাকালে বাংলাদেশে তিন কোটির বেশি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় দেশে ২১ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছে।

তার পরও ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে শতকরা ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। এই চিত্র দেখে বোঝা যায়, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি মানে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বা সামগ্রিক উন্নয়ন হচ্ছে তা নয়। প্রকৃত উন্নয়ন মাপতে হলে কোনো দেশের ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সামাজিক নিরাপত্তার উন্নতি বিবেচনা করতে হবে। বেসরকারি চাকরিজীবীসহ সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষের আয় বা মজুরি কতটুকু বাড়ছে, তা দেখতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর আকাশছোঁয়া মূল্যের পাগলাঘোড়া যেভাবে দৌড়াছে, তা কোনোভাবেই সরকার লাগাম টেনে ধরে রাখতে পারছে বলে প্রতীয়মান হয় না, তাই সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস বের হয়ে যাচ্ছে।

করোনাকালে বাংলাদেশের হাতেগোনা কিছু মানুষের আয় কয়েক শ গুণ পরিমাণে বাড়লেও মহামারিতে অনেকে কাজ ও চাকরি হারানোর কারণে লাখ লাখ মানুষের আয় কমে গিয়েছে। এজন্যও শহর এবং গ্রামের, সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীদের উচ্চ ও নিম্নশ্রেণির কর্মীদের মধ্যেও আর অনেক প্রকট আকার ধারণ করেছে। আর রাষ্ট্রীয় সেবা অর্থাৎ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবহন সেবার উন্নতি দেখতে হবে। এসব ক্ষেত্রে জনগণ সন্তুষ্ট হলে তবেই দেশ এগোচ্ছে বা উন্নয়ন হচ্ছে বলা যাবে। যার জন্য (১৯৮৬ সালে অলগা টেলিস বনাম বম্বে মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন মামলার রায়ের সিদ্ধান্তে ‘জীবনের অধিকার’ ব্যাখ্যা করে বলেন, জীবনের সঙ্গে জীবিকার অধিকারকেও সন্নিবেশিত করেন। কারণ জীবনের সঙ্গে জীবিকাও জড়িত)।

জিডিপি সম্পর্কে বাস্তব উদাহরণ দেওয়া যায়, তিউনিসিয়ার মাথাপিছু (জিডিপি) আয় বাংলাদেশের প্রায় চার গুণ ছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক অসমতা বাড়ার কারণে ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিউনিসিনিয়ার মোহাম্মদ বোয়াজিজি নামে এক ২৬ বছরের তরুণ দুর্নীতি ও বেকারত্বের প্রতিবাদে প্রতিবাদে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মাহুতির মাধ্যমে বিদ্রোহ শুরু করে। ফলে সেখানে আরব বসন্তের মতো আন্দোলন শুরু হয়। এ ছাড়া এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু আয় ছিল ৪ হাজার ১৫৬ ডলার, যা বাংলাদেশের প্রায় দ্বিগুণ। সেখানে বসবাস করে মাত্র ২ কোটি ২০ লাখ লোক এবং দেশটির আয়তন বাংলাদেশের অর্ধেকেরও কম। অর্থনৈতিক অসমতার কারণে অতিসম্প্রতি শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতিকে পালিয়ে যেতে হয়। তাই শ্রীলঙ্কা এখনো উত্তাল। এসব অসমতার কারণে তিউনিসিয়া ও শ্রীলঙ্কা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তাই টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে জিডিপি নয়, মোট জাতীয় সুখ হওয়া উচিত। করোনা মহামারির নেতিবাচক প্রভাব ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে শহর ও গ্রাম, সর্বত্র বৈষম্য বেড়েছে অভাবনীয় মাত্রায়। বৈষম্য কমানোর প্রতি সরকারের মনোযোগ না থাকলে, এ তথ্য বিপুলসংখ্যক সীমিত আয়ের মানুষ ও গরিব মানুষের দীর্ঘশ্বাস ও হতাশার কারণ হবে বৈকি। তাই বলা যায়, জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রকাশ টেকসই উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। এজন্যই রাষ্ট্রের স্থায়িত্বশীল উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে মোট জাতীয় সুখের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত, জিডিপিকে নয়। লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জিডিপি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close