মো. আরাফাত রহমান

  ২৩ জুলাই, ২০২২

বাংলাদেশের উদ্ভিদ নিয়ে কিছু কথা

বাংলাদেশে রয়েছে প্রায় ছয় হাজার প্রজাতির গাছগাছালি। এর মধ্যে প্রায় তিন শ প্রজাতি বিদেশ থেকে আনা হয়েছে। আটটি প্রজাতি একান্তভাবেই বাংলাদেশের স্থানীয়। বাংলাদেশের উদ্ভিদ প্রজাতির প্রায় পাঁচ হাজারটি আবৃত বীজ উদ্ভিদ এবং চারটি অনাবৃত বীজ উদ্ভিদ। এ দেশে যে পঁচানব্বইটি প্রজাতি বিপন্ন বলে বিবেচিত তার মধ্যে বিরানব্বইটি আবৃত বীজ এবং তিনটি অনাবৃত বীজ উদ্ভিদ। শুধু স্বাদুপানির পরিবেশ থেকেই প্রায় তিন শ প্রজাতির শৈবালের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। অল্প লোনাপানি এবং সামুদ্রিক আবাসে এদের আরো অনেক প্রজাতি রয়েছে। দেশের ছত্রাক সম্বন্ধে তথ্য এখনো সম্পূর্ণ নয়। বাংলাদেশে প্রায় ২৫০ প্রজাতির ব্রায়োফাইট রয়েছে এবং এ দেশে প্রাপ্ত প্রায় দুই শ পঞ্চাশটি টেরিডোফাইট প্রজাতির মধ্যে দুই শ তিরিশটি ফার্নজাতীয়।

যোসেফ ডালটন হুকার ও তার সহকর্মী টমাস টমসন সিলেট, সুন্দরবন ও চট্টগ্রাম থেকে পর্যাপ্ত সংগ্রহসহ ব্যাপক উদ্ভিদ সন্ধান চালান। ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত হিমালয়ান জার্নালে হুকার ধারাবাহিকভাবে ভ্রমণকথা ও সেখানকার উদ্ভিদজগতের বর্ণনা লিখেছেন। ১৮৫০ সালের ১ মে কলকাতা থেকে এক দীর্ঘ নৌযাত্রায় তিনি পাবনা, ঢাকা ও মেঘনা নদী পেরিয়ে ছাতক ও সিলেট পৌঁছান। ১৮৫১ সালের জানুযারি মাসে কলকাতা ফেরার পথে তিনি কিছুটা নৌকায়, কিছুটা হেঁটে সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম, হাতিয়া, সুন্দরবন ও ঢাকা অঞ্চলে ভ্রমণ করেন। হুকার ভারত উপমহাদেশের উদ্ভিদ ভূগোল চর্চারও অগ্রদূত। কয়েকজন প্রখ্যাত উদ্ভিদবিদের সহযোগিতায় তিনি তার সাত খণ্ডের রচনা ‘ফ্লোরা অব ব্রিটিশ ইন্ডায়া’ প্রকাশ করেন।

কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিতের অধ্যাপক চার্লস ব্যারন ক্লার্ক পরবর্তী সময়ে পূর্ববঙ্গের স্কুল পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত থাকাকালে আড়াই বছর নৌকায় ভ্রমণ করে প্রায় সাত হাজার উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করেন। তিনি বরিশাল, পূর্ব সুন্দরবন, ঢাকা, যশোর ও চট্টগ্রাম থেকেও নমুনা সংগ্রাহক। ১৮৮৩ সালে আসামে বদলি হলে তিনি গোটা প্রদেশ হেঁটে বিপুলসংখ্যক নমুনা সংগ্রহ করেন। এ ছাড়া রবার্ট লরেন্স হেইনিগ ১৮৯৫ সালে ভারতে পৌঁছে চট্টগ্রাম ও সুন্দরবনে বনকর্তা থাকাকালে বনজ উদ্ভিদ সম্পর্কে ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ করেন।

আইএইচ বার্কিল বোটানিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার অর্থনৈতিক উদ্ভিদবিদ হিসেবে নিজ দায়িত্ব পালনের পর ডেভিড প্রেইনের সঙ্গে আলুর এশীয় প্রজাতিগুলোর পুনঃপর্যালোচনার কর্মকাণ্ডে শরিক হন। সুদক্ষ উদ্যানবিদ যোসেফ প্যাক্সটন মিয়ানমার থেকে গাছের বীজ সংগ্রহের জন্য জন গিবসনকে ভারতে পাঠান। কলকাতা পৌঁছে তিনি নৌকাযোগে মাথাভাঙ্গা ও গঙ্গা নদী পেরিয়ে ঢাকা আসেন এবং সেখান থেকে মেঘনা ও সুরমা নদী দিয়ে ছাতক পৌঁছান। অতঃপর খাসিয়া পাহাড় থেকে এক নৌকাবোঝাই উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করেন, যাতে ছিল মূলত অর্কিড।

বাংলাদেশসহ পূর্ব-ভারত ও লাগোয়া অঞ্চলে উদ্ভিদ সমীক্ষা শুরু হয়েছিল ১৮ শতকের শেষার্ধে কলকাতায় ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেলের বাসভবন প্রতিষ্ঠার পর। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কর্মরত স্কটিশ সার্জন উইলিয়াম রক্সবার্গ ছিলেন অগ্রণী উদ্ভিদ পর্যবেক্ষক। তৎকালীন ভারতের উদ্ভিদবিদ্যায় তার মূল্যবান অবদানের সুবাদে তিনি ভারতীয় উদ্ভিদবিদ্যার জনক হিসেবে স্মরণীয়। বাংলার উদ্ভিদবিদ্যা ও উদ্যানবিদ্যা গবেষণা এবং কাগজ তৈরি ও মুদ্রণের অগ্রদূত হিসেবে উইলিয়াম কেরী বাংলার ইতিহাসে বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছেন।

আরেক স্কটিশ উদ্ভিদবিদ ফ্রান্সিস হ্যামিলটন বর্তমান ফেনীর লক্ষ্মীপুর থেকে ছয় মাইল উত্তরে পাথুরাহাট থাকাকালে সুন্দরবনের গাছপালা সংগ্রহ করেন। এ দেশে তার উদ্ভিদ জরিপ মূলত মেঘনা নদীর পূর্বাঞ্চলে সীমিত থাকে এবং ১৭৯৮ সালে চট্টগ্রাম থেকেও উদ্ভিদ নমুনা সংগ্রহ করেন। ডেভিড প্রেইন ১৮৮৩ সালে এবার্ডিন ও এডিনবরা থেকে চিকিৎসাবিদ্যায় ডিগ্রি লাভের পর মেঘনার পূর্বতীরের লক্ষ্মীপুরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কারখানায় কর্মরত হন। তিনি কলকাতা বোটানিক গার্ডেন ও বোটানিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ারও সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন। তার রচিত বেঙ্গল প্লান্টস ও ফ্লোরা অব সুন্দরবন আজও যথেষ্ট সমাদৃত।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ এবং পৃথিবীর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ফসলের জার্মপ্লাজম সম্পদে সমৃদ্ধ। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ধান, পাট, আখ, চা, তামাক, আলু, ডাঁটাশাক, কলা, বেগুন, মরিচ, তুলা, শিম, লেবু, লিচু, কচু, গাছআলু, বেত, বাঁশ ইত্যাদি। ফসলের আধুনিক জাত গ্রহণের ফলে ও একক চাষের জন্য কতটা বংশানুগত অবক্ষয় ও চাষের জমির মানের অবনতি ঘটেছে সে হিসাব আজও যথাযথভাবে নির্ণয় করা হয়নি। সবগুলো ফসল প্রজাতির জন্য প্রয়োজনীয় অ্যাগ্রোইকোটাইপ ও তাদের অভিযোজ্যতা, ভূমিজ জাতিসমূহ ও তাদের বৈশিষ্ট্য আজও মূল্যায়িত হয়নি, যা এসব ফসলের জন্য আবশ্যক।

জানা যায়, ধানের প্রায় দশ হাজার বিভিন্ন জাত রয়েছে। পক্ষান্তরে, জীন উপাদান বিশেষত বাংলাদেশে বিদ্যমান ফসল-প্রজাতিগুলোর বন্য জ্ঞাতিদের সঠিক পরিচয় এখনো অজ্ঞাত। বংশানুগত প্রকারভেদ যে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে পারে তা অনস্বীকার্য এবং বর্তমান জীব প্রকৌশলগত নতুন প্রযুক্তি বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নতিতে উদ্দীপনা জোগাচ্ছে। বিদ্যমান জীববৈচিত্র্যের যুক্তিসংগত ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনাই শুধু স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে।

সারা পৃথিবীতে গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী উদ্ভিদ প্রজাতি আছে প্রায় পাঁচ হাজার। বাংলাদেশেও পর্যাপ্ত অর্থকরী উদ্ভিদ রয়েছে। এ দেশের মোট সপুষ্পক উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে তিন শ বিশটি অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর মধ্যে এক শ পঞ্চাশটি ফসল প্রজাতিই মুখ্য, বাকিগুলোর বিপণন নির্দিষ্ট এলাকা বা স্থানীয় লোকদের মধ্যে সীমিত। অর্থকরী উদ্ভিদের মধ্যে ধান, গম ও জোয়ারের মতো দানাশস্যের চাষ ব্যাপক। ধানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী উদ্ভিদ পাট, চা এবং আখ। পাট ও চা প্রধান অর্থকরী ফসল। অন্যান্য অর্থকরী উদ্ভিদের মধ্যে আছে তেলবীজ, আলু, মিষ্টিআলু, তামাক, তুলা ও কয়েক জাতের ডাল। ফল হিসেবেও অনেকগুলো প্রজাতির চাষ হয়। কাঁঠাল ও আম এ দেশে পর্যাপ্ত জন্মায়।

অন্যান্য সাধারণ ও অর্থকরী ফল হল কালোজাম, পেয়ারা, আনারস, লিচু, কলা, নারিকেল, কুল, পেঁপে, আমড়া, নানা জাতের লেবু, তরমুজ, শসা, আতা ও শরিফা, বেল ও ডালিম। তিসি, সরিষা, তিল, চীনাবাদাম, কুসুমÑ এগুলোই প্রধান তেলপ্রদায়ী ফসল। শাকসবজির মধ্যে উল্লেখযোগ্য লাউ, কুমড়া, বেগুন, টমেটো, ঢ্যাঁড়শ, পেঁপে, শিম, পালং, মুলা, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ডাঁটা ও লতালু। মূল্যবান কাঠ প্রদায়ী বৃক্ষের মধ্যে সেগুন, গর্জন, শাল, গামারি, সুন্দরি, কড়ই, রেইনট্রি, সিভিট, জারুল, শিশু ও তেলসুর উল্লেখযোগ্য। চর্ব্য হিসেবে ব্যবহৃত সুপারিও গুরুত্বপূর্ণ। আদা, হলুদ, পেঁয়াজ, রসুন, ধনে, কালোজিরা, মরিচ, গোলমরিচ, মেথি, দেশি দারুচিনি ইত্যাদি মসলাও অর্থকরী।

বাঁশ ও বেতের অনেকগুলো প্রজাতি নিত্যদিনের নানা পণ্য তৈরিতে ব্যবহার্য। কাগজ ও মণ্ড প্রস্তুতের প্রধান কাঁচামাল কয়েক প্রজাতির বাঁশ, গেওয়া ও কড়ইগাছ। খয়ের গাছ থেকে রঞ্জক পাওয়া যায়। ডালিয়া, গোলাপ, হাসনাহেনা, মালতি, জুঁই, গন্ধরাজ, গাঁদা, জবা, জিনিয়া ইত্যাদি বাগানের উল্লেখযোগ্য ফুল। প্রধান ভেষজ উদ্ভিদের মধ্যে আছে সর্পগন্ধা, হরীতকী, কুমারিকা, ঘৃতকুমারি, যষ্টিমধু, কুরচি, নক্সভূমিকা, কালমেঘ, নিম, বিষকাঁটালি ও বাসক। মিষ্টি রসের জন্য তাল ও খেজুর প্রসিদ্ধ। অপুষ্পক উদ্ভিদেরও অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে, যেমন মাশরুম ও সামুদ্রিক শৈবাল। ফার্নজাতীয় উদ্ভিদের কিছু প্রজাতি সবজি ও বাহারি গাছ হিসেবে আদৃত। সম্প্রতি বাংলাদেশে কিছু বিদেশি অর্থকরী উদ্ভিদের চাষ চলছে, যেমন ভুট্টা, সয়াবিন, মেহগনি, অ্যাকাসিয়া, সূর্যমুখী, আঙুর ও রাবার।

১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরিও-ত আহূত শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্বের সব জাতির প্রতিনিধিরা জীববৈচিত্র্য কনভেনশন নামের এক দলিলে স্বাক্ষর করেন এবং তাতে গোটা মানবজাতির কল্যাণের জন্য নিজ নিজ দেশে জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তায়। বাংলাদেশও এ সনদের স্বাক্ষরদাতা। সব শিল্পোন্নত দেশ ও অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশ এরই মধ্যে নিজ নিজ রাজনৈতিক ভৌগোলিক এলাকার বিপন্ন প্রজাতির সম্পূর্ণ তালিকা প্রস্তুত এবং নাম, শনাক্তির তথ্যাদি, চিত্র, দেশ ও দেশের বাইরে প্রজাতির বিস্তার, প্রাকৃতিক পরিবেশে বিপন্ন প্রজাতির অবস্থান, বিপন্নতার সুনির্দিষ্ট কারণ, সংরক্ষণের সর্বোত্তম উপায় ইত্যাকার সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি সরবরাহ করেছে। এসব তথ্যের সংকলন রেড লিস্ট নামে পরিচিত এবং এটি বিপন্ন প্রজাতিসমূহ সংরক্ষণের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জাতীয় সংরক্ষণ কৌশলের জন্য পয়োজনীয় সহায়ক দলিলের একাংশ হিসেবে বাংলাদেশের সম্ভাব্য বিপন্ন ২৫ প্রজাতির দারু-উদ্ভিদের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। সাম্প্রতিক এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের অন্যূন ৯৫টি সপুষ্পক উদ্ভিদ প্রজাতি নানা পর্যায়ে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এ তালিকার তথ্যানুসারে অবিলম্বে ব্যাপক ও অর্থপূর্ণ সংরক্ষণের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন আবশ্যক। ১৯৭৫ সালে গৃহীত এবং বাংলাদেশসহ ১৪০টি দেশ কর্তৃক সমর্থিত বিপন্ন প্রজাতির আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কনভেনশন অনেক জাতের গাছপালা ও জীবজন্তুর ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এর তালিকাভুক্ত এবং বাংলাদেশের জন্য সবিশেষ উদ্বেগজনক এ ধরনের উদ্ভিদ হলো অর্কিড ও ঔষধি গাছপালা। কাঠ সংগ্রহের সময় অর্কিডের ব্যাপক ধ্বংসের দরুন নান্দনিক দিক থেকে মূল্যবান এ প্রজাতিগুলো অত্যন্ত দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে, আর যথেচ্ছা সংগ্রহের জন্য লোপ পাচ্ছে ভেষজ গাছগাছালি, যা আমাদের অস্তিত্ব সংকটের প্রশ্নে একটি অশনিসংকেত।

লেখক : সহকারী কর্মকর্তা,

ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বাংলাদেশ,উদ্ভিদ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close