আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

  ২১ জুলাই, ২০২২

হজের আমলগুলো ধরে রাখুন

মহিমান্বিত হজের আধ্যাতিক সাধনায় হাজিরা যে পবিত্র আত্মার অধিকারী হয়ে থাকেন, তার উপমা সদ্য ভূমিষ্ট নিষ্পাপ শিশুর মতো। হজের যে সফর, তা দুনিয়াবী কোনো আনন্দ ভ্রমণ নয়। এ সফর কেবলই মাওলার নৈকট্য অর্জনের সফর। প্রেমময় এ হজের আনুষ্ঠানকিতা শেষ করে হাজি সাহেবরা এখন যেমন নিজ দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তেমনি হাজি সাহেবদের থেকে দোয়া নেওয়ার জন্য অপেক্ষমান বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করতে না পারা হাজারো মুমিন। কেন না রাসুল (সা) বলেছেন, ‘তুমি যখন কোনো হাজির দেখা পাবে তাকে সালাম দেবে, মুসাফা করবে এবং তাকে অনুরোধ করবে তিনি যেন ঘরে প্রবেশের আগেই তোমার জন্য আল্লাহর কাছে গোনাহ মাফের দোয়া করেন। তারা দোয়া করলে তা কবুল হয়ে যায় এবং গোনাহ মাফ চাইলে তা মাফ করে দেওয়া হয়’- (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৮৯২)।

হজ এমনই এক প্রশান্তিময় ইবাদত, যার কোনো তুলনাই হয় না। যে নয়নজলে প্রভুর প্রেমে ভিজে একাকার কাবার আঙিনা, সে নয়নের চাহনিতে কি আর অন্য কিছু তৃপ্তি লাগে? সে নয়নের তৃপ্তি যে কেবল ওই কালো গিলাফে ঢাকা কাবা দর্শন। প্রেমাসক্ত সে নয়ন বন্ধ করলেই মনের পর্দায় ভেসে উঠে হৃদয়ের কাবা আর সোনার মদিনার প্রতিচ্ছবি। মনের মিম্বারে ধ্বনিত হয় ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক।’ আমি হাজির প্রভু, আমি হাজির। যে দু’হাত পবিত্র কাবার গিলাফ ছুঁয়েছে, যে মুখ জান্নাতি পাথরের স্পর্শ নিয়েছে, যে মন মানবিক গুণে গুণান্বিত হয়েছে, সে হাত, মুখ, মন-মানসিকতাকে মন্দ কাজ থেকে বাঁচানোর জন্যই হাজি সাহেবদেরকে হজের আমলগুলো ধরে রাখা প্রয়োজন। হজের মাধ্যমে হাজিরা যে শুভ্র সফেদ আত্মার অধিকারী হন, তা যেন গুনাহর কালো দাগে জর্জরিত না হয়, সে জন্য হাজিরা হতে হবে আত্মার সাধক। পবিত্রতার সাধনায় তাদেরকে মগ্ন থাকতে হবে সর্বক্ষণ। মোট কথা, তাদের এমন চরিত্রের অধিকারী হতে হবে তাদের দেখলেই যেন বিপথগামীরা সিরাতুল মুস্তাকিমের দিশা পায়। অনেকে মনে করেন হজ করে বুঝি ঘরে বসে থাকতে হয়। অথচ হজ থেকে ফিরে আসা মানে হলো ইবরাহিমী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মোহাম্মদী প্রেমের বার্তা নিয়ে বিশ^ময় ছড়িয়ে পড়া। মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে শান্তিময় পৃথিবী গড়ে তোলা। কিন্তু দুঃখজনক হলো, আমাদের সমাজে এমন অনেক হাজি আছেন, যারা হজ শেষে দেশে ফিরেই নেক আমল থেকে ‘অবসর’ নিয়ে নেন।

এমনো অনেক হাজি আছেন, যাদের আমল আখলাক খুবই নিন্দনীয়। তাদের কথাবার্তা, চাল-চলন, উঠাবসা, লেনদেন, ব্যবসায়-বানিজ্যে হজ্জে মকবুলের কোনো লক্ষণই পরিলক্ষিত হয় না। অথচ হজ কবুল হওয়ার নিদর্শন হলো, জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়া। ভবিষ্যতে গুনাহ থেকে বিরত থাকার দৃঢ়তা বৃদ্ধি পাওয়া। এ কথা তিক্ত হলেও চির সত্য যে হজ কবুল হওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। স্মরণ রাখতে হবে যে, নেক কাজের প্রতিদান হলো নেক কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা আর পাপ কাজের অভিশাপ হলো অব্যাহতভাবে পাপ কাজ করে যাওয়া। তাই অনর্থক ও উদ্দেশ্যহীন কাজে সময় ব্যয় না করে নেক আমলে নিজেকে মগ্ন রাখাই বাঞ্চনীয়। কারণ মুমিনের একটা গুরুত্বপূর্ণ গুণ হলো, অহেতুক কাজ থেকে বেঁচে থাকা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন. ‘নিশ্চয় সফলতা অর্জন করেছে মুমিনগন, যারা তাদের নামাজে বিনীত এবং যারা অহেতুক বিষয় থেকে বিরত থাকে’- (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ১-৩)। অপর এক হাদিসে বলা হয়েছে, ‘ব্যক্তির সুন্দর মুসলিম হওয়ার এক নিদর্শন, অর্তহীন কাজ ত্যাগ করা’- (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২৩১৭)।

হজের মাধ্যমে পাপমুক্তির যে সনদ অর্জিত হয়েছে, তার সংরক্ষণেই যাবতীয় পাপ কাজ থেকে হাজিদের বেঁচে থাকতে হবে। হজ থেকে ফিরে এসে আগের মতো উদাসীন জীবন যাপন করা যাবে না। একজন হাজি সাহেব যেমন অন্য আট দশ জন লোকের মতো গড্ডালিকার প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিতে পারে না, তেমনি হজের সফর এবং সফরে কত টাকা খরচ হলো তা নিয়েও লোকজনের সাথে গল্প করা যাবে না। কেন না লৌকিতা হজের শুভ্রতাকে পুড়ে ছাই ছাই করে দেয়। এইকভাবে ইবদতে গুরুত্ব না দেওয়া, বেচাকেনায় লোক ঠকানো, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা, পর্দাবিহীন চলাফেরা করা হাজির নিষ্পাপ চরিত্রের পবিত্রতাকে নষ্ট করে দেয়। তাই মহিমান্বিত হজের মাধ্যমে যে নিষ্পাপের সনদ অর্জিত হয়েছে, তার গণগরিমা অক্ষুণ্ন রাখতে হাজিদের জন্য কিছু পদক্ষে গ্রহণ করা অপরিহার্য কর্তব্য।

এখানে তেমনই কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো :

১.গোনাহমুক্ত থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করা : হাজিরা সর্বক্ষণ গুনাহমুক্ত থাকার চেষ্টা করবেন। মনে রাখবেন, গুনাহর প্রতি মনোভাব মানুষকে কুফরিতে নিয়ে যায়। তাই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের সংশোধনের দায়িত্ব তোমাদের নিজেদেরই উপর। তোমরা যদি সঠিক পথ অবলম্বন করো, তাহলে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে, সে তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহর কাছেই তোমাদের সকলের ফিরে আসা। এরপর তিনি সে সম্পর্কে জানাবেন যা তোমরা করতে’- (সুরা মায়েদা, আয়াত : ১০৫)।

২.কয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদ নামাজের অভ্যাস করা : নাফসে আম্মারার খাহিশাত মানুষকে গোনাহের দিকে ধাবিত করে। ফলে মানুষ কামনা বাসনার বশবর্তী হয়ে গোনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। সেই খাহিশাতের প্রতিবন্ধক হলো কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদ নামাজ। হজরত আবু উমামা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা) বলেছেন, ‘কিয়ামুল্লাইল (তাহাজ্জুদের সালাত) তোমাদের উপর বিধিবদ্ধ করে নাও। কেন না তা হচ্ছে সালিহিন বান্দাদের অভ্যাস ও ঐতিহ্য, তোমাদের প্রভুর নৈকট্য লাভের উপায়, গোনাহসমূহের কাফফারা এবং পাপ কাজের প্রতিবন্ধক’- (জামে তিরমিজি, হাদিস : ৩০৮০)।

৩.সত্যবাদীতা অবলম্বন: সত্যবাদীতা মুমিনজীবনের অতিব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সত্যবাদীত মানুষকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন, মাগফিরাত ও জান্নাতের পথে পরিচালিত করে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সত্যবাদীতা পূন্য ও নেক আমলের পথ দেখায়, আর নেক আমল জান্নাতের পথ দেখায়। সত্য বলতে বলতে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে ‘সিদ্দিক’ হিসেবে পরিগণিত হয়। আর মিথ্যা পাপের পথ দেখায়, পাপ পাপিকে জাহান্নামে নিয়ে ফেলে এবং মিথ্যা বলতে বলতে ব্যক্তি আল্লাহর খাতায় ‘কাযযাব’ বলে পরিচিত হয়’- (বুখারি, হাদিস : ৬০৯৪)।

৪.গোনাহ থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করা : আল্লাহ তায়ালার সাহায্য ছাড়া গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। এ জন্য চেষ্টার সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালার কাছে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে। শয়তানের প্ররোচনা থেকে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে। হাদিসে চমৎকার একটি দোয়ার কথা বলা হয়েছে। দোয়াটি হলো, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল হাওরি বা’দাল কাওফুর অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমরা আপনার কাছে ভালোর পর মন্দে পতিত তওয়া থেকে পানাহ চাই’- (জামে তিরমিজি, ৩৪৩৯)।

৫.গোনাহ হয়ে গেলে সাথে সাথে তাওবা করা: অভিশপ্ত শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে গোনাহ যদি হয়েই যায়, তাহলে সাথে সাথে তাওবা করে নিতে হবে। কেন না গোনাহ মাফের একমাত্র ওষুধ হলো তাওবা। এ জন্য আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের তাওবা করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা সকলে আল্লাহর নিকট তাওবা করো, নিশ্চয় তোমরা সফলকাম হবে’- (সুরা আন নুর, আয়াত : ৩১)।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

খতিব, কসবা জামে মসজিদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
হজ,আমল
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close