reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১৯ জুন, ২০২২

পোস্ট কোভিড ট্রমা কাটাতে মেডিটেশন, কিন্তু গুণতে হতে পারে ভ্যাট!

ছবি : সংগৃহীত।

একটি খাঁচাবন্দী পাখি। দীর্ঘ বন্দিজীবনের পর খাঁচার দরজা খুলে দেওয়া হলো। কিন্তু ততদিনে সে বন্দিজীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মুক্ত করে দেয়ার পরও সে পাখি খাঁচা ছেড়ে বের হতে পারে না। সে বিশ্বাস করতে পারেনা যা দেখছি তা কি সত্যি?

করোনার বন্দি জীবনের পর আমাদের অবস্থাও হয়ে গেছে অনেকটা তেমন। কর্মব্যস্ত চেনা দিনগুলোতে বড় রকমের একটা ছন্দপতন শুরু হলো ২০২০ সালে। সারাবিশ্বজুড়েই। প্রায় দেড় বছরের বন্দীজীবনের ফলে যে পরিবর্তনটি সর্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করেছে-তা হলো আতঙ্ক, জড়তা ও মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা।

যে কোনো প্রতিকূলতা, দুর্যোগ বা লড়াইয়ের দুটো পর্যায় থাকে। প্রথমটি হলো; প্রত্যক্ষ পর্যায়, যেটা দৃশ্যমান। আরেকটি পর্যায় হলো অদৃশ্য। যার প্রভাব পড়ে মানুষের অন্তর্জগতে।

ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, দ্বিতীয় এই পর্যায়টি যে জাতি বা যে সমাজ সফলভাবে মোকাবেলা করেছে, তারাই এগিয়ে যেতে পেরেছে, সফল হয়েছে। আমাদের দেশের মানুষ করোনাযুদ্ধের প্রথম পর্যায়টি পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় সফলভাবে মোকাবেলা করেছে। এখন প্রস্তুতি প্রয়োজন দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্যে।

যুক্তরাষ্ট্রের মেয়ো ক্লিনিকের মতে, কোভিড পরবর্তী সময়ে কারো কারো মাঝে যে উপসর্গগুলো দেখা দিচ্ছে, তা হলো অবসাদ, শ্বাসকষ্ট, কফ, শরীরের নানা জায়গায় ব্যথা-বেদনা, স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ হ্রাস, ঘুমের সমস্যা, বিষণ্ণতা , ঝিমুনি, ক্লান্তি ইত্যাদি। এ তালিকার অধিকাংশ রোগই মনোদৈহিক অর্থাৎ রোগের প্রভাব দেহে প্রকাশ পাচ্ছে বটে, কিন্তু উৎস হলো মন। এ ধরনের রোগগুলোর জন্যে ওষুধ বা প্রচলিত চিকিৎসা নয়, প্রয়োজন মনের শুশ্রূষা। এ লক্ষ্যে পৃথিবীজুড়ে কার্যকরী যে পথটি বাতলে দিচ্ছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা, তা হলো মেডিটেশন।

স্টিভেনলরিস। নিউরোসায়েন্স বা স্নায়ুবিজ্ঞান গবেষণায় এ কালের একজন নেতৃস্থানীয় ও সুপরিচিত গবেষক। ৩ এপ্রিল ২০২১ যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী নিউ সায়েন্টিস্টকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ব্রেনকে রি-টিউন করার পাশাপাশি মহামারির সুদূরপ্রসারী ও ক্ষতিকর নানা প্রভাব থেকে আমাদের মুক্তি দিতে মেডিটেশনচর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে প্রশ্ন করেন, মেডিটেশন কি কোভিড-১৯ থেকেও আমাদের রক্ষা করতে পারে?

আসলে দুশ্চিন্তা-উদ্বিগ্নতা আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। তাই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে মেডিটেশন একটি অসাধারণ প্রক্রিয়া। আর এটাও প্রমাণিত যে, যে কোনো ভ্যাকসিন (বা রোগের চিকিৎসা) কতটা কার্যকরী হবে, তা অনেকটাই নির্ভর করে ব্যক্তির মানসিক অবস্থার ওপর। সেই বিচারে বর্তমান সময়ে মেডিটেশন অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ।

আমরা সবাই জানি, এই মহামারির প্রভাব থেকে শিশুরাও মুক্ত নয়। তাদেরও স্বাভাবিক প্রাণবন্ত জীবনে ফিরিয়ে আনতে অবশ্যই মেডিটেশনের শিক্ষা দিতে হবে। আশ্চর্য হলেও সত্য, আমাদের স্কুলগুলোতে জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ করার জন্যে অনেক শিক্ষক আছেন, শারীরিক শিক্ষা ও ফিটনেসের জন্যেও শিক্ষক আছেন, তাহলে মনের যত্ন কীভাবে নিতে হবে; সেই শিক্ষা দেয়ার জন্যে কোনো শিক্ষক কেন থাকবেন না? এ বিষয়টি আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরেই অবহেলিত। আমি বিশ্বাস করি, একসময় আমাদের প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে পরিণত হবে মেডিটেশন।

তবে আমি রোগীদের মেডিটেশন করার পরামর্শ দেই। যে কোনো সময় যে কোনো জায়গায় মেডিটেশন করা সম্ভব। যানজটে বসেও একজন মানুষ নিজের ভেতরে ডুব দিতে পারে। এতে আমাদের অস্থির-চঞ্চল মনটার ওপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে। সেই সাথে আমরা বর্তমানে মনোযোগী হতে পারি। আর যখনই বর্তমানের চিন্তা ও আবেগগুলোর প্রতি আমরা দৃষ্টি দেই, আমাদের হার্ট রেট কমতে থাকে, ব্লাডপ্রেশার নিয়ন্ত্রণে থাকে, একইসাথে হ্রাস পায় স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল। আর এই প্রতিটি বিষয়ই আমাদেরকে দারুণভাবে সাহায্য করতে পারে কোভিড মোকাবেলার ক্ষেত্রেও।

মেডিটেশনের ওপরও ভ্যাট!

একটি সায়েন্স ফিকশন সিনেমায় দেখেছিলাম, অদূর ভবিষ্যতে বায়ুতে অক্সিজেনের পরিমাণ এতো কমে গেছে যে পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। পানির মতো বিশুদ্ধ অক্সিজেন কিনে ব্যবহার করতে হয়। অদূর ভবিষ্যতের সেই কাল্পনিক যুগ যেন বাস্তবে চলে এলো। মেডিটেশন হলো ধীরে ধীরে লম্বা দম নেয়ার মাধ্যমে দেহ-মনকে স্থির করা। আর এই মেডিটেশনের ওপর ভ্যাট আরোপ, এ-যেন বেশি বেশি অক্সিজেন গ্রহণের মূল্যশোধ করার মতো অবস্থা।

এতো গেল ভবিষ্যতের সায়েন্স ফিকশন। আমাদের অতীত কী ছিল? মুনি-ঋষিরা বৃক্ষের ছায়াতলে বসে ধ্যানচর্চা করতেন। এই যুগে তারা থাকলে অবশ্য তাদের ধ্যান ভঙ্গ করে আমরা ভ্যাট আদায়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। হাস্যকর শোনালেও সত্য যেন তা-ই হতে চলেছে। কোভিডের ডামাঢোলে শারীরিক-মানসিক-সামাজিক-আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষটির জীবনে একটু প্রশান্তির পরশ এনে দিচ্ছিল মেডিটেশন। আর সেই মেডিটেশনে মগ্ন মানুষটিকে এখন গুনতে হতে পারে ভ্যাট। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এমনটাই শোনা যাচ্ছে। নীতিনির্ধারকদের প্রতি আহ্বান, চিকিৎসাসেবার পরিপূরক মেডিটেশনের ওপর থেকে ভ্যাট স্থায়ীভাবে প্রত্যাহার করা হোক।

লেখক : ডা. আয়েশাহান্না, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগ, স্যার সলিমউল্লাহ মেডিকেল কলেজ এন্ড মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
পোস্ট কোভিড,ট্রমা,মেডিটেশন,ভ্যাট
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close