লে.কর্নেল নাজমুল হুদা খান
আমাদের নববর্ষের ইতিবৃত্ত
বাংলা নববর্ষ বা সনের প্রবর্তন ঘটে আজ থেকে প্রায় ৪৬৬ বছর আগে। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ৯৯২ হিজরিতে বাংলা সন গণনা শুরু হয় সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় থেকে। তবে কারো কারো মতে, এটি শুরু হয় গৌড় রাজা শশাঙ্কর আমলে—১২ এপ্রিল ৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দে। তাই কোন কোন ঐতিহাসিক বাংলা দিনপঞ্জি উদ্ভবের কৃতিত্ব আরোপ করেন ৭ম শতকের রাজা শশাঙ্কের উপর। প্রকৃতপক্ষে বাংলা সনকে ভালবেসে নয়, বাংলা সনের জন্ম ঘটে সম্রাট আকবরের এই রাজস্ব আদায়ের আধুনিকীকরণের প্রেক্ষাপটে।
যাই হোক শুরুতে বাংলা সনের মূল নাম ছিল তারিখ-এ-এলাহী। তারিখ-এ-এলাহীর বারো মাসের নাম ছিল কারবাদিন, আর্দি, বিসুয়া, কোর্দাদ, তীর, আমার্দাদ, শাহরিয়ার, আবান, আজুর, বাহাম ও ইস্কান্দার মিজ। কারো পক্ষে আসলে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় কখন এবং কীভাবে এসব নাম পরিবর্তিত হয়ে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র হয়। অনুমান করা হয়, বারোটি নক্ষত্রের নাম নিয়ে পরবর্তীকালে নামকরণ করা হয় বাংলা মাসের। বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, জায়ীস্থা থেকে জ্যৈষ্ঠ, শার থেকে আষাঢ়, শ্রাবণী থেকে শ্রাবণ, ভদ্রপদ থেকে ভাদ্র, আশ্বায়িনী থেকে আশ্বিন, কার্তিকা থেকে কার্তিক, আগ্রায়হন থেকে অগ্রহায়ণ, পউস্যা থেকে পৌষ, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা নক্ষত্র থেকে চৈত্র।
এ ধারাবাহিকতায়ই মূলত পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ এলাকার অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে প্রধান ঘটনা ছিল হালখাতা তৈরি করা। ব্যবসায়ীরা পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলেন । হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে।
আধুনিক নববর্ষ উদ্যাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়।
১৯৬৬ সালে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি পুরনো বাংলা দিনপঞ্জিকে সংশোধিত করে বাংলা প্রথম পাঁচ মাসকে ৩১ দিন, আর বাকি মাসগুলোকে ৩০ দিন বানানো হয়। প্রতি অধিবর্ষে ফাল্গুন মাসে ৩১ দিন ধার্য করা হয়।
১৯৮৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে এই দিনপঞ্জি গ্রহণ করা হয়। এরপর জাতীয় দিনপঞ্জির সূচনা ও প্রতি বছর নববর্ষ ১৪ এপ্রিলেই হয়ে থাকে।
১৪২৬ বঙ্গাব্দে দ্বিতীয়বারের মত সংশোধনী আনা হয়। বাংলা একাডেমি এই পরিবর্তন আনে। এতে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিন—এই ছয় মাস ৩১ দিনে হবে। ফাল্গুন মাস ছাড়া অন্য পাঁচ মাস ৩০ দিনে পালন করা হবে। ফাল্গুন মাস হবে ২৯ দিনের, কেবল অধিবর্ষের বছর ফাল্গুন মাস ৩০ দিনের হবে।
নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। বৈশাখী মেলা এখন বাঙালির প্রাণের উৎসব। ইলিশ -পান্তা এখন আমাদের প্রিয় সংস্কৃতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখের সকালে আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইউনেস্কো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিধ্বনি।
আমার জন্মভূমি ঈশা খাঁর সোনারগাঁওয়ে ব্যতিক্রমী বউমেলা বা বটতলার মেলা সারাদেশে পরিচিতি লাভ করেছে। সোনারগাঁ থানার পেরাব গ্রামের পাশে আয়োজিত ঘোড়ামেলাও এখন লোকমুখে প্রচলিত ও জনপ্রিয়।
পার্বত্য এলাকায় তিনটি জাতিসত্তা ত্রিপুরা, চাকমা ও মারমাদের যৌথভাবে আয়োজিত বৈসাবি উৎসবও আকর্ষণের দিক থেকে অন্যতম।
সময়ের পরিক্রমায় হয়ত বাংলা নববর্ষ পালিত হবে ভিন্ন ভিন্ন রঙ আর অবয়বে। যাই হোক, বাংলা ও বাংলাদেশের শুদ্ধ সংস্কৃতি যাতে এর মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়, এটাই আমাদের কামনা। সকলকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা। শুভ নববর্ষ ১৪২৯।
লেখক : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সহকারী পরিচালক
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল