ডা. আওরঙ্গজেব আরু

  ১৭ মার্চ, ২০২২

ফিরে দেখা

বাঙালির চেতনায় সদাজাগ্রত নাম

বাংলার সবুজ শ্যামল শান্ত এক গ্রাম টুঙ্গিপাড়া। সেই গ্রামের ঐতিহ্যবাহী শেখ পরিবারে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন এক মহান পুরুষ। নাম তার শেখ মুজিবুর রহমান। ছেলেবেলায় বাবা-মা তাঁকে ‘খোকা’ বলেই ডাকতেন। রাজনীতিতে নাম লেখান সেই ছেলেবেলায়। কালের পরিক্রমায় বাংলার গরিব-দুঃখী, চাষি-মজুর, জেলে-শ্রমিক সর্বস্তরের মানুষের চোখের মণি হয়ে ওঠেন তিনি।

নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে পরাধীনতার অর্গল থেকে মুক্ত করতে তিনি পথ দেখাতে থাকেন জাতিকে। অবশেষে বাংলার পুবাকাশে পরিপূর্ণ এক সূর্য হিসেবে আবির্ভূত হয়, বাঙালি জাতি অর্জন করে মুক্তি। টুঙ্গিপাড়ার ‘খোকা’ হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। বাঙালি বিশ্বের যেখানেই থাকুক না কেন, তার আত্মপরিচয়ের ঠিকানা, আত্মমর্যাদার প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। আজীবন সংগ্রামী এই মহামানবের যখন জন্ম হয়, তখন ছিল ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ অধ্যায়। কিশোর বয়সেই বঙ্গবন্ধু সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মূলত ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে মাদারীপুরে স্বদেশি আন্দোলনকারী এবং ভারতের মহান স্বাধীনতাণ্ডসংগ্রামী নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর সমর্থকদের সংসর্গেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত। বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ে তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমি সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম। তাদের সভায় যোগদান করতে মাঝে মাঝে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর যাওয়া-আসা করতাম।’

গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিবাদে জড়িয়ে বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেন। গ্রেপ্তার এড়াতে তাঁকে পালানোর পরামর্শ দেওয়া হলে তিনি রাজি হননি। আজীবন এটাই ছিল তাঁর স্বভাব। পৃষ্ঠ প্রদর্শন-প্রবণতা তাঁর রক্তধারায় ছিল না। গোপালগঞ্জে সভা করে কলকাতায় ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পরই সোহরাওয়ার্দী সাহেব পত্র লিখে গোপালগঞ্জের সভা ও প্রদর্শনী আয়োজন এবং ব্যবস্থাপনায় একাগ্রতা, শ্রম, নিষ্ঠা ও চমৎকার নেতৃত্বের জন্য শেখ মুজিবকে ধন্যবাদ জানান এবং কলকাতা গেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। সেই সূত্র ধরে ১৯৩৯ সালে কলকাতা বেড়াতে গিয়ে তরুণ মুজিব তাঁর সঙ্গে দেখা করেন এবং ধীরে ধীরে সোহরাওয়ার্দী তাঁর রাজনৈতিক গুরু হয়ে ওঠেন। সেই সফরে তিনি নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সভাপতি ও তখনকার বিখ্যাত ছাত্রনেতা আবদুল ওয়াসেকের সঙ্গে আলাপ করে তাঁকেও গোপালগঞ্জে আসতে অনুরোধ করেন। মুজিব শহীদ সাহেবকে বলেন, ‘গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ এবং মুসলিম লীগ দুই-ই গঠন করা হবে।’ যে কথা সেই কাজ। গোপালগঞ্জে ফিরেই তিনি এমএলএ ও মুসলিম লীগ সদস্য খন্দকার শামসুদ্দীনকে সভাপতি করে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের ফরিদপুর শাখা গঠন করেন এবং মুসলিম লীগও গঠন করেন। মুজিব ছাত্রলীগের সম্পাদক এবং মুসলিম লীগের ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। এভাবেই তাঁর প্রত্যক্ষ দলীয় রাজনীতির সূত্রপাত।

গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমান নাম মাওলানা আজাদ কলেজ) ভর্তি হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এই কলেজটি তখন বেশ নামকরা ছিল। এই কলেজ থেকে সক্রিয়ভাবে তিনি ছাত্ররাজনীতি শুরু করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ দেশ বিভাগের বছর এ কলেজ থেকে তিনি বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। পাকিস্তান-ভারত পৃথক হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, যার মাধ্যমে তিনি ওই প্রদেশের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন।

বিশ শতকের ষাটের দশকের প্রথমদিকে শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় রাজনীতিতে প্রাধান্য লাভ করেন। অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতার দ্বারা শেখ মুজিব আওয়ামী লীগকে আন্তদলীয় রাজনীতি থেকে মুক্ত করে দলের মূল স্রোত থেকে কিছু কিছু উপদলের বেরিয়ে যাওয়া রোধ করতে সক্ষম হন। অসম্ভব সম্মোহনী শক্তিসম্পন্ন সংগঠক শেখ মুজিব দলের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পেরেছিলেন। অবিসংবাদিত এই নেতার জীবন চলার পথ ছিল কণ্টকাকীর্ণ। পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলে ৬০-এর দশক থেকেই তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়কে পরিণত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি তাঁর বিখ্যাত ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং এই ছয় দফাকে আখ্যায়িত করেন ‘বাঙালিদের মুক্তি সনদ’ হিসেবে।

১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হন। তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে (মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত সাতটি আসনসহ) জয় লাভ করে। জনগণ তাঁকে ছয় দফা মতবাদের পক্ষে নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট প্রদান করে। ছয় দফা বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাঁর ওপরই বর্তায়। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের সব প্রতিনিধির উপস্থিতিতে রমনা রেসকোর্সে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেন এবং শপথ নেন যে, পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময় তারা কখনো ছয় দফা থেকে বিচ্যুত হবেন না। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ দশ থেকে বারো লাখ মানুষের উপস্থিতিতে ঢাকার তৎকালীন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বজ্রদৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই ঘোষণায় উজ্জীবিত জাতি স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ধারণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

অদম্য সাহস ও আত্মত্যাগ, সাংগঠনিক শক্তি নিজের বাঙালি সত্তার গভীর অনুরণন উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। কখনো স্বভাবের প্রেরণায়, কখনো সযত্ন উৎসাহে তার উন্মোচন ঘটিয়েছিলেন। দেশবাসীকেও তেমনি অনুপ্রাণিত করেছিলেন সেই সত্তার জাগরণ ঘটাতে। দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে এক মোহনীয় স্বপ্ন রচনা করেছিলেন তিনি ধীরে ধীরে, সেই স্বপ্ন সফল করার আহ্বান জানিয়েছিলেন সবার প্রতি। মাত্র ৫৪ বছরের একটি জীবন তিনি পেয়েছিলেন। ৩০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে শুধু পাকিস্তান আমলেই ১৮ বার কারারুদ্ধ হয়ে ১২ বছর জেলে কাটিয়েছেন। ২৪টি মামলা তিনি সাহসের সঙ্গে লড়েছেন এবং দুবার মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে দেশবাসীর অকুণ্ঠ ভালোবাসায় ফিরে এসেছেন। তিনিই প্রথম নেতা যিনি মাতৃভাষায় প্রথম জাতিসংঘে ভাষণ দিয়ে বাংলা ভাষার মুখ উজ্জ্বল করেন। বাংলা ভাষার সম্মানে পৃথিবীব্যাপী ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদ্‌যাপিত হচ্ছে। বাঙালি হিসেবে এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। এমনকি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন সেটাও আজ ইউনেসকো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশীদার।

সন্তানের সঙ্গে পিতার যে সম্পর্ক, বাংলাদেশের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক ঠিক তাই। বঙ্গবন্ধুর কাছে তাই আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ঋণ রয়েছে, তার ত্যাগ ও তিতিক্ষায় ভরা জীবনের ঋণ, তার রক্তের ঋণ। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নাগরিক হিসেবে, ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমাদের আরেকটি সম্পর্ক রয়েছে। তিনি নিজের জীবনে একটি উচ্চ আদর্শের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আমাদের জীবনের আলো হয়ে আছেন। অর্থাৎ তিনি আমাদের একটি দেশ দিয়ে গিয়েছেন এবং একই সঙ্গে রেখে গিয়েছেন একটি অনন্য আদর্শ। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন কাটিয়েছেন অত্যন্ত সাদামাটা। যখন ক্ষমতার শীর্ষে তখনো তিনি বসবাস করেছেন ৩২ নম্বরের একটি সাধারণ বাসায়। আর এ কারণেই দারিদ্র্যপীড়িত বাংলার গণমানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু সর্বোতভাবে মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন। রাজনীতিতে জড়িত হয়েছিলেন দেশের মানুষের দুঃখ ঘোচানোর জন্য। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিজীবন বলতে কিছুই ছিল না। তার ধ্যান-জ্ঞান, স্বপ্নকর্ম সবই ছিল দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য। তাঁর সব জীবনই ছিল বাঙালির জন্য নিবেদিতপ্রাণ। তাই ফাঁসির মঞ্চকেও কখনো তিনি ভয় পাননি।

বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য তাঁর যে ভালোবাসা এবং প্রতিদানে জনগণের যে ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন তার কথা তিনি নানা ভাষণে বারবার ব্যক্ত করেছেন। যেমন : ১৯৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনের পর ১৯৭১-এর ৩ জানুয়ারি জনপ্রতিনিধিদের শপথবাক্য পাঠ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। প্রধানমন্ত্রী আসে এবং যায়। কিন্তু যে ভালোবাসা ও সম্মান দেশবাসী আমাকে দিয়েছেন, তা আমি সারাজীবন মনে রাখব। অত্যাচার, নিপীড়ন এবং কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠকেও আমি ভয় করি না। কিন্তু জনগণের ভালোবাসা যেন আমাকে দুর্বল করে ফেলেছে।’

১৯৪৭-এ উপমহাদেশের বিভক্তির আন্দোলনের পুরোধায় থাকা বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধি, পর্যায়ক্রমিক আন্দোলন ও সর্বশেষে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়ে তিনি যে অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেছেন তাতে এ মহান নেতা শুধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবেই নয়; সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়েই থাকবেন। বাংলাদেশ তথা বাঙালিত্ব তাঁর মননে যেভাবে মিশে ছিল, তার উদাহরণ ১৯৭১-এ পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে থাকা অবস্থায় তার দেওয়া বক্তব্যই স্পষ্ট, ‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ। আমার মৃত্যুর পর আমার দেহ যেন বাংলায় সমাধিস্থ করা হয়।’

বাংলা, বাঙালি, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ এক ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। শেখ মুজিব মানেই বাংলাদেশ। মুক্তিকামী মানুষের স্লোগানের নাম শেখ মুজিব। বাঙালি জাতির চেতনার ধমনীতে প্রবাহিত শুদ্ধতম নাম শেখ মুজিব। তিনি চিরন্তন, চিরঞ্জীব; বাঙালির প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে অবিনাশী চেতনার নাম শেখ মুজিব। তিনি বাঙালি জাতির স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের মহানায়ক,

আবহমান বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের আরাধ্য পুরুষ। ১৭ মার্চ এই মহানায়কের জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট। কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বাঙালি,ফিরে দেখা,মুক্তমত,শেখ মুজিবুর রহমান,প্রধানমন্ত্রী
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close