মাজহার মান্নান

  ১০ জানুয়ারি, ২০২২

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন : একটি ঐতিহাসিক দিন

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সমগ্র বাঙালি জাতি সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা। ২৫ মার্চের মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানকে মাথায় রেখে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন ও নয়াদিল্লি হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন। অগণিত জনতা তাকে স্বাগত জানায় জয় বাংলা স্লোগানে। তিনি দেশের মাটিতে পা রেখেই দেশবাসীকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

শোষণ-নিপীড়নের সীমা যখন ছাড়িয়ে যায় তখনই মুক্তি দূত হিসাবে আর্বিভূত হোন এমন কোনো মহানায়ক, যিনি দাসত্বের শৃংঙ্খল ভেঙে প্রতিষ্ঠা করেন সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা। বিশ্ব ইতিহাসের তেমনি একজন মহানায়ক হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান, যিনি নিপীড়নের দুর্ভেদ্য দেয়াল ভেদ করে বাঙালিদের জন্য নিয়ে এসেছিলেন মুক্তির বারতা এবং স্বৈরাচারের নাগপাশ থেকে দেশকে মুক্ত করে বাঙালিদের উপহার দিয়েছিলে বহু বছরের কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র। তিনি ছিলেন এমনই একজন নেতা, যার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের স্ফুলিংগে তিমিরাচ্ছন্ন গগনে উদিত হয়েছিল স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য এবং যার একটি ভাষণই ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র এবং কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে এক মহাপ্রলয় সৃষ্টি করেছিল, যা এখন রীতিমতো বিশ্ব ইতিহাসের এক অনন্য দলিল।

একটি বদ্ধ প্রকষ্ঠে আটকে পড়া জাতিকে উদ্ধার করার জন্য এমন ভাষণ বিশ্বে বিরল। কৃমি কীটে খাওয়া দগ্ধ শাসনব্যবস্থার বেড়াজালে বন্দি হয়ে পড়েছিল বাঙালি জাতি, আর এমনই এক প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি কালো অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়ে আলোর স্ফূরন ছড়িয়ে ছিল এবং বাঙালির হৃদয়ে স্বাধীনতার স্বাদ পেতে ঝংকার তুলেছিল। অর্ধশত বছর আগে দেওয়া সেই কালজয়ী ভাষণেই মুক্তির আস্বাদন পেয়েছিল বাঙালি জাতি। ঐতিহাসিক সেই ভাষণটি বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল এবং এমনই অনুপ্রেরণামূলক ভাষণ ছিল সেটি, যা মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছিল এবং বুকের তাজা রক্ত দিতে বাঙালি ন্যূনতম কুণ্ঠাবোধ করেনি।

বাংলাদেশ আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে গর্বের সাথে। ৫০ বছর আগে সেই ভাষণটি না দিলে আমরা আজ সুবর্ণজয়ন্তী করতে পারতাম না। মুজিব শতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বাঙালি জাতিকে বিশ্বের দরবারে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন করবে, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এমন একজন মানুষকে নিয়ে দু’কলম লেখার সাহস করছি যাকে হিমালয়ের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আর এই তুলনা কোনো সাধারণ লোকে করেননি। তুলনাটি করেছিলেন কিউবা নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। হিমালয়তুল্য এই মানুষটি হলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি শুধু একজন মহানায়কই নন, তিনি নিজে একটি প্রতিষ্ঠান এবং একটি ইতিহাস।

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া ছোট খোকা ধীরে ধীরে কালের আবর্তে ইতিহাসের মহানায়কে পরিণত হলেন, যেটা মোটেও সহজ ছিল না। জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে তাকে মোকাবিলা করতে হয় অত্যাচার, নির্যাতন আর ষড়যন্ত্রের বিষাক্ত ছোবল। প্রকাণ্ড ঝড়ের মাঝে উত্তাল সাগরে টিকে থাকা তরীর মতো তার জীবন। পাহাড়সম ঢেউ এসেও তার ইচ্ছা তরীকে ডুবাতে পারেনি। এমনটি শুধু কোনো মহাবীরের পক্ষেই সম্ভব। সীমাহীন সাহস, অসীম আত্মবিশ্বাস, উপস্থিত বুদ্ধি, প্রজ্ঞা এবং মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা তাকে নক্ষত্রে পরিণত করেছে।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় তার জন্ম। স্কুল থেকেই তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯৩৯ সালে অসীম সাহসিকতার জন্য শেরে বাংলা তাকে বুকে টেনে নেন। ১৯৪০ সালে তিনি মেট্রিক পাস করেন এবং কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। এ সময় তিনি বেঙ্গল মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ইসলামিয়া কলেজে পড়া অবস্থায় তিনি সক্রিয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন ১৯৬৬ সালে তিনি ৬ দফা পেশ করেন। এর প্রথম দফাটি ছিল স্বায়ত্বশাসন। এটি ছিল মুক্তির সনদ। এ সময় তিনি একাধিকবার গ্রেফতার হন। ১৯৬৮ সালে তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হয় এবং গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৯ সালে তিনি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে কারামুক্ত হন। এ বছর তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরষ্কুশ জয় লাভ করে। ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টালবাহানা শুরু হলে তিনি আন্দোলনের ডাক দেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে তিনি বাংলার মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে কালজয়ী ভাষণ দেন। ২৫ মার্চ রাতে নিরীহ বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়েনার দল। এই রাতেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এরপর তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৭২ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং সরকার প্রধান হন। ১৯৭২ সালে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সংবিধান কার্যকর হয়। তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ যার কাছে নিজের সুখ ছিল খুব তুচ্ছ। তার মতো দূরদর্শী নেতা বিশ্বে বিরল। তিনি ছিলেন গণতন্তের পুজারী এক নির্ভীক দুর্জয় সাহসী জাতীযতাবাদী নেতা। অমানিশার ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত দাসত্বের করাল গ্রাসে নিপতিত একটি জাতির জন্য তিনি এলেন আলোর দিশারী হয়ে। তিনি ছিলেন বিশ্ব আইকন, নেতৃত্বের জাদুকর, ইতিহাসের এক বিরাট মহীরুহ। তিনি ছিলেন সৎ, বলিষ্ঠ, অদম্য, দুর্বার ও বিদ্রোহের অগ্নিশিখা। কিংবদন্তি কালজয়ী এই নেতার কণ্ঠে ছিল ইন্দ্রজাল। যার বজ্রকণ্ঠের ভাষণ ইতিহাসের বড় দলিল হয়ে গেছে। ক্ষণজন্মা এই পুরুষ ছিলেন মুক্তির দিকপাল, এক মহা কাণ্ডারি এবং মানবতাবাদের ক্যানভাসে গণতন্ত্রের দিশারী।

তিনি ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা, এক বিরাট বটবৃক্ষ এবং বাতিঘর, যিনি ছিলেন স্বৈরাচার শাসনের বিরুদ্ধে এক প্রবল ঝড়। সাত কোটি বাঙালির প্রাণের প্রদীপ বিশ্ববরেণ্য এই নেতা ছিলেন দেশপ্রেমের এক মূর্তপ্রতীক। রাজনীতির এই মহাকবি ছিলেন তিমিরাচ্ছন্ন গগনের এক দীপ্ত রবি। শোষণের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক মহা স্ফুলিঙ্গ যিনি মহাপ্রাচীর ভেঙ্গে ছিনিয়ে এনেছেন পতাকা এবং একটি মানচিত্র। বাংলার নৃপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু ছিলেন অকুণ্ঠ, সদাশয় ও দূরদর্শী। জননন্দিত, অবিসংবাদিত, অস্প্রদায়িক, সেক্যুলার, আপোষহীন এই বিশ্বনেতার চলার পথ মোটেও মসৃণ ছিল না।

তার সোনালি দিনগুলো কেটে গেছে রাজপথ, আন্দোলন-সংগ্রাম আর কারাগারের অন্ধ কুঠিরে। স্বপ্নের কারিগর, অনলবর্ষী এই বক্তা তার সহজাত গুণের কারণে ঘুমন্ত বাঙালিকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। বিশ্বের বহু নেতা বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু ফসল ঘরে তুলতে পেরেছেন এমন নজির খুব কম। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এমন এক ব্যক্তি, তিনি যা ভেবেছেন তা শুরু করেছেন, সেটাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এবং সেটার ফসল ঘরে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছেন। আর তার শ্রেষ্ঠত্ব ঠিক এখানেই। ধারাবাহিক সংগ্রামের বলিষ্ঠ এই বীর হিমালয়ের মতো প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন, যা ভেদ করা কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। যার মহান নেতৃত্বে মাত্র নয় মাসে পরাক্রম একটি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাঙালিরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল।

তিনি এমন এক ক্যারিশমেটিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন, যার কথায় ও ভালোবাসার টানে বাঙালিরা জীবন দিতে রাজি ছিল। বাঙালি জাতির মুক্তির দূত, নীতিতে অবিচল, উজ্জীবনী শক্তির ধারক আপন শক্তি বলে প্রকাণ্ড প্রতিবন্ধককে দুমড়ে মুচড়ে ফেলেছিলেন। টর্নেডোর মতো ক্ষিপ্রগতিতে তিনি হাজার বছরের বদ্ধ খাঁচার দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। পরাধীনতার লৌহ শিকলে আটকে থাকা একটি জাতিকে তিনি মুক্ত করেছিলেন। কোনো ভয়, কোনো ষড়যন্ত্র, কোনো ফাঁদ, কোনো হুমকি তার এগিয়ে যাওয়ার পথকে প্রতিহত করতে পারেনি। তার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে ঘটেছিল মুক্তির সমর। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের যে নেতৃত্ব তিনি দিয়েছিলেন, তা বিশ্বে বিরল। ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছিল দেশকে ভালোবেসে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। আজ আমাদের স্বাধীনতা ৫০ পেরিয়ে ৫১ এ পদার্পণ করল। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে আজও আমরা পরাধীন থাকতাম। স্বাধীন দেশে বাস করে মুক্ত বায়ুতে শ্বাস নিতে পারছি এই মহান মানুষটির জন্য। স্বাধীনতার স্বাদ যে জাতি এখনো পাইনি, তারা বোঝে স্বাধীনতার মূল্য কত।

তিনি তার ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখতেন না। তার গগনচুম্বী স্বপ্ন ছিল বদ্ধ প্রকষ্ঠে আটকে থাকা অসহায় মানুষগুলোকে মুক্ত করে স্বাধীনতার স্বাদ দেওয়া। বাঙালি জাতি যে শিকলে বাঁধা পড়েছিল ,সেটা ভেঙে দেওয়াই ছিল তার মহা ব্রত।

তিনি তার মূল স্বপ্নটি পূরণ করতে পেরেছিলেন। মুক্তির পরম স্বাদ তিনি বাঙালিদের দিয়েছিলেন। বিশ্বের একজন ত্যাগী সংগ্রামী নেতা হিসাবে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। অসীম সাহসিকতার জন্য ব্রিটিশ রাজকবি টেড হিউজ বঙ্গবন্ধুকে ‘টাইগার অব বেঙ্গল’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি। বাঙালিয়ানার প্রবাদ পুরুষ এই মানুষটির বাঙালির প্রতি ছিল অগাধ ভালোবাসা। যুদ্ধবিধস্ত দেশটিকে তিনি যখন নতুনভাবে সাজানো শুরু করলেন ঠিক তখনই কতিপয় জঘণ্য কুচক্রী কিছু অমানুষ তার বুকে গুলি চালালো নির্মমভাবে। বিশ্বাসঘাতকদের হাতে প্রাণ হারালেন তিনি ও তার পরিবার। সৃষ্টি হলো ইতিহাসের সবচেয়ে জঘণ্য কলঙ্কিত অধ্যায়।

লেখক : কলামিস্ট ও সহকারী অধ্যাপক, বি এ এফ শাহীন কলেজ কুর্মিটোলা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট [email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন,মুক্তমত,মুজিব শতবর্ষ,বঙ্গবন্ধু
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close