অনিয়মের পক্ষে কি চমৎকার মিছিল!
এটা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। এর দায় প্রশাসন এড়াতে পারে কী? পেশিশক্তির কাছে যদি প্রশাসন জিম্মি হয়, তাহলে যাত্রীদের নিরাপত্তার কি হবে! অনিয়মকে স্থায়ী করার জন্য কি চমৎকার মিছিল! কত মানুষ জ্বলে-পুড়ে-ডুবে, মারা গেল এ নিয়ে বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নয়। তারা এখন অনিয়মের ধারাবাহিকতা ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখতে চায়, যেখানে থাকবে না কোনো জবাবদিহিতা!
রাজধানীর সদরঘাটে গত ৩০ ডিসেম্বর ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করতে গেলে বিক্ষোভ মিছিল করে লঞ্চের শ্রমিক, মাস্টার ও ইঞ্জিনচালকদের সংগঠন। গোয়ার্তুমি ও চাপের মুখে একপর্যায়ে অভিযান স্থগিত হয়ে যায়। অভিযান চলাকালে ভ্রাম্যমাণ আদালত দুটি লঞ্চের যাত্রা বাতিল করলে সদরঘাটের পল্টুনের ওপর বিক্ষোভ শুরু করেন শতাধিক শ্রমিক।
গণমাধ্যমে এসেছে, এতে নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাহ আলম ভূঁইয়া। তিনি ভ্রাম্যমাণ আদালতের সঙ্গে থাকা সার্ভেয়ারের কাছে উত্তেজিত অবস্থায় নানা বিষয়ে জানতে চান। পরে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সার্ভেয়ার মাহবুবুর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা অনিয়মের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করি। কিন্তু নানা হুমকি-ধমকি শুনতে হয়। এখন তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আছেন। কিন্তু আমরা একা সদরঘাটে দায়িত্বপালনের সময় নিরাপত্তা নিয়ে হুমকিতে থাকি।’
তাহলে আবারও প্রমাণ হলো, সরকারের চেয়ে অপরাধীরা শক্তিশালী! এত চাপ যে আইনও অসহায়! তাহলে আইন সবার জন্যে সমান এমন ডায়ালগ কেন? অপশক্তির কাছে সত্য পরাজিত হওয়া খুবই দুঃখজনক। এ কারণেই বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। চাপ দিলেই আইন নাকচ! আইনের পাওয়ার লেস! আমরা মনে করি, কি করে নিরীহ মানুষের মৃত্যু নিয়ে বাণিজ্য বন্ধ করা যায়, কঠোরভাবে এখনই তা নিয়ে ভাবতে হবে। তিনি ডাক্তার কিছু বলা যাবে না, তিনি নার্স কিছু বলা যাবে না, তিনি অস্ত্রধারী সরকারি বাহিনির লোক কিছু বলা যাবে না, তারা মালিক সমিতির লোক, কেউ নৌ শ্রমিক, কেউ মটরযান শ্রমিক কিছু বলা যাবে না। হায়রে দেশের অবস্থা, যখন অব্যবস্থাপনার জন্য শতাধিক মানুষ জীবন বিসর্জন দিল, কেউই বিক্ষোভ প্রতিবাদ জানালো না। যখন ওইসব অব্যবস্থাপনার জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালাচ্ছে, তখন সংশ্লিষ্ট নৌ-শ্রমিক, মালিক পক্ষ বিক্ষোভ মিছিল শুরু করলো? আর সেই চাপে প্রশাসনও দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাবে? দেশে যদি জবাবদিহিমূলক প্রশাসন থাকতো তাহলে কখনোই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।
আধুনিক বাংলা গানের জীবনমুখী ধারার বিশ্বসেরা শিল্পী ‘নচিকেতা’। তার একটি গানে রয়েছে, ‘চোরেরাও দু’দিন পর সংগঠন করবে।’ নচিকেতা চক্রবর্তী একটি আদর্শের নাম। যে আদর্শ সততা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং বিপ্লবের সমন্বয়ে গড়া। আজ এদেশে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে দিতে এমন হয়েছে যে, এখন অন্যায়কারী, আইনভঙ্গকারীরাই বিক্ষোভ আন্দোলন করছে।
৩০ ডিসেম্বরের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা ও বিক্ষোভ মিছিলের বিষয়ে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাহ আলম ভূঁইয়া গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি মিছিলের নেতৃত্ব দিইনি; বরং আমি শ্রমিকদের ফেরত পাঠিয়েছি।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘এখন মোবাইল কোর্টে অনিয়ম ধরা পড়ছে? নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সার্ভেয়ার ও পরিদর্শকরা এত দিন কী করেছেন? তারা লঞ্চে পরিদর্শন না করেই ফিটনেস সনদ দেন।’
এখানে প্রশ্ন হলো, এই ত্রুটিযুক্ত নৌযান নির্মাণের জন্য দায়ী কে? ঘটনা ঘটার পরই ভ্রাম্যমান আদালত তৎপর কেন! তারা এতদিন [দুর্ঘটনার পূর্বে] কোথায় ছিলেন? ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাজ শুধু বিস্কুট, চকলেট আর শাবান-শ্যাম্পুর গায়ে মেয়াদের তারিখ ঠিক আছে কিনা তদারকি করে বেড়ানো? দুর্ঘটনার জন্য প্রথমত দায়ী সরকারি দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা নয় কী? নৌযানের প্ল্যান পাস যারা করেন, সার্ভেয়ার যারা রয়েছেন, যাদের কাজ সরেজমিনে পরিদর্শন করে নির্মাণ ত্রুটি রয়েছে কি-না দেখে সার্ভে সনদ দেওয়া। কিন্তু তারা সরেজমিনে পরিদর্শনে এসে, ‘ভরেজমিনে’ চোখ বুঝে অনুমোদন বা সার্ভেসনদ দিয়ে চলে যাওয়ার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটছে কী? এরপর রয়েছে মালিকদের অতি লোভ, কম বিনিয়োগে অধিক ব্যবসা। তারা বিনিয়োগ বা খরচ কমানোর জন্য দুর্বল অবকাঠামো নির্মাণ, অপর্যাপ্ত ইকুয়েপম্যান্ট দেওয়া ও মানহীন অবকাঠামো নির্মাণ, অপ্রতুল জীবন রক্ষাকারী এবং অপর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম দিয়ে নৌযান প্রস্তুত করে, অসাধু কর্মকর্তাদের দিয়ে অনুমোদন নিয়ে বাম্পার ব্যবসার সুযোগ নিয়ে থাকে।
সব নৌযানে ঝুঁকি নিরসনের জন্য প্রতি মাসে অন্তত একবার ফায়ার ড্রিল (আগুন নেভানোর মহড়া) করার বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু আমাদের দেশে জাহাজগুলোতে এই বাধ্যবাধকতা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না। এ কারণেই অগ্নিকাণ্ড যখন ঘটে, তখন সত্যিকার অর্থেই যথাযথভাবে মোকাবিলার প্রস্তুতি থাকে না।
লেখক : কলামিস্ট