মোহাম্মদ আবু নোমান
সম্পর্ক হলেই কী অন্তঃসত্ত্বা!
ডা. তৃণা ইসলাম নিজের পরিচয় প্রকাশ করে তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ এনে গত ৩ নভেম্বর রাজধানীর সেগুনবাগিচার একটি রেস্টুরেন্টে সংবাদ সম্মেলন করেন। পরর্তীতে গণমাধ্যমে যা এসেছে, তাতে বোঝা গেল তাদের দুজনের বিয়ের কথা ছিল। এর ওপর ভিত্তি করে আবাসিক হোটেলে পারস্পরিক সম্মতিতেই সম্পর্ক করেছেন তারা। এখন পুরুষটি বিয়ে করতে না চাওয়ায় তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করা হয়। একইভাবে সম্পর্ক তৈরির পর একটি মেয়ে যদি আর বিয়ে করতে না চান, তখন ছেলেটিও কী মেয়ের বিরুদ্ধে এভাবে ধর্ষণের অভিযোগ আনতে পারবে?
লিখছিলাম সাধারণ কোনো ব্যক্তির বিষয়াদি নয়, যিনি একজন চিকিৎসক, বিবাহিতা, স্কলার, সন্তানের জননী, যথেষ্ট জ্ঞানসম্পন্ন ও বিবেকবান মানুষ। যিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের সরকারি বৃত্তিপ্রাপ্ত সাবেক মেধাবী শিক্ষার্থী ও সরকারি রোগতত্ব গবেষণা ইন্সটিটিউট আইইডিসিআরে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছিলেন, তিনি ডা. তৃণা ইসলাম। গত ৭ মাস আগে সংবাদ উপস্থাপকের চাকরি নিতে বেসরকারি চ্যানেল ৭১ টেলিভিশনে গেলে বিয়ে করার প্রলোভনে অবৈধ সম্পর্ক গড়েন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বার্তা সম্পাদক শাকিল আহম্মেদ।
সংবাদ সম্মেলনে ডা. তৃণা ইসলাম জানান, ৭ মাসের সম্পর্কে গর্ভপাত করতে হয়েছিল তাকে। তৃণা ইসলামতো জানতেন শাকিলের সংসার আছে, তবে কেন বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন? গত ৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় ভুক্তভোগী ওই নারী বাদী হয়ে গুলশান থানায় মামলা দায়েরের পর রাত ১২টায় তাকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য গুলশান থানা পুলিশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য ভর্তি করেন। পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মো. আসাদুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, মামলায় শাকিল আহমেদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ এবং ভ্রূণ হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
অবৈধ সম্পর্কের ফলাফল কখনো ভালো হয় না। কেউ কাউকে বিয়ের আশ্বাস দিল, আর এতেই তাকে স্বামীরুপে গ্রহণ করা যায়? বিয়ের আশ্বাস দিয়েছে বলেই প্রেগন্যান্ট হতে হবে? বিয়ের প্রলোভন কথাটি কম বয়সী মেয়েদের সাথে যায়, একজন উচ্চশিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত ডাক্তারের ক্ষেত্রে যায় কী? দিনশেষে শুধু পুরুষের সব দোষ ও দায়ভার? এতো ডিগ্রি আপনাকে কী শেখালো? একজন উচ্চশিক্ষিত মহিলা কেমন করে ক্যামেরার সামনে তার পরকীয়ার কথা বলেন? যদিও উচ্চ শিক্ষা এবং সুশিক্ষা মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। উচ্চশিক্ষিত মহিলারা জেনে শুনে অনেক সময় বিবাহিত পুরুষের সাথে সম্পর্ক যুক্ত হন। কিন্তু সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে তারাই আবার কেন ধর্ষণের অভিযোগ আনেন! আমাদের দেশে ধর্ষণের যে সংজ্ঞা তার পরিমার্জন জরুরি নয় কী? কারো প্রলোভনে সব হারিয়ে অভিযোগ করা যায়, কিন্তু নিজের ইজ্জত, সম্মান, সতিত্ত্ব, ফিরে পাওয়া যায় কী? আর যিনি মামলা করেছেন তিনিতো জানতেন শাকিলের সংসার আছে, তবে কেন বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন?
শাকিল আহমেদ অভিযোগ অস্বীকার করে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘একাত্তর টিভিতে থাকার কারণেই ষড়যন্ত্রের লক্ষ্যবস্তু হয়েছি। আমি দারুণ শকড। তারপরও যে কোনো তদন্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সত্য বের হয়ে আসবে।’ অন্যদিকে একাত্তর টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ গত ৬ নভেম্বর গণমাধ্যমকে জানান, ‘হেড অব নিউজ শাকিল আহমেদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে হওয়া মামলার বিষয়টি তারা ‘অত্যন্ত গুরুত্বের’ সঙ্গে খতিয়ে দেখছে।’
গত আগস্টে শাকিল ডা. তৃণা ইসলামকে বিয়ে করার কথা বলে গুলশানের একটি আবাসিক হোটেলে দেখা করেন। সেখানে তাদের মধ্যে সম্পর্ক হয়। পরে সেপ্টেম্বরে একই হোটেলে তারা দেখা করেন। একপর্যায়ে ডা. তৃণা ইসলাম অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। এখানে আমরা কিছুই বুঝলাম না! সম্পর্ক হলেই কি অন্তঃসত্ত্বা হয় নাকি? বিয়ের কথা হলো তো কাজী অফিসে যেতে হয়, আবাসিক হোটেলে কেনো? আগষ্টে না হয় বিয়ের কথা বলায় যাওয়া হলো, কিন্তু সেপ্টেম্বরে আবার আবাসিক হোটেলে যাবার ব্যাখ্যা দেননি ডা. তৃণা। শারীরিক চাহিদা মেটাতে তৃনা ইসলাম ডিলাক্স রুম নিয়ে নিজেই অপেক্ষা করতেন, সেই তিনিই কিনা আবার ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করলেন! ইতিপূর্বেও দেখা গেছে, কোন বিষয় নিয়ে বনিবনা না হলেই এক সময়ের সেক্স পার্টনার বা মিউচুয়াল সেক্সকে নারীরা ধর্ষণে রূপান্তরিত করে ফায়দা নিতে চায়। যেটি শুধুই প্রতারণা।
মেধাবী ডা. হয়েও একজন বিবাহিত পুরুষের প্রেমে কোন শর্তে পড়লেন? যার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে আপনি বিদেশ থেকে পড়ালেখা ছেড়ে চলে আসলেন? আবার কি নির্লজ্জের মত সংবাদ সম্মেলন করে ভ্রূণ হত্যাসহ সব অপকর্মের খাতা খুললেন? এসব ফাঁস করায় আজ আপনার সামাজিক সম্মান ও মর্যাদাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো? হায়রে ভালোবাসা, এসব মানুষ আর ভালোবাসা, দুটোর জন্যই দুঃখ, লজ্জা, ছাড়া আর কি-ই বা বলার আছে। কথায় কথায় যাদের নারীর অধিকার নিয়ে মায়াকান্না, এরা নাকী নারীবাদি। আসলে দেখা গেলো, এরা নারীবাদী নয়, নারী ভোগী?
আমরাতো জানি একাত্তর টেলিভিশন নারী অধিকার নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছে। লড়াই করেছে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে। একাত্তর নামকরণের মধ্যেও রয়েছে, এক ইতিহাস, আবেগ, মর্মবেদনা ও বিজয়! ৭১ মানে একটি শ্লোগান, ৭১ মানে একটি কুমারী মেয়ের সাদা শাড়ি পরা, ৭১ মানেই শেখ মুজিবের বজ্র কণ্ঠস্বর—‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব,’ ৭১ মানে জমাট বাঁধা রক্ত, ৭১ মানে মা-বোনের কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর, ৭১ মানেই আত্মচিৎকার। আমরাতো আজো ভুলিনি কতশত সব শহিদের রক্তে ভেজা এ বাংলাদেশের কথা। ৭১ মানে শিশুর খিদে, মায়ের শোক, ৭১ মানে ধর্ষিত মেধাবী তরুণী, বোনের কান্নায় ফসলের ক্ষেত, ৭১ মানে রক্তে ভেজা চিঠিতে বউয়ের কান্না শোভিত রাত...। মিডিয়া হল যে কোন সভ্য দেশের বিবেক। মিডিয়াকে বলা হয়ে থাকে একটি দেশের তৃতীয় সরকার। সেই মিডিয়া যারা পরিচালনা করেন, লিডার থাকে, তাদের চারিত্রিক অবস্থার যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে সাধারণ জনগণ তথা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কী শিখবে? একাত্তর চ্যানেল প্রতিষ্ঠাকাল থেকে নারী অধিকারের পক্ষের শক্তি হয়ে বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছে। নির্যাতিত-নিপীড়িতদের নিউজ প্রেজেন্টার হিসেবে ষোলোআনা দাবীদার একাত্তর টিভি। এই টিভিতেই তো নারী স্বাধীনতার কথা বলে বেশি।
নারী অধিকার নিয়ে সোচ্চার হওয়া লোকগুলোর চরিত্র যদি এরূপ প্রতারণামূলক হয়, তাহলে সমস্যা গুরুতর। কে দেখলো, কে জানলো, কে শুনলো, নিজের স্ত্রী আছে, আছে সন্তানও তাতে কি আসে যায়? বিবেকের সামনে তারা দাঁড়ায় কীভাবে? একজন সাংবাদিকদের চিন্তা, চেতনা, রুচি, শব্দচয়ন ও ভাষা হতে হয় মার্জিত, পরিশিলিত। দেশের সমস্ত গণমাধ্যমগুলোর মিশন হবে কিশোর-কিশেরারী, যুবক-যুবতীদের সত্যের পথে, আদর্শের পথে অনুপ্রাণিত করা। মিশন হবে, ভদ্র, সভ্য, শান্ত, মার্জিত একটা সমাজ গড়ার অঙ্গীকার। অথচ সে গণমাধ্যমে হেড অফ নিউজ যদি নারী নির্যাতনের অভিযোগে নিজেই নিউজ হন, তা অত্যন্ত কষ্টের ও ব্যাথার।
ভ্রূণ হত্যার দায়িত্ব তাকেই বহন করা উচিৎ যিনি ভ্রূণ গর্ভে ধারণ করেছেন এবং স্বেচ্ছায় তা নষ্ট করেছেন। পুরুষ লোকটি নারীর উপর বল প্রয়োগ করে সঙ্গম করেনি, সঙ্গম করেছে সম্মতিতে। তাই পুরুষের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হলে সেই নারীর বিরুদ্ধেও ধর্ষণের অভিযোগ হতে পরে না? এ জন্য পুরুষ নির্যাতন দমন আইন জরুরি, সংবিধান প্রদত্ত আইনের সম আশ্রয় লাভের অধিকার পুরুষের থাকা উচিৎ। একজন চিকিৎসক তার ভ্রুণকে হত্যা করেছেন, কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের জন্য অন্য একজনকে দায়ী করেছেন, যাকে তিনি একটি কৌশলী হত্যা বলেছেন। এটা খুব মজার শোনাচ্ছে যে, একজন ডাক্তার হয়েও সে কীভাবে তার নিজের ভ্রূণকে হত্যার মতো কোনো ফাঁদে পা দেন? কৌশলে তার গর্ভপাত ঘটানো হয়, কেমন ডাক্তার কৌশল বুঝতে পারেননি? ডাক্তার হিসেবে তার শনাক্তকরণ জ্ঞানের বাইরে থাকা উচিত নয়।
পৃথিবীর সমস্ত ধর্মের বিধানে সেক্স পার্টনার বা ‘বিবাহবহির্ভূত’ সম্পর্ক গ্রহণীয় নয়। কিন্তু বিশ্বব্যাপী অনেক দেশের প্রচলিত আইনে পস্পরের বোঝাপরায় বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বৈধ থাকায় আজকের লেখার বিষয়ের মতো খবর প্রায়ই দেখতে হয়। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা হচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘন, কর্মক্ষেত্রে বা জনপরিসরে যৌন নিপীড়নসহ সহিংসতা নানাভাবে ঘটতে পারে। আপনার সামনে আপত্তিকর কিছু ঘটলে প্রতিবাদ করুন। এভাবে সবার জন্য নিরাপদ একটি পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করতে পারেন আপনি, আমি ও গণমাধ্যম। ধর্ষণ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে সবার উদ্যোগী হতে হবে।
আমাদের দেশে একচ্ছত্র নারীবাদী আইনের কারণে বিচারের ক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক দৃষ্টি দেওয়া হয়। একই রকম অপরাধের নারী-পুরুষের শাস্তি ভিন্ন। যার ফলে আইনের সমঅধিকারের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। বিচারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বা জেন্ডার বিবেচ্য হওয়া উচিৎ নয়। পরিশেষে বলবো, একজন নারীতো মুখ খুললো মামলায় পর্যন্ত গেল, আর যারা গেল না তাদের সংখ্যা কত? অসামাজিক কার্যকলাপের দায়ে শাকিল ও তৃণা ইসলাম দুজনকেই শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক । না হলে সমাজে এমনটাই হতে থাকবে ।
লেখক : কলামিস্ট [email protected]