মো. আবু সাইদ খোকন
শৈশবের সেই খেলাগুলো হারাতে বসেছি আমরা
এখনো শৈশবের খেলার কথা মনে হলে খেলার সঙ্গীদের কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে শৈশবের হারিয়ে যাওয়া খেলা আর স্মৃতির কথা। এরই ধারাবাহিকতায় বরগুনার উপকূল থেকেও দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে পুরোনো খেলা।
‘শৈশব’ শব্দটা শুনলেই কেমন যেন একটা ধূসর গল্পের জগৎ সামনে চলে আসে। নির্ভার, চিন্তাহীন একটা সময়। কত কীই-না করেছি আমরা সে সময়! কত গল্প, কত দুষ্টুমি আর কত খেলা। যারা এখন এই লেখার পাঠক, তাদের শৈশবের স্মৃতি এখন বেশ খানিকটা ফিকে হয়ে গেছে। শৈশবের কথা উঠলেই এখন খেলার সঙ্গী, খেলা, খেলার মাঠ আর কত হাজারো রকমের স্মৃতি ভেসে ওঠে মনে। খেলার সঙ্গীরা এখন কে কোথায়, সেটা জানা নেই। কিন্তু খেলার স্মৃতিটুকু রয়ে গেছে। যে বয়সে শিশুদের বন্ধুদের সাথে খেলা করা কথা, সে শিশুরা এখন ব্যস্ত থাকে স্মার্টফোন নিয়ে। এর থেকে শিশুদের বের করতে হলে সচেতনতা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই।
শিশুদের ফিরিয়ে নিতে হবে শৈশবের সেই খেলার দিকে। খেলাগুলো হলো—
লাটিম : লাটিম বা লাট্টু আমাদের ঐতিহ্যবাহী একটি শিশুতোষ খেলা। লাটিম খেলতে পারে না, এ রকম মানুষ খুব কম আছে আমাদের সমাজে। ছেলেবেলার অত্যন্ত প্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে এটি একটি। নতুন কেনা রঙিন লাটিম দিয়ে কাউকে হারিয়ে দেওয়ার যে সুখস্মৃতি, তা এখনো চোখে লেগে আছে।
গুলি বা মার্বেল : কাচের ছোট্ট গোলাকার কালচে সবুজ মার্বেল খেলেনি কে? সে ধরনের মানুষ খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। কী যে এক উদ্দাম নেশা ছিল কারো কারো এই মার্বেল খেলার প্রতি, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। পকেটে বা কোঁচড়ে মার্বেল নিয়ে ঘুমানোর সেসব দিনের কথা মনে পড়লে নিজের অজান্তে উদাস হওয়া ছাড়া আর কীই-বা করার আছে এখন! স্কুল ছুটি হলে বা স্কুল পালিয়ে মার্বেল কিনতে যাওয়া, বাবা কিংবা বড় ভাইয়ের হাতে ধরা পড়ে পিটুনি খাওয়া বা একবেলা খাওয়া বন্ধ—সেসব দিন কেবলই স্মৃতিকাতর করে তোলে আমাদের।
গোল্লাছুট : বিকালবেলা খোলা মাঠে হইচইয়ের মধ্যে খেলা হচ্ছে গোল্লাছুট। পাড়ার সবাই উপস্থিত। কী করতে হবে আর হবে না, তা নিয়ে খেলোয়াড়দের চেয়ে দর্শকদের চিন্তাই যেন বেশি। এরই মধ্যে দৌড় দিল কোনো এক খেলোয়াড় প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে। এই খেলার সঙ্গেই যেন জড়িয়ে আছে আমাদের রঙিন শৈশবের গল্প।
কিশোর-কিশোরী নির্বিশেষে এই খেলা হয়ে থাকে। দুই দল খেলোয়াড়। এক দল হাতে হাত ধরে পালানোর পথ খুঁজছে। অন্য দল ধরে ফেলার চেষ্টা করছে। ভীষণ উত্তেজনার সে খেলা। খেলার মাঠ হারানোর সঙ্গে সঙ্গে গোলল্লাছুটও হারিয়ে গেছে আমাদের জীবন থেকে।
কানামাছি : কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ—ভরদুপুরের অবসরে এখনো কানে বাজে এই সুর। এক অলৌকিক মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে মস্তিস্কে। সময় হয়তো কিছুটা আটকে যায়। অথবা আমরাই আটকে যাই ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ’র মাদকতায়। ফিরে যাই নির্মল শৈশবের দিনগুলোয়। বিকালের চুরিয়ে যাওয়া আলোয় একদঙ্গল ছেলেমেয়ে চোখ-বাঁধা কানামাছিকে ‘টুকি’ দিতে দিতে সুর করে গলা ছেড়ে গাইছে ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ’। অথবা স্কুলের টিফিনের স্বল্প সময়ে একই দৃশ্যের পুনরাবর্তন। কানামাছি একজনকে ছুঁয়ে দিল, তো নতুন এক কানামাছির জন্ম হলো। এভাবে একের পর এক কানামাছির পরিবর্তন। কিন্তু সুর ও ছন্দ অপরিবর্তনীয়।
দাঁড়িয়াবান্ধা : প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে একটা একটা করে ধাপ পেরিয়ে যাওয়া! প্রতিটি ধাপে ধূর্ত শেয়ালের মতো বুদ্ধি খাটিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে চলা। দুরন্ত শৈশবের উত্তেজনাকর খেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল এই দাঁড়িয়াবান্ধা খেলা।
গ্রামের অত্যন্ত জনপ্রিয় শারীরিক পরিশ্রমের এই খেলা। বিকাল বেলা হইউল্লা হতো, হারজিত নিয়ে ঝগড়া হবে, এই না হলে খেলা! দাঁড়িয়াবান্ধা তেমনই একটি খেলা। ছোট ছোট কোর্ট বানিয়ে খেলা হতো। বিভিন্ন এলাকায় একে বিভিন্ন নামে ডাকা হয় এবং অঞ্চলভেদে এর নিয়মকানুনেও ভিন্নতা থাকে। কিন্তু মূলত প্রতিপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে এক কোর্ট থেকে অন্য কোর্টে গিয়ে পয়েন্ট বাগানোই এই খেলার মূল উদ্দেশ্য। তাই এই খেলায় থাকে উত্তেজনা। ধান কাটা হয়ে গেলে এই খেলার আসর বসত খোলা মাঠে। অবশ্য গ্রামীণ স্কুলগুলোর মাঠেও থাকত দাঁড়িয়াবান্ধার কোর্ট। এখন এটি খুব একটা খেলা হয় না।
ডাং খেলা : একজন ব্যাটসম্যান, চারদিকে নির্দিষ্ট দূরত্বে চার বা পাঁচজন ফিল্ডার। এটা ক্রিকেট নয়, এটা ডাংগুলি খেলা। খেলেছেন নিশ্চয়ই। হয়তো গুলির আঘাতে কপাল বা মাথা কেটে যাওয়ার চিহ্নও আছে আপনার শরীরে। ডানপিটে আর দুর্র্ধষ বালকদের খেলা ছিল এই ডাংগুলি। দের-দুই ফুটের লম্বা ডাং বা লাঠি আর দুই–আড়াই ইঞ্চির ছোট লাঠি দিয়ে খেলা হতো এই ডাংগুলি। ক্রিকেটের মতোই। একজন ছোট লাঠি বা গুলিটিকে ছুড়ে দিচ্ছে ডাং বা লাঠি ধরে থাকা খেলোয়াড়ের দিকে। সে ক্রিস গেইলের মতো পিটিয়ে সেটাকে পাঠিয়ে দিচ্ছে যত দূরে সম্ভব। আবার মাটিতে পড়ার আগে ধরে ফেললেই ব্যাটসম্যান আউট।
মনে পড়ছে কি আপনার শৈশবে খেলা দেশীয় ক্রিকেটের কথা? অঞ্চলভেদে এই খেলার নিয়মেও ভিন্নতা আছে। শিশুদের আবার ফিরিয়ে নিতে হবে শৈশবকালের খেলাধুলার কাছে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী
আমতলী, বরগুনা
[email protected]