লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান

  ০৪ নভেম্বর, ২০২১

শিক্ষার্থীদের কোভিড ভ্যাকসিনের গুরুত্ব

কোভিড-১৯ অতিমারির পর থেকে অদ্যাবধি বিশ্বব্যাপী আক্রান্তের সংখ্যা ২৪ কোটি ৭০ লাখের উপর এবং মৃতের সংখ্যা ৫০ লাখ পেরিয়েছে। এর মধ্যে ১৮ বছরের কম বয়সি ছেলেমেয়েদের আক্রান্তের হার প্রায় ১৩ শতাংশ; মৃতের হার প্রায় শতকরা ১ ভাগ। ১১ মার্চ ২০২০ সালে কোভিড-১৯ কে বৈশ্বিক অতিমারি ঘোষণা করে প্রাণসংহারী ব্যাধির প্রতিরোধে বিভিন্ন গাইডলাইন প্রদান করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সিডিসি ও ইউরোপিয়ান মেডিকেল ইউনিয়ন প্রভৃতি সংস্থা। সে নির্দেশনার আলোকে প্রতিরোধের অংশ হিসেবে ২২৯টি দেশ ও অঞ্চলে বিভিন্ন মেয়াদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ছিল। ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুযায়ী অতিমারি প্রতিরোধে বিভিন্ন দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে বিশ্বের ১৬ কোটি শিশু স্কুলজীবন শুরু করতে পারেনি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খেলাধুলার মাঠ, পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র, পারিবারিক অনুষ্ঠানাদি বন্ধ থাকার কারণে ছেলেমেয়েরা মানসিক চাপের ঝুঁকিতে পড়েছে। তরুণ, শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীনতা, শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া, শিশু শ্রম ও বাল্য বিবাহের মতো ঘটনা দেখা দিচ্ছে সারা বিশ্বে; বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে।

দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর পর ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ধাপে ধাপে খুলে দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্কুলের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ভ্যাক্সিনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছিল প্রথম থেকেই। যেসব শিক্ষার্থীর বয়স ১৮ বছর বা তদূর্ধ্বে তাদের বিষয়ে অনুমোদনবিষয়ক জটিলতা ছিল না। তবে ১২ থেকে ১৮-এর নিচের বয়সি শিক্ষার্থীদের বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল। ইউরোপিয়ান দেশের মধ্যে যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ইতালি, সুইডেন, গ্রিস, ফিনল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, পোল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে ইত্যাদি দেশ ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সি স্কুল শিক্ষার্থীদের কোভিড টিকা দেওয়া শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন; এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ইন্দোনেশিয়া , নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, চীন , হংকং, সিঙ্গাপুর, জাপান, ফিলিপাইন; আমেরিকা অঞ্চলের যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, ব্রাজিল, চিলি, কানাডা, কিউবা ইত্যাদি এবং আফ্রিকা অঞ্চলের দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে স্কুল শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোভিড টিকা কার্যক্রম শুরু করেছে। বেশির ভাগ দেশ টিকা হিসেবে ফাইজার, কিছু কিছু দেশ সিনোফার্ম ও সিনোব্যাক ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করছে।

ফ্রান্স ৬৬ শতাংশ ছেলেমেয়েকে ১ম ডোজ এবং ৫২ শতাংশকে পূর্ণ ডোজ সম্পন্ন করেছে। তবে জার্মানি যেসব বাচ্চার শারীরিক ঝুঁকি রয়েছে শুধু তাদের ভ্যাকসিনের আওতায় এনেছে। সুইডেন যাদের ফুসফুসের রোগ, হাঁপানি বা এ-সংক্রান্ত জটিলতা রয়েছে তাদের ভ্যাকসিন প্রদান করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ১২ বা তদূর্ধ্ব বয়সি ছেলেমেয়েদের জন্য ফাইজার এবং মর্ডানা ভ্যাকসিন প্রয়োগের অনুমোদন প্রদান করেছে এবং জুলাই ২০২১ অবধি ৪২ শতাংশকে প্রথম এবং ৩২ শতাংশকে পূর্ণাঙ্গ ডোজ প্রদান করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি তাদের গবেষণার তথ্যে বলা হয়েছে, ভ্যাকসিন গ্রহণ করা ছেলেমেয়ের চেয়ে ভ্যাকসিনবিহীনদের দেহে সংক্রমণের পরিমাণ ৩.৫ গুণ বেশি। চীনে তাদের প্রস্তুতকৃত সিনোভ্যাক টিকা ৩ থেকে ১৭ বছরের বাচ্চাদের প্রয়োগ শুরু করেছে। ভারতে এ বয়সিদের অক্টোবর ২০২১ অবধি ভ্যাকসিন প্রদানের আওতায় আনার বিষয়ে প্রাথমিক চিন্তাভাবনা করছে। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন গাইডলাইন অনুসরণে ১৮ বছরের নিচের বয়সি ছেলেমেয়েদের ভ্যাক্সিন প্রদান শুরু করেছে। তারা সারা দেশের ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়সি সব ছেলেমেয়ে এবং শারীরিক ঝুঁকি রয়েছে এমন ১২ থেকে ১৫ বয়সিদের ভ্যাকসিনের আওতায় এনেছে। তবে যুক্তরাজ্যের জয়েন্ট কমিটি অব ভ্যাকসিনেশন অ্যান্ড ইমুনাইজিশন (JCVI) ১২-১৫ বছর বয়সি ছেলেমেয়েদের ভ্যাকসিন প্রদান না করার পরামর্শ দিয়েছে। তাদের মতে, এ বয়সিদের ভ্যাক্সিন প্রদানের স্বপক্ষে কোনো অকাট্য তথ্য-উপাত্ত নেই। তারা আরও বলেছে, তাদের গবেষণায় ১০ লাখের মধ্যে মাত্র দুজন ছেলেমেয়ের করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের ইনটেন্সিভ চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে হয়েছে। সুতরাং এ পরিস্থিতিতে তাদের সার্বজনীন ভ্যাক্সিনের আওতায় আনার প্রয়োজন নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) ফাইজার টিকাকে ১২ বছরের ঊর্ধ্বের ছেলেমেয়েদের প্রয়োগের অনুমোদন প্রদান করেছে। ফাইজার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এটি ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সিদের দেহে প্রায় ১০০ শতাংশ কার্যকর এবং ১৬ এবং তদূর্ধ্ব বয়সিদের দেহে সফলতা ৯১ শতাংশ। ২২০০ ছেলেমেয়েকে নিয়ে একটি গবেষণা জরিপে তারা প্রমাণ পান, যে ১০০৫ ছেলে-মেয়েকে ফাইজার ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে তাদের কারো দেহে করোনা সংক্রমণ হয়নি। অন্যপক্ষে ৯৭৮ ভ্যাকসিনবিহীনদের মধ্যে ১৫ জনের দেহে করোনা সংক্রমিত হয়েছে। তারা গবেষণায় দেখেছে, এ ভ্যাকসিন প্রয়োগের পর শিক্ষার্থীদের দেহে ভ্যাকসিন প্রয়োগে তেমন গুরুতর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে ইনজেকশন প্রদানের স্থানে ব্যথা, ফুলে যাওয়া, লাল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি এবং সাধারণভাবে অবসাদ, মাথাব্যথা, পেশিতে ব্যথা, কাঁপুনি, জ্বর ও বমি ভাব দেখা দিতে পারে। ফাইজার কর্তৃপক্ষের গবেষকরা আরো জানিয়েছেন, এ ভ্যাকসিনের মেসেঞ্জার আরএনএ দেহকোষের নিউক্লিয়াসে প্রবেশ করে না তাই ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত করার সম্ভাবনা নেই। এটি করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অনুরূপ অ্যান্টিবডি প্রস্তুত করে সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।

একসময় অভিযোগ ওঠে, এ ভ্যাকসিন হৃৎপিন্ডে প্রদাহ সৃষ্টি করে। যদিও সিডিসির গবেষণায় এর সত্যতা মেলেনি। ফাইজার ও মর্ডানা ৫ থেকে ১১ বছরের ছেলেমেয়েদেরও এ ভ্যাকসিন প্রয়োগের গবেষণা তথ্য শিগগিরই প্রকাশ করতে যাচ্ছে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর তাদের দেশের ৩ থেকে ১৭ বছরের ছেলেমেয়েদের প্রদানের জন্য চীনে তৈরি সিনোফার্ম ভ্যাকসিন অনুমোদন প্রদান করেছে। অক্সফোর্ড এস্ট্রাজেনিকা ভ্যাকসিন কর্তৃপক্ষ ১২> <১৮ বছর বয়সিদের দেহে ব্যবহারের পক্ষে যথেষ্ট তথ্য-উপাত্তের জন্য গবেষণা কার্য পরিচালনা করছে। আমাদের দেশে ধাপে ধাপে দ্রুত সব শিক্ষার্থীকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়াকে সফল ও কার্যকর করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অভিভাবক ও স্বাস্থ্য-সংশ্লিষ্টদের কিছু বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো পরীক্ষিত ফাইজার ভ্যাকসিন প্রয়োগের সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী। দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর শিক্ষাকার্যক্রম পুরোপুরি চালু করার জন্য সব শিক্ষার্থীকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনার ফলে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখিতা, করোনা সংক্রমণ হ্রাস, দৈহিক ও মানসিক সুস্থতায় উন্নতি এবং সার্বিকভাবে শিক্ষায় সমৃদ্ধি আনতে সহায়তা করবে। বাংলাদেশে প্রাথমিকভাবে শহরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন প্রদানের কর্মসূচি সফল করতে বিভিন্ন স্থানে দক্ষ মেডিকেল টিমের সমন্বয়ে ভ্যাকসিন বুথ প্রস্তুত করা হয়েছে। দৈনিক ৪০ হাজার শিক্ষার্থীকে ফাইজার ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। এ লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকায় ২৬টি ভ্যাকসিন প্রদান কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ ভ্যাকসিন প্রদান কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনগুলো প্রাণ ফিরে পাবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। তবে মনে রাখতে হবে, কোনো ভ্যাকসিনই সব ধরনের করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সমভাবে কার্যকর নয়। তাই ভ্যাকসিন গ্রহণের পরও এ বয়সি শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এ বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের সক্রিয় ও সচেতন থাকতে হবে।

লেখক : সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুর্মিটোলা, ঢাকা

ইমেল : [email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
করোনাভাইরাস,মহামারি,টিকা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close