মাজহার মান্নান

  ২৫ অক্টোবর, ২০২১

বেসরকারি শিক্ষকদের পদোন্নতি করুণা নয়, অধিকার

এমপিওভুক্ত কলেজ শিক্ষকদের পদোন্নতি দীর্ঘকাল যাবৎ অনুপাত প্রথার জালে আটকা পড়েছিল। এমনই এক প্রথা ছিল যে, প্রথার কারণে বেশির ভাগ শিক্ষককেই সমগ্র চাকরি জীবনে প্রভাষক হিসাবে থাকতে হয়েছে এবং প্রভাষক হিসাবেই অবসর গ্রহণ করতে হয়েছে। অজগর সাপের প্যাঁচের মতো এই অনুপাত প্রথা থেকে শিক্ষকরা মুক্তি পেলেও আরেক ধরণের নব সংকট তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ এমপিও নীতিমালা ২০২১ (২৮ মার্চ প্রকাশিত) অনুযায়ী অনুপাত প্রথা তুলে দিয়ে এমপিওভুক্ত মোট প্রভাষকের ৫০ শতাংশকে পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এ পদোন্নতিকে আবার দুটি পর্যায়ে নামকরণ করা হয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে প্রভাষক থেকে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক এবং ডিগ্রি কলেজে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক। পদোন্নতির নামকরণ কিছুটা হাসির খোরাক জোগায় এবং একই সাথে মন কষ্টেরও একটি বড় কারণ বটে। একই সুযোগ-সুবিধা থাকবে অর্থাৎ ৬ষ্ঠ গ্রেডে উভয়ই বেতন ও অন্যান্য সুবিধা পাবে শুধু নামের বেলায় একজন জ্যেষ্ঠ প্রভাষক আর অন্যজন সহকারী অধ্যাপক। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পদোন্নতিতে জ্যেষ্ঠ প্রভাষকের পদটি নেই। প্রভাষক-সহাকারী অধ্যাপক-সহযোগী অধ্যাপক-অধ্যাপক এভাবে পদোন্নতির ক্রম সাজানো।

যা হোক, উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ ও ডিগ্রি কলেজে প্রভাষকদের ৬ গ্রেড প্রাপ্তিকে তুচ্ছ করে দেখার সুযোগ নেই। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। নীতিমালা করা হয়েছে ৬ মাস আগে। সেখানে বলা হয়েছে, একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে প্রভাষকদের পদোন্নতি নীতিমালা বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু সেই ধরনের কোন কমিটির কার্যক্রম এখনো শুরু হয়েছে বলে জানা যায়নি। কেন এত বিলম্ব? এরই মধ্যে অনেক শিক্ষক অবসরে চলে গেছেন। নীতিমালা বাস্তবায়নের কালক্ষেপণের দায়ভার কি তবে শিক্ষকদেরকে নিতে হবে? নীতিমালার ১১.৪ ধারায় বলা হয়েছে, ৮ বছর চাকরির সন্তোষজনক পূর্তিতে মোট প্রভাষকের ৫০ শতাংশ পদোন্নতি পাবেন অর্থাৎ কোনো একটি উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে যদি ১২ জন এমপিওভুক্ত প্রভাষক থাকেন তবে নতুন নীতিমালা অনুযায়ী ৬ জন পদোন্নতি ( ৬ গ্রেড)/জ্যেষ্ঠ প্রভাষক হবেন। ডিগ্রি কলেজেও ঠিক একই নিয়ম। শুধু জ্যেষ্ঠ প্রভাষকের স্থলে সহকারী অধ্যাপক প্রাপ্য হবেন।

নীতিমালায় আরো বলা হয়েছে, অন্যান্য প্রভাষকরা ১০ বছর চাকরির সন্তোষজনক পূর্তিতে নবম গ্রেড থেকে অষ্টম গ্রেডে উন্নীত হবেন এবং পরবর্তী ৬ বছর চাকরি পূর্তিতে অর্থাৎ ধারাবাহিকভাবে ১৬ বছর চাকরি সম্পন্ন হলে ৬ গ্রেড প্রাপ্য হবেন। তার মানে কোনো প্রভাষক যদি ১৬ বছর একটানা চাকরি করে থাকেন তবে তার গ্রেড ৬ পেতে কোনো বাধা নেই। সে হিসাবে যাদের চাকরি ১৬ বছর পূর্ণ হয়েছে এমপিওভুক্ত হিসাবে তাদের সবাই এ সুযোগটি পাবেন।

১১.৪ ধারায় বলা হয়েছে, পদোন্নতির বিষয়টি চাকরির নির্দিষ্ট মেয়াদ পূর্ণ করা ছাড়াও আরো কিছু শর্তের ওপর নির্ভর করবে। এক্ষেত্রে ১০০ নম্বরের একটি মূল্যায়ন পর্ব রাখা হয়েছে। চাকরির বয়স, দক্ষতা, সৃজনশীল কাজ, গবেষণা, কোনো মামলা না থাকা, একাডেমিক রেজাল্ট, ক্লাসে উপস্থিতিসহ আরো কিছু শর্ত। সবই ঠিক আছে। শিক্ষকরাও চান তারা তাদের যোগ্যতার মাধ্যমে পদোন্নতি পাক। ১০০ নম্বরের এই মূল্যায়নের কাজটি করবে একটি কমিটি। কিন্তু আমাদের উদ্বেগের জায়গাটি হলো কবে থেকে সেই কমিটি কাজ শুরু করবে। শিক্ষকদের মূল্যায়নের কয়েকটি বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির ওপর মূল্যায়ন কমিটিকে নির্ভর করতে হবে। আর এ ক্ষেত্রেই অনেক শিক্ষকের বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে ম্যানেজিং কমিটির খবরদারি চরমে এবং শিক্ষকদের সাথে তাদের সমন্বয়হীনতা রয়েছে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে ম্যানেজিং কমিটির নেতিবাচক হস্তক্ষেপের ভয়ও অনেক শিক্ষকের রয়েছে। আর এ কারণেই শিক্ষকরা কেন্দ্রীয়ভাবে স্বয়ক্রিয় পদ্ধতিতে পদোন্নতি প্রত্যাশা করেন।


সমগ্র চাকরি জীবনে একটি মাত্র পদোন্নতি। আর সেটা পেতেও যদি পরতে পরতে ধাক্কা খেতে হয়, তবে শিক্ষকতা পেশায় আসার আগ্রহ হারাবেন মেধাবীরা


ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। কোনো শিক্ষকের সকল তথ্য একটি ক্লিকেই দেখা সম্ভব। কেন্দ্রীয়ভাবে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সকল তথ্য এখন আপডেট করে রাখা হয়। শিক্ষকদের বাৎসরিক এসিআরটিকেও আপডেট করে রাখা সম্ভব। একটি সহজ এবং কার্যকরী পদ্ধতির মাধ্যমে কিভাবে পদোন্নতি নীতিমালা দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়, সেটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। পদোন্নতি নীতিমালায় জ্যেষ্ঠ প্রভাষক পদটি বিলুপ্ত করে সহকারী অধ্যাপক প্রবর্তন করা হবে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এর ফলে শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য কমে আসবে এবং দূর হবে অসন্তোষ। যাদের এমপিও বয়স ১৬ বছর হয়ে গেছে, তাদের সকলকে সহকারী অধ্যাপকে পদোন্নতি দেওয়ার কাজটি ত্বরান্বিত করতে হবে। যাদের ১৬ বছর হয়ে গেছে, তারা যেন কোনো ঝামেলা ছাড়াই পদোন্নতি পায় সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

চাকরি জীবনে একটি পদোন্নতি বড় স্বপ্নের বিষয়। প্রতিটি চাকরিজীবী একটি পদোন্নতির অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু সেই অপেক্ষারও তো একটি সময় থাকে। বহু শিক্ষক অপেক্ষায় থেকে থেকে পদোন্নতি না পেয়েই অবসরে চলে গেছেন। অনুপাত প্রথার জাল থেকে মুক্ত হয়ে শিক্ষকরা একটি নতুন স্বপ্নজাল বুনতে শুরু করেছেন মাত্র কিন্তু সেটাও যদি কালক্ষেপণের ফাঁদে পড়ে যায় তবে আর এত কিছুর আয়োজন করে কি লাভ। শিক্ষকরা নীতিমালার আলোকে নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতি নিতে চান। কিন্তু সেটা পেতে যেন তাদের আর নতুন করে গলদঘর্ম হতে না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্টদেরকে সুনজর রাখতে হবে। পদোন্নতিটি যেন মরিচীকা না হয় প্রভাষকদের জন্য, সেটা যেন নিয়মের মধ্য থেকে সহজে তারা পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সমগ্র চাকরি জীবনে একটি মাত্র পদোন্নতি। আর সেটা পেতেও যদি পরতে পরতে ধাক্কা খেতে হয়, তবে শিক্ষকতা পেশায় আসার আগ্রহ হারাবেন মেধাবীরা। যতটুকু প্রাপ্তি আছে ততটুকু যেন প্রভাষকরা সুন্দরভাবে পান সেটা কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকরা এমনিতেই নানা সমস্যায় জর্জরিত, তার ওপরে পদোন্নতি নিয়ে যদি তাদের দুশ্চিন্তা করতে হয় তবে সেটা হবে মরার ওপর খাড়ার ঘা। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, পদোন্নতি কোনো করুণা নয় এটা চাকরিজীবিদের একটি অধিকার।

নীতিমালার ১১.৪ এবং ১১.৫-এ পদোন্নতির বেশ কয়েকটি শর্তের কথা বলা হয়েছে। এ সকল শর্তগুলি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কোনো শিক্ষক যেন বৈষম্যের শিকার না হন সেটা নিশ্চিত করতে হবে। মেধাবীরাক্ত কলেজে প্রভাষকদের জ্যেষ্ঠতা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যেদিন থেকে কোনো প্রভাষকের এমপিও হয় সেদিন থেকে তার জ্যেষ্ঠতা গণনা শুরু হয়। অর্থাৎ কেউ যদি এক দিনেরও সিনিয়র হন তবে তিনি জ্যেষ্ঠ। এমপিওভুক্তির এই জ্যেষ্ঠতাকে অক্ষুণ্ন রেখে পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হবে। সংশোধিত নীতিমালায় মেধাবীরা থেকে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ১৫ নম্বর বরাদ্দ করা আছে। নীতিমালার ১১.৬ অনুচ্ছেদে ১০০ নম্বরের ৯টি মূল্যায়ন সূচক নির্ধারণ করা হয়েছে। এ মূল্যায়ন সূচকের ১০০ নম্বরের মধ্যে ১৫ নম্বর এমেধাবীরার জ্যেষ্ঠতার জন্য বরাদ্দ। বাকি ৮৫ নম্বরের মধ্যে একাডেমিক রেজাল্ট ১৫, ক্লাসে মোট উপস্থিতি ২০, বিরুপ মন্তব্য না থাকা ১০, মামলা না থাকা ৫, সৃজনশীল কর্ম ১০, ভার্চুয়াল ক্লাস নেওয়ার দক্ষতা ১০, উচ্চতর ডিগ্রি ৫, গবেষণা কর্ম ১০।

এই ১০০ নম্বরের মূল্যায়নে যারা এগিয়ে থাকবেন, তারা পদোন্নতি পাবেন। আর এই ১০০ নম্বরের মধ্যে ম্যানেজিং কমিটির হাতে যে নম্বরগুলো আছে সেটা নিয়েই শিক্ষকদের মধ্যে ভীতি কাজ করছে এই ভেবে যে, তারা সঠিক নম্বরটি পাবেন কিনা। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন আর সেটা হলো, বর্তমানে ২৫২৪টি উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি কলেজ রয়েছে। আর এতগুলো কলেজের প্রভাষকদের পদোন্নতি একটি কমিটির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা কতটুকু সম্ভব হবে সেটাই বড় প্রশ্ন। যা হোক, কমিটি যদি দ্রুত কাজ শুরু করে তবে কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলবে। জানা গেছে, এক্ষেত্রে আঞ্চলিক কমিটি গঠন করে কাজকে সহজ করা হবে।

বাংলাদেশ তার সুবর্ণজয়ন্তীয় সাল পার করছে। একই সাথে মুজিব শতবর্ষ বাঙালিরা গর্বের সাথে উদযাপন করেছে। স্বাধীনতার এই সুবর্ণজয়ন্তীতে শিক্ষকরা যেন তাদের প্রাপ্যটুকু পান, সেটাই সবার কাম্য। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের এক রোল মোডেল। সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এত কিছুর পরও শিক্ষকদেরকে বিভিন্ন দাবি আদায়ে প্রেস ক্লাবে প্রায় সারা বছরই দেখা যায়। শিক্ষকরা তাদের প্রাপ্যটুকু বুঝে পেলে প্রেস ক্লাব নয়, তারা শ্রেণিকক্ষেই নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখবেন। জাতি গড়ার এই সকল কারিগরের নায্য প্রাপ্যটুকু যেন যথা সময়ে নিশ্চিত করা হয়, সেটাই হোক আমাদের ব্রত।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক

বি এ এফ শাহীন কলেজ কুর্মিটোলা

ঢাকা, ক্যান্টনমেন্ট

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বেসরকারি শিক্ষক,পদোন্নতি,অধিকার,শিক্ষক,প্রভাষক
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close