এম এ মাসুদ

  ২২ অক্টোবর, ২০২১

নিরাপদ সড়ক দিবস

কোনো দিন না ফেরার চেয়ে, দেরিতে বাড়ি ফেরা ভালো 

ফাইল ছবি

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে উন্নয়ন হয়েছে যাতায়াত ব্যবস্থার। পরিবর্তন সূচিত হয়েছে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রেও। আর এ পরিবর্তন প্রভাব বিস্তার করছে আমাদের রুচির ওপর। প্রদর্শন প্রভাব কার্যকরী হওয়ায় আমরা অনুসরণ করছি একে অপরকে। নামিদামি বাইক অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের বাগাড়ম্বর বৃদ্ধিতে সহায়ক। সময় বাঁচানো, দ্রুততম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছা ও ভ্রমণ আরামদায়ক হওয়ায় বাইকের জুড়ি নেই।

দশক তিনেক আগেও যা খুব স্বল্পসংখ্যক মানুষের হাতে ছিল এবং ব্যবহার করতেন সমাজের বিত্তশালীরা। সময়ের পরিক্রমায় মানুষের বেড়েছে আয়, পরিবর্তন হয়েছে রুচির। অর্থাভাবে আগে যারা বাইসাইকেলও কিনতে পারতেন না, আয়ের পরিবর্তনে তারাও কিনছেন বাইক। বিয়ের যৌতুক হিসেবে তো এখন তা থাকছেই।

তারুণ্যে ভরা কিশোর ও যুবকদের কাছে বিভিন্ন ব্রান্ডের মোটরবাইক বেশ লোভনীয় বাহন। যারই বাইক হোক না কেন, একটু ফাঁক কিংবা চাবি হাতে পেলেই সমবয়সীদের নিয়ে দিচ্ছে ছুট। পথ চলতে গিয়ে কিশোর ও যুবকদের বাইকের গতি দেখে ভয় পেতে হয় পথচারীদের। দুর্ঘটনার পরিণাম জানা সত্ত্বেও অনেক সচেতন অভিভাবক কিশোর সন্তানটির হাতে তুলে দিচ্ছেন দানবরূপী বাইক।

রাস্তায় চোখে পড়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে অধ্যয়ন করছে এমন কিশোরদের কখনো তিনজন কখনোবা চারজন নিয়ে বাইকে চেপে ছুটে যেতে। আবার দল বেধে প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতেও দেখা যায় তাদের। অধিক গতিতে বাইক না চালালে যেন স্বস্তি নেই তাদের।

সে যাই হোক, সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি এখন নিত্যদিনের সংবাদ শিরোনাম। পত্রিকার পাতা উল্টালে কিংবা বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার খবর শুনলে সড়ক দুর্ঘটনার কথা শুনে বিষণ্নতা পেয়ে বসে। যন্ত্রযুগের মানুষ চলছে যান্ত্রিক যানে। সেই যন্ত্রদানবের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ দিচ্ছে আবিষ্কারক মানুষ। কী অদ্ভুত ব্যাপার!

গতকাল টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে ঘুরতে বের হয়ে অজ্ঞাত গাড়ির চাপায় প্রাণ গেল মোটরসাইকেল আরোহী দুই বন্ধুর, গাইবান্ধার পলাশবাড়িতে গ্রামের রাস্তায় ট্রাকচাপায় স্কুলছাত্র নিহত, গত ৮ অক্টোবর টাঙ্গাইলের সখীপুরে ট্রাকচাপায় ২১ বছর বয়সী মোটরসাইকেল চালক খন্দকার ফাহাদ নিহত ও অপর আরোহী ১৭ বছরের আব্দুল্লাহ আল দিমান আহত, বাসের জানালায় ট্রাকের ঘষা লেগে হাত হারালেন বাকৃবি শিক্ষক, ঝিনাইদহের শৈলকুপায় ট্রাকের ধাক্কায় মোটরসাইকেল থেকে পড়ে শিউলি খাতুন নামে এক নারী ব্র্যাক কর্মী নিহত, ৭ অক্টোবর ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলায় বাসচাপায় মোটরসাইকেলের দুই আরোহী নিহত, ৬ অক্টোবর বগুড়ার শাজাহানপুরে মোটরসাইকেলে ট্রাকের ধাক্কা, কলেজছাত্র নিহত, ৩ জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রের হাতে মোটরসাইকেল, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মৃত্যুর মতো এমন সব করুণ ট্রাজেডির জন্ম হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

সড়ক দুর্ঘটনার নানাবিধ কারণ এবং কারণগুলো বিচ্ছিন্ন নয়, বরং একটি অপরটির সাথে সম্পৃক্ত। অধিকাংশ দুর্ঘটনার মূল কারণ গাড়ি চালকদের বেপরোয়া মনোভাব। তারা যখন স্টিয়ারিং ধরে তখন যেন রাজা হয়ে যায়, গতির নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকলেও তারা তা মানতে চায় না। প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি চালানো, ওভারটেক করে আগে যাওয়ার প্রবণতা, রাস্তার মাঝপথ দিয়ে গাড়ি চালানো, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়া, পথচারীদের অসচেনতা, কিশোরদের হাতে তুলে দেয়া, দুই বা ততোধিক আরোহী, অস্বাভাবিক গতি, সাবধানতার সাথে ওভারটেকিং না করা, চালানো অবস্থায় হেডফোন লাগিয়ে গান শোনা, মোবাইলে কথা বলা, প্রশিক্ষণ না থাকা, অন্যমনস্ক হওয়া, পার্শ্বরাস্তা না দেখা, হাট-বাজারে গতি না কমানো, হেলমেট ব্যবহার না করায় বাড়ছে দুর্ঘটনা, ঘটছে মৃত্যু, করছে পঙ্গুত্ববরণ। যা চিন্তার বিষয়।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর মাসে ৩৬২টি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৪৩৯ জনের। এর মধ্যে ১৫৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ১৭৭ জন ও পথচারী নিহত হয়েছেন ৯৩ জন এবং চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত ৯ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৬১ জন সদস্য সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন।

গত ৬ জানুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবে নিরাপদ সড়ক চাই(নিসচা)র চেয়ারম্যানের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২০ সালে ৪০৯২টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪ হাজার ৯৬৯ জন, আহত হয়েছেন ৫ হাজার ৮৫ জন।

প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ আহত হচ্ছেন, কেউ সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হচ্ছেন, আবার কেউ হারাচ্ছেন অকালে মূল্যবান জীবন। বাবা-মা হচ্ছেন সন্তানহারা, সন্তান হচ্ছে বাবাহারা, স্ত্রী হচ্ছেন স্বামীহারা। শুরু হচ্ছে ওই পরিবারে সারাজীবনের কান্না। একটি মাত্র জীবন হারিয়ে গেলেও পরিবারের অনেক দুর্দশার শিকার হতে হচ্ছে গোটা পরিবারের সদস্যদের। অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে পথে বসছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সন্তানদের লেখাপড়া, চিকিৎসা। খাওয়া-পরার যোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে ওই পরিবারের সদস্যরা। মানুষের মৃত্যু অনিবার্য। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যু মেনে নেওয়া খুব কষ্টকর। কিন্তু এমন মৃত্যু থেকে উত্তরণের পথ কী? উত্তরণের পথ হলো—

উৎকোচের বিনিময়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে অনিয়ম বন্ধ করতে হবে, মেনে চলতে হবে ট্রাফিক আইন, হতে হবে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, করতে হবে ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ (স্বজনপ্রীতি বন্ধ), আইন লঙ্ঘনকারীদের কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা, মানসম্পন্ন হেলমেট পরিধান নিশ্চিত করা, বন্ধ করতে হবে মোবাইলে কথা বলা, হেডফোন লাগিয়ে গান শোনা। এছাড়া প্রয়োজন গতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, ঝুঁকি নিয়ে ওভারটেকিং না করা, প্রতিযোগিতা পরিহার করা, হেলে-দুলে বাইক না চালানো, বাইকে দুজনের বেশি উঠা, রাস্তা ফাঁকা থাকলেও দুর্ঘটনা এড়াতে মাঝপথে গাড়ি চালানো পরিহার করতে হবে এবং সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে পথচারীদের। সড়ক দুর্ঘটনা একটি অভিশাপ। এ অভিশাপ সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার চালাতে হবে। প্রচারের অংশ হিসেবে এলজিইডি এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর রাস্তায় রাস্তায় উপদেশমূলক সাইনবোর্ড টাঙাতে পারেন।

যা হোক, আমাদের মনে রাখতে হবে, ‘কোন দিন না ফেরার চেয়ে দেরিতে বাড়ি ফেরা ভালো।,

ভাবতে হবে, বাসায় প্রিয়জনরা অপেক্ষা করছে, তাদের প্রিয় মানুষটির জন্য। আর এ জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। তবেই নিরাপদ হবে সড়ক, কমবে দুর্ঘটনা, বাঁচবে মানুষের প্রাণ, এগিয়ে যাবে দেশ। নিরাপদ সড়ক দিবসে এই প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক, [email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সড়ক দুর্ঘটনা,মুক্তমত
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close