এম এ মাসুদ

  ১৭ অক্টোবর, ২০২১

আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস

দারিদ্র্যকে জয় করতে প্রয়োজন আত্মকর্মসংস্থান

লেখাপড়া শিখে কেবল চাকরির সন্ধান নয়, স্ব-উদ্যোগে কিছু করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। ছবি : প্রতীকী

বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহের নানাবিধ সামাজিক সমস্যার মধ্যে দারিদ্র্য হচ্ছে অন্যতম সমস্যা। মানবজাতির হাজারো সমস্যার মূলে রয়েছে এই দারিদ্র্য। এজন্য দারিদ্র্য একটি অভিশাপ।

ড. হিরোসি নাকাজিমার মতে, ‘দারিদ্র্য হলো বিশ্বের মারাত্মক ব্যাধি।’ তবে উন্নত বিশ্বে দারিদ্র্য যে অর্থে ব্যবহৃত হয়, অনুন্নত দেশে ঠিক সে অর্থে ব্যবহৃত হয় না। সামাজিক প্রেক্ষাপট ও স্থান-কাল ভেদে দারিদ্র্যের প্রকৃতি আলাদা হয়। দরিদ্র মানুষ তার মৌলিক চাহিদা যেমন—খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে। ক্ষুধা, অপুষ্টি, অভাব আর হতাশা হয় নিত্যসঙ্গী।

দারিদ্র্য ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক কর্মদক্ষতা অর্জন ও বজায় রাখা, সামাজিক ভূমিকা পালন, সুস্থ স্বাভাবিক বিকাশে বাধাসহ দারিদ্র্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকে এমন হাজারো সমস্যা।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রাগনার নার্কস দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র ধারণায় বলেছেন, ‘একটি দেশ দরিদ্র, কারণ সে দরিদ্র।’ অর্থাৎ, অনুন্নত দেশসমুহের লোকের আয় কম বলে লোকের সঞ্চয়ের পরিমাণ কম হয়। সঞ্চয় কম বলে বিনিয়োগ কম হয়। বিনিয়োগ স্বল্পতার কারণে মূলধনের অভাব দেখা দেয়। মূলধনের অভাবে উৎপাদনের পরিমাণও কম হয়। এর ফলে অনুন্নত দেশের মাথাপিছু আয় কম হয়। এভাবে অনুন্নত দেশসমুহ দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে।

আমাদের দেশে যে হারে বাড়ছে জনসংখ্যা, সে হারে বাড়ছে না কর্মসংস্থান। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, গ্রাম-শহর সবখানেই বেকারত্বের হাতছানি। মাস কয়েক আগে দেশের বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগের গণবিজ্ঞপ্তিতে ৫৪ হাজার পদের বিপরীতে আবেদন পড়েছিল ৮৭ লাখ যাদের সবাই নিবন্ধিত। এ থেকে ধারণা করা যায়, বেকারত্বের তীব্রতা সম্পর্কে। দীর্ঘকালীন বেকারত্ব ও ছায়া বেকারত্ব আমাদের অর্থনীতিকে ক্রমান্বয়ে পঙ্গু করে দিচ্ছে। দেখা দিচ্ছে দারিদ্র্য। এ অবস্থায় দারিদ্র্য বিমোচন ও বেকারত্ব দূরীকরণে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় প্রয়োজনীয় আত্নকর্মসংস্থানের সুযোগ বা পরিবেশ করে দিতে হবে যাতে করে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি সফল হয়। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন—

কোনো কাজকেই ছোট করে না দেখা, লেখাপড়া শিখে কেবল চাকরির সন্ধান নয়, বরং স্ব-উদ্যোগে কিছু করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে সাময়িক বিপর্যয় আসতে পারে, সেই বিপর্যয়ে ভেঙে পড়লে চলবে না। বিপর্যয় কেটে ওঠার জন্য ধৈর্য, সাহস ও আত্মপ্রত্যয়ী হতে হবে। আত্নকর্মসংস্থানের উদ্যোগে পরিবারের সকল সদস্যের সহানুভূতি ও সহযোগিতা নিতে হবে। সামাজিক প্রতিকূলতা সম্মুখীন হলে তা ধৈর্যের সাথে মোকাবিলা করতে হবে ও নিজের গুণাবলি দিয়ে সবার প্রশংসা অর্জন করতে হবে। নিজের শ্রমে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে সর্বাত্মক। মনে রাখতে হবে, সততা ও নিষ্ঠাই হলো আত্মকর্মসংস্থানের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী দারিদ্র্য হার এক যুগের ব্যবধানে ১৮.২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে দারিদ্র্য হার ছিল ৪০ শতাংশ এবং অতি দারিদ্রের হার ছিল ২৫.১ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দারিদ্র এবং অতি দারিদ্র্যের এই হার নামিয়ে আনা হয়েছে যথাক্রমে ২০ দশমিক ৫ ও ১০ দশমিক ৫ শতাংশে।

দেশে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বাস্তবায়নের মাধ্যমে ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্রতার হার ৯.৭ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এজন্য সরকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ক্ষুদ্রঋণ প্রদানসহ নানাবিধ কার্যক্রম, দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্য দূরীকরণে সামাজিক সুরক্ষা নেটের আওতায় বিভিন্ন কর্মসূচি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করছে। এক্ষেত্রে সরকার দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্য দূরীকরণে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।

তবে হঠাৎ কোভিড-১৯ মহামারির প্রাদুর্ভাবে সৃষ্ট আয়-রোজগারের অস্থিতিশীলতা কিছু লোককে আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে নামিয়ে আনতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে দারিদ্রের হার ১২.৩ এবং অতি দারিদ্রের হার ৪.৫ নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

সে যাই হোক, ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্রতার হার ৯.৭ শতাংশে নামিয়ে আনতে চাইলে সরকারি-বেসরকারিভাবে আত্মকর্মসংস্থানের পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তাহলেই স্বনির্ভরতা অর্জনের মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত হবে দেশ, কমবে অর্থনৈতিক বৈষম্য। আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবসে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী [email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আত্মকর্মসংস্থান,দারিদ্র্য বিমোচন দিবস,মুক্তমত
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close