এম এ মাসুদ

  ১১ অক্টোবর, ২০২১

আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস

প্রয়োজন বৈষম্য নিরসন ও বাল্যবিয়ে রোধ  

বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বড় অংশীদারও নারীরা। এই অর্ধেক অংশকে বাদ দিয়ে আর্থ-সামজিক উন্নয়ন কখনো কল্পনা করা যায় না। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, মেয়ে বা নারীরা হচ্ছেন আজ কুসংস্কারসহ নানা বৈষম্যের শিকার। তাদের মর্যাদা নিয়ে বই-পুস্তকে লেখা বা প্রচার-প্রচারণা হলেও কাঙ্খিত অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়।

একটি কন্যা সন্তান জন্মের পর দ্বিতীয় গর্ভধারণের সময় অনাগত শিশুটির লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য ক্লিনিকের দ্বারস্থ হওয়া নিত্যদিনের ঘটনা। টেষ্টে কন্যাভ্রূণ হলেই স্বামী বা পরিবারের সদস্যদের মন খারাপ, ঘটানো হয় গর্ভপাত। কী নিষ্ঠুরতা কন্যাভ্রুণের প্রতি! কারণ হিসেবে দায়ী করা যেতে পারে যৌতুক নামক অভিশপ্ত প্রথাকে। আবার, কন্যা সন্তানের জন্য দায়ী স্ত্রী আর পুত্র সন্তান হলে স্বামী বীর পুরুষ এমন কু-ধারণাও রয়েছে আমাদের সমাজে।

চলতি বছরের শুরুর দিকের কথা। গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়নের ঘোরামারা গ্রামের রাজা মিয়া স্ত্রী রোকসানার গর্ভের আল্ট্রাসনোগ্রাম করে কন্যাসন্তান জানার পর স্ত্রীকে রেখে চলে যাওয়া, শ্বশুর-শ্বাশুড়ির নির্যাতন এবং সন্তান প্রসবের পর তালাক দেয়ার মত ঘটনা ঘটেছে। পরপর মেয়ে হওয়ার দায়ভার নারীদের উপর চাপিয়ে করা হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, ঘটছে বিবাহ বিচ্ছেদের মতো ঘটনা। সভ্যতার অগ্রগতি হলেও এখনো দূর হয়নি এমন কুসংস্কার।

শহরাঞ্চলের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে নারীদের মজুরী পুরুষের সমান হলেও গ্রামাঞ্চলে দেখা যায় এর ব্যতিক্রম। গ্রামীণ জনপদে কৃষিক্ষেত্রে শ্রমের যথেষ্ট চাহিদা থাকায় নারী শ্রমিকদের কদর বাড়লেও বাড়েনি তাদের মজুরি । শ্রমঘন্টা সমান হলেও পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় নারীদের মজুরি এখনো প্রায় অর্ধেক, যা অমানবিক। অথচ কৃষি তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীদের অবদান অনস্বীকার্য। গৃহিণী হিসেবে স্বামীর ফরমায়েশ পালন, সন্তানের লালনপালন, স্কুলে পাঠানোসহ রান্না, গৃহসজ্জার মতো কাজগুলো করতে হয় নারীদেরই। সারাদিন অবিশ্রান্ত ও নিষ্ঠার সাথে এমন দায়িত্বগুলো পালন করা সত্বেও তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি ক'জন! অর্থনীতিতে তাদের যথেষ্ট অবদান থাকা সত্বেও পারিবারিক চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি ভেবে তাদের নেই স্বীকৃতি, নেই মূল্যায়ন। অথচ পরিবারের গন্ডির মধ্যে থেকেও অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন মেয়েরা।

দেশে মেয়ে শিক্ষার হার, কর্মসংস্হান বাড়লেও তারা রক্ষা পাচ্ছেন না যৌতুক নামক অভিশপ্ত প্রথা থেকে, বলি হতে হচ্ছে তাদের এ অভিশপ্ত প্রথার। টাকার অংকে মোহরানার পরিমান বাড়লেও তা ওই নাকফুল আর কানের দুলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। পিতা-মাতার সম্পদের উপর ন্যায্য অধিকার থাকলেও কখনো পিতা-মাতা ছেলে সন্তানদের লিখে দিয়ে, কখনোবা ভাইয়েরা নামমাত্র মূল্য বা পেশিশক্তির জোরে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করছেন তাদের।

বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা, ভর্তি পরীক্ষায় রাখছেন তারা মেধার স্বাক্ষর। গুরুত্বপুর্ণ পদেও রয়েছেন নারীরা। তবুও বৈষম্য যেন পিছু ছাড়ছে না তাদের। পারিবারিকভাবে অসম অধিকার, কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীদের উপেক্ষা করা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশে যদিওবা কুসংস্কার মেয়েদের শিক্ষায় অন্তরায়, তারপরেও বড় অন্তরায় হলো মেয়েদের নিরাপত্তার অভাব। কিশোরি বা মেয়েদের পথেঘাটে বখাটেদের দ্বারা উত্ত্যক্ত হওয়া তাদের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে। স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসায় যাওয়ার পথে এই নিরাপত্তাহীনতা একটি বড় বাধা। এমন ভাবনা থেকেও বাবা-মা তাদের কিশোরি মেয়েটিকে ঠেলে দিচ্ছেন বাল্যবিয়ের দিকে। বঞ্চিত হচ্ছে কিশোরি মেয়েরা তাদের শিক্ষা থেকে। তাছাড়া বাবা-মায়ের অকাল মৃত্যু, ভরণপোষণকে বোঝা মনে করা, বেশি লেখাপড়া করালে যৌতুকের অংকটা বেশ বড় হবে এমন ভাবনা, সর্বোপরি দারিদ্রতাজনিত কারণে বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছেন কিশোরিরা।

বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক জরিপের তথ্যানুযায়ী মহামারির সময়ে ২০২০ সালে দেশে বাল্যবিবাহ ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কমেছে গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য বলছে, করোনাকালীন কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীর বড়ভিটা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮৫ ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। ফলে ওই বিদ্যালয়ে ছাত্রীদের উপস্থিতি কমে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার আগে ওই বিদ্যালয়ে যেখানে প্রতিদিন গড় ছাত্রী উপস্থিতি ছিল ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ, এখন সেখানে উপস্থিতি ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। আবার, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের সারডোব উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬৩ ছাত্রীর মধ্যে ১৮ জনের বাল্যবিয়ে হয়েছে। বিদ্যালয়টির নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ৯ জন ছাত্রীর মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ৮ জন ছাত্রী।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্লান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের তথ্যানুযায়ী, কুড়িগ্রাম জেলায় ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত জেলায় বাল্যবিয়ে হয়েছে ৩ হাজার ১৯টি। এমন হতাশাজনক অবস্থা শুধু কুড়িগ্রামে নয়, বাস্তবতা গোটা দেশের গ্রামীণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর।

বাল্যবিয়ে একটি মেয়েকে সুরক্ষা তো দেয়ই না বরং ওই মেয়েটির শৈশব, কৈশোর ও জীবনের সকল আনন্দকে কেড়ে নেয়। যার নেতিবাচক প্রভাব গিয়ে পড়ছে- কিশোরিদের শারীরিক, মানসিক স্বাস্থ্যের উপর। বিয়ের কারণে অল্প বয়সে সন্তান জন্মদানের ফলে অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগতে হয়। এছাড়া গর্ভকালীন, প্রসবকালীন এবং প্রসব পরবর্তী জটিলতা তো রয়েছেই। এমনকি অকাল মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন ও বয়স পরিপক্ক না হওয়ায় জীবন সম্পর্কে বাস্তব ধারণা অর্জন করাও সম্ভব হয়ে ওঠেনা তাদের। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন একজন নারী শুরু মা ই নন, একজন শিক্ষকও বটে। বাল্যবিয়ের শিকার শিক্ষাবঞ্চিত এসব নারী তাদের সন্তানকেও সঠিকভাবে শিক্ষা দিতে না পারার ফল ভোগ করতে হবে সারাজীবন।

জনবিজ্ঞানী আর এম ডিংকেল 'এডুকেশন এন্ড ফার্টিলিটি ইন দ্য ইউএসএ' নামক এক নিবন্ধে ষাট দশকে মার্কিন জনগণের মধ্যে শিক্ষা ও প্রজননের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজতে গিয়ে লক্ষ্য করেছেন- পুরুষের তুলনায় নারীর শিক্ষা প্রজননের সাথে বেশি সম্পর্কযুক্ত।

রফিকুল হুদার এক গবেষনা থেকে দেখা যায় প্রজনন এবং গর্ভনিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণের উপর স্বামীর শিক্ষার চেয়ে স্ত্রীর শিক্ষার অধিক প্রভাব রয়েছে। তার প্রাপ্ত ফল থেকে প্রতীয়মান হয় মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত নারী শিক্ষাকে উন্নীত করতে পারলে জনসংখ্যা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে এবং গর্ভনিরোধ ব্যবহারও বিস্তার লাভ করবে।

বাস্তবতা হলো, শিক্ষা অর্জন না করেই বাল্যবিয়ে বাড়তে থাকলে তা দেশের জনসংখ্যাকে বাড়িয়ে তোলার পাশাপাশি জনসংখ্যার নির্ভরশীলতার অনুপাত বৃদ্ধি পাবে। নির্ভরশীল জনসংখ্যা আয়ের বিরাট অংশ খেয়ে ফেলবে। ফলে সঞ্চয় কম হবে, সঞ্চয় কম হলে মূলধন গঠন ও বিনিয়োগ কম হবে, বিনিয়োগ কম হলে উৎপাদন কম হবে, উৎপাদন কম হলে আয় কম হবে, আয় কম হলে সঞ্চয় কম হবে। এভাবে অর্থনীতি দারিদ্রের দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খাবে। জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী হবে, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাবে, অর্থনৈতিক অগ্রগতি হবে মন্থর, প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টিসহ খাদ্য, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা এবং বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করবে।

বিগত কয়েক দশকে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে এগিয়েছে দেশ, এগিয়েছে বিশ্ব। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে মর্যাদার আসনে সমাসীন হচ্ছেন নারীরা। কিন্তু সমান, এমনটি বলা যায় না।

যা হোক, লিঙ্গ বৈষম্য, শিক্ষার অধিকার, পরিপুষ্টি, আইনি সহায়তা ও ন্যায় অধিকার, চিকিৎসা সুবিধা, বৈষম্য থেকে সুরক্ষা, নারীর প্রতি সহিংসতা ও বাল্যবিবাহ রোধ করতে হবে।

নারীদের মর্যাদা রক্ষা বা প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব নারী, পুরুষ, সমাজ সর্বোপরি রাষ্ট্রের। কেননা, এর সাথে জড়িত রয়েছে আমাদের সামগ্রিক কল্যাণ। নিরাপত্তার পাশাপাশি নারীরা যেন পান সমান সামাজিক মর্যাদা, ন্যায্য পারিশ্রমিক। সেজন্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, পেশা নির্বিশেষে নিশ্চিত করতে হবে নিরাপত্তা ও অধিকার। তবেই মিলবে অর্থনৈতিক মুক্তি, উন্নত হবে সমাজ, উন্নত হবে দেশ, উন্নত হবে বিশ্ব। আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবসে সেটিই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: গণমাধ্যম কর্মী,

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close