এম এ মাসুদ

  ০৫ অক্টোবর, ২০২১

শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের সেকাল-একাল

বলা হয়ে থাকে, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। যদি তাই হয়, তবে শিক্ষা নামক সেই মেরুদণ্ডের স্রষ্টার দাবিদার নিশ্চয়ই শিক্ষকরা। নৈতিকতার বিচারে শিক্ষকরা সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি। তারাই মানুষ গড়ার কারিগর। দুনিয়ায় যারাই মহৎ হয়েছেন বা উচ্চতর পদে সমাসীন হয়েছেন, তারা কোনো না কোনো শিক্ষকের কাছে জ্ঞানার্জন করেছেন। সুতরাং সম্মানজনক পেশাগুলোর মধ্যে শিক্ষকতাও একটি মহৎ পেশা।

শিক্ষিতজন মাত্রই কোনো না কোনোভাবে আমরা শিক্ষকের কাছে ঋণী, যেমনটি ঋণী আমরা আমাদের মা-বাবার কাছে। বছর কয়েক আগের কথা। কোনো এক পাঠ্যবইয়ের প্রশ্নে দেখেছিলাম, মা-বাবার চেয়ে উত্তম অভিভাবক কে? মা-বাবার চেয়ে উত্তম অভিভাবক! তিনি আবার কে? জবাব জানা না থাকায় কৌতূহলটা বেশ বাড়লো আমার। অবশেষে ভেতরে তার খুঁজে পেলাম জবাব—শিক্ষক।

উত্তর যথার্থ। কারণ মা-বাবা সন্তান জন্ম দিলেও তাদের সেই সন্তানকে (শিক্ষার্থীদের) স্বপ্ন দেখানোর মাধ্যমে তাদের মনের সুপ্ত প্রতিভা জাগিয়ে তোলা ও জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার মাধ্যমেই তো তাদেরকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন শিক্ষক। সে জন্যই তো তারা মা-বাবার চেয়ে উত্তম অভিভাবক। তারাই তো মানুষ গড়ার সুনিপুণ কারিগর। জীবিকার তাগিদে চাকরি মনে হলেও শিক্ষকতা নেহাত চাকরি নয়, এটি একটি মহান পেশা। শিক্ষক সর্বজন শ্রদ্ধেয়। সমাজে রয়েছে তাদের মর্যাদার আসন। কারণ একজন শিক্ষকের ছাত্রই রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে দায়িত্বে থাকেন। একজন শিক্ষক যেখানেই যান না কেন, সেখানেই তিনি সম্মান পেয়ে থাকেন।

কৈশোরে কাজী নেওয়াজের ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতায় পড়েছি দিল্লির বাদশাহ হয়েও বাদশাহ আলমগীর তার পুত্র শিক্ষকের পা ধুয়ে না দিয়ে শুধু পানি ঢেলে শাহজাদা যে বেয়াদবি ও শিক্ষককে অবহেলা করেছিলেন, তার জন্য ক্ষমা চেয়ে শিক্ষকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন। তিনি তার সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক বরাবর একটি চিঠি লিখেছিলেন, যা আজও শিক্ষকদের জন্য শুধু শিক্ষাদানের পথ-নির্দেশিকাই নয়, অভিভাবকদের জন্যও অনুসরণীয় বলা যেতে পারে। তিনি যে চিঠি লিখেছিলেন তার সংক্ষিপ্ত রূপ ছিল এমন—

‘মাননীয় মহাশয়,

আমার পুত্রকে জ্ঞানার্জনের জন্য আপনার কাছে পাঠালাম। তাকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন—এটাই আপনার কাছে আমার বিশেষ দাবি।

তাকে শেখাবেন পাঁচটি ডলার কুড়িয়ে পাওয়ার চেয়ে একটি উপার্জিত ডলার অধিক মূল্যবান। এও তাকে শেখাবেন, কিভাবে পরাজয়কে মেনে নিতে হয় এবং কিভাবে বিজয়োল্লাস উপভোগ করতে হয়। হিংসা থেকে দূরে থাকার শিক্ষাও তাকে দেবেন। বইয়ের মাঝে কি রহস্য আছে তাও তাকে বুঝতে শেখাবেন। আমার পুত্রকে শেখাবেন—বিদ্যালয়ে নকল করার চেয়ে অকৃতকার্য হওয়া অনেক বেশি সম্মানজনক। নিজের ওপর তার যেন সুমহান আস্থা থাকে। আমার পুত্র যেন এ শক্তি পায়—হুজুগে মাতাল জনতার পদাঙ্ক অনুসরণ না করার। সে যেন সবার কথা শোনে এবং তা সত্যের পর্দায় ছেঁকে যেন ভালোটাই শুধু গ্রহণ করে—এ শিক্ষাও তাকে দেবেন। সে যেন শিখে দুঃখের মাঝে কীভাবে হাসতে হয়। আবার কান্নার মাঝে লজ্জা নেই একথা তাকে বুঝতে শেখাবেন। আর অতিরিক্ত আরাম-আয়েশ থেকে সাবধান থাকে। আমার পুত্রের প্রতি সদয় আচরণ করবেন কিন্তু সোহাগ করবেন না। কেননা আগুনে পুড়েই ইস্পাত খাঁটি হয়। আমার সন্তানের যেন অধৈর্য হওয়ার সাহস না থাকে, থাকে যেন সাহসী হওয়ার ধৈর্য। তাকে এ শিক্ষাও দেবেন—নিজের প্রতি তার যেন সুমহান আস্থা থাকে আর তখনই তার সুমহান আস্থা থাকবে মানবজাতির প্রতি।’

শিক্ষকের মর্যাদার এমন হাজারো উদাহরণ রয়েছে। তবে শিক্ষকদের একটি শ্রেণির নানান কর্ম ও দায়িত্বহীনতার কারণে এখন আর শিক্ষকদের সেই আগের সম্মানের আসন অনেকটাই কমে গেছে। আগে যেখানে শিক্ষক তার ক্লাসের সব শিক্ষার্থীর নাম জানলেও পরীক্ষার হলে দায়িত্ব পালনকালে তাদের চিনতেন না, নকল সরবরাহ করতেন না, পরীক্ষার হলের দরজায় দাঁড়িয়ে পাহাড়া দিতেন না। কিন্তু বর্তমানে ঘটতে দেখা যায় ঠিক তার উল্টো। পড়া না হলে ইচ্ছেমতো মারতেন বেত দিয়ে, কিন্তু তারপরেও শিক্ষার্থীদের কোনো অভিযোগ ছিলনা, তেড়ে আসতেন না অভিভাবক। কারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে স্নেহ-ভালোবাসার বন্ধন ছিল অটুট। পাবলিক পরীক্ষা এলেই শিক্ষকদের বেড়ে যেত ব্যস্ততা, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার খোঁজ নিতেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে কারো কোনো সমস্যা আছে কী না। অভিভাবকরা চিন্তামুক্ত থাকলেও, চিন্তাযুক্ত থাকতেন শিক্ষকরা। কী মধুর ছিল সেই সম্পর্ক! কী মধুর ছিল সেই দিনগুলো! গুরুদের মতো পরামর্শ দেন বলে তো একজন শিক্ষক ছাত্রের বন্ধু। ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের পার্থক্য নির্দেশ করে নৈতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত করে তোলেন বলে একজন শিক্ষকের ভূমিকা দার্শনিকের। আবার, জীবনের সব ক্ষেত্রে চলার নির্দেশনা প্রদান করে ছাত্রের ভবিষ্যৎ চলার পথকে সুগম করে দেন বলে তিনি একজন পথপ্রদর্শক বা গাইড।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ককে বিচার করেছেন ‘পরস্পর নির্ভর, সৌহার্দ্যমূলক হিসেবে। সে সম্পর্ক কেবল পুঁথিগত বিদ্যা শেখানো ও শেখার মধ্যে আবদ্ধ নয়।’

যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইকোনোমিক্স অ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ‘গ্লোবাল টিসার্চ স্ট্যাটাস ইনডেক্স ২০১৮’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে গড়ে মাত্র ৩৬ ভাগ ছাত্রছাত্রী তাদের শিক্ষকদের সম্মান করেন। এছাড়া শিক্ষকতা পেশাও সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা হারাচ্ছে অনেক উন্নত দেশে। যদিও ওই জরিপে আমাদের দেশকে দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। তবে আমাদের দেশেও যে শিক্ষকদের সম্মান আগের মতো নেই, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না অতীতের সুসম্পর্কের সেই দিনগুলোর অস্তিত্ব। অতীতে অর্থের বিনিময়ে জ্ঞান বিতরণ করা হলেও অর্থ সেখানে প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল না। শিক্ষকরা নিজেকে নিঃশেষ করে জ্ঞান বিতরণ করে তাতেই পেতেন পরম আনন্দ। কিন্তু এখন বিদ্যা কেনা হয় অর্থ দিয়ে। নামিদামি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে হয় মোটা অংকের টাকা দিয়ে। বেশি মাসিক বেতনে পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের। কোচিং সেন্টারের নাম করে শিক্ষার্থীদের স্বল্প পড়ায় ভালো রেজাল্ট বা পাশ করার নিশ্চয়তা দেন শিক্ষক সমাজ। ফলে শ্রেণি কক্ষে নয়, শিক্ষার্থী হচ্ছে কোচিং সেন্টার বা প্রাইভেটমুখী। তাদের মধুর সম্পর্কের মধ্যখানে টাকা এসে ধীরে ধীরে ম্লান করে দিচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সেই সহজ, সরল ও মধুর সম্পর্ক। এখন শিক্ষার্থীর মুখও চেনার দরকার নেই, নেই সালাম পাওয়ার আশাও। অর্থের বিনিময়ে কাম্য যোগ্যতা ছাড়াই (মাস্টার্স সনদ জাল, ডিগ্রি বা মাস্টার্সে তৃতীয় শ্রেণি/বিভাগ, কম্পিউটার সনদ জাল) যদি কেউ শিক্ষক হন, আর সেই শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার শিক্ষা দেন তবে শিক্ষার্থীরা নিশ্চয়ই তার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাবে সেটাই তো স্বাভাবিক। আগে দেখেছি প্রতিষ্ঠান প্রধানরা শিক্ষকদের আগেই প্রতিষ্ঠানে আসতেন। সেখানে তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও যদি অফিসের নাম করে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা প্রতিষ্ঠানে না আসেন বা দেরিতে আসেন তাহলে শিক্ষার্থীরাও একদিন শিক্ষক হয়ে সেই একই কাজটি করবেন বৈকি! এমন বিবিধ কারণেই উঠে যাচ্ছে শ্রদ্ধাবোধ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধুর সম্পর্ক রূপ নিচ্ছে তিক্ততায়।

যা হোক, আবার ফিরিয়ে আনতে হবে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে অতীতের সেই মধুর সম্পর্ক। ফিরিয়ে আনতে শিক্ষার্থীদের কোচিং সেন্টার বা প্রাইভেট থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ঘটনাচক্রে নয়, মেধাবীরা নিজেই যেন আকৃষ্ট হন শিক্ষকতা পেশায়। তাদের আকৃষ্ট করতে প্রয়োজন শিক্ষকদের যথাযথ সামাজিক মর্যাদা। আর সামাজিক মর্যাদার বিষয়টি অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকটাই অর্থের ওপরও নির্ভরশীল। প্রায় ৯৭ ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়িভাড়া ১ হাজার টাকা, চিকিৎভাতা ৫শ টাকা, সিকিভাগ বোনাস নিশ্চয়ই শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে এমনটি বলা যায় না। এ জন্য মানবিক কারণেই শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিবেচনায় আনার জন্য দীর্ঘদিনের দাবি দেশের শিক্ষক সমাজের। গত বছরের নভেম্বর ও চলতি বছরের মার্চে যথাক্রমে মাদ্রাসা ও স্কুল,কলেজের নীতিমালা জারি হওয়ার পর আজও লেকচারারদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে পঞ্চাশভাগ অনুপাত প্রথার বাস্তবায়ন হয়নি, যা দুঃখজনক।

সুতরাং শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করণের মাধ্যমে একটি সুন্দর সমাজ গড়তে ও মেধাসম্পন্ন জাতি গঠনে চাই আদর্শবান ও দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষক। কেননা তারাই তো আদর্শ জাতি গড়ার কারিগর। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হোক শ্রদ্ধা, ভালোবাসার ও বন্ধুত্বের। চাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে সেই মধুর সম্পর্ক যা অতীতে ছিল।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী [email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নৈতিকতা,বিদ্যা,জ্ঞান,শিক্ষকের মর্যাদা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close