শেখ নজরুল ইসলাম

  ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১

মন্তব্য প্রতিবেদন

শিক্ষকদের আরো মানবিক হওয়া জরুরি

আমাদের সময় ছিল বড়ই মধুর। বেড়ে ওঠা ছিল বড় বেশি মধুময়। যেখানে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের অনেকটাই অংশীদারত্ব ছিল। ছিল আধুনিকতা আর অনগ্রসরতার সংমিশ্রণ। একজন শিক্ষক ছিলেন একেকজন মানবজমিনের ভূস্বামী। ভূস্বামী বলার অর্থ তিনি জমির মালিক ছিলেন না। তবে তার তল্লাটের সব ছাত্রছাত্রীর মনের জমিনে তিনি চাষাবাদ করতেন। তিনি সন্তানদের সুসন্তান তৈরির চেষ্টা করতেন। শিক্ষকের কাছে গিয়ে অভিভাবকরা বলতেন, রেখে গেলাম ‘মানুষ করার দায়িত্ব আপনাদের।’

কৈশোরে দেখেছি বড় কোনো পরীক্ষা এলেই শিক্ষকদের ব্যস্ততা বেড়ে যেত। ওইসব শিক্ষক রাত জেগে কোন বাড়িতে ছাত্র আছে, তার পড়াশোনা কত দূর হলো- অনেকটা চৌকিদারের মতো তদারকি করতেন। তখন ছাত্রদের রাত জেগে জোরে জোরে পড়ার নির্দেশ থাকত। কেউ যদি কোনো শব্দ ভুল উচ্চারণও করত সেখানেই দেবদূতের মতো শিক্ষকের আবির্ভাব। মা-বাবারা ঘুমিয়ে কাটালেও ওইসব শিক্ষকরা রাত জেগে কোনো কিছুর প্রত্যাশা না করেই দিনের পর দিন এভাবেই দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ফলে তাদের সেই আত্মত্যাগে অনেকেই কিছুটা হলেও মানুষের উচ্চতায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন।

সম্প্রতি অতিমারিতে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক শিক্ষকদের জীবনে নেমে এসেছে নির্মম দুর্ভোগের পাহাড়। অনেককে পেশা ছেড়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে বেছে নিতে হয়েছে অপন্দনীয় পেশা। আর দেশের ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেনের মধ্যে সাড়ে ৩ হাজার এখনো তাকিয়ে আছে সরকারের প্রণোদনার দিকে।

অবস্থা যখন এমন ঠিক সে সময়ে জাতীয় গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে বেশ কিছু বেদনাদায়ক সংবাদ। যা কারো জন্য সুখকর নয়। এ রকম একটি সংবাদ এসেছে বাগেরহাটের মোংলা থেকে। যেখানে বলা হয়েছে, পোশাকের সঙ্গে মিল রেখে জুতা না পরায় শতাধিক শিক্ষার্থীকে স্কুল থেকে বের করে দিয়েছেন প্রধান শিক্ষক ব্রাদার জয়ন্ত এন্ড্রু কস্তা। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর সেখানকার ইউএনও এবং উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা তাদের ক্লাসে ফিরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন।

জয়ন্ত বাবু প্রশ্ন তুলতেই পারেন, বাপু তার স্কুলের সমস্যা নিয়ে কেন এত সবার মাথাব্যথা? এত মাতামাতি? কিন্তু তিনি কী জানেন দেড় বছর পর অনেক চড়াই-উওরাই পেরিয়ে দেশের সব স্কুল-কলেজ খোলা সম্ভব হয়েছে। শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলা রক্ষা ও রক্ষার শিক্ষা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তা করতে হবে সময় ও পরিবেশের কথা মাথায় রেখে। জয়ন্ত বাবু বিষয়টি আত্মস্থ না করে অসময়ে কাজটি করে ফেলেছেন। অনেক দিন ধরে স্কুলের বাইরে থাকা এ কিশোরদের সঙ্গে সহানুভূতির হাত না বাড়িয়ে বিপরীত আচরণ করেছেন। ফলে তার ভবিষ্যৎ কিছুটা হলেও ঝুঁকিপূর্ণ হলো।

দীর্ঘদিন ধরে আমরা খারাপ সময় পার করেছি আরো কত দিন পার করতে হবে তা জানি না। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের মানবিক আচরণ দিয়ে জয় করতে হবে। এক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় ঘটেছে। গণমাধ্যমে আসার ফলে আমরা জানতে পারছি এমন অনেক ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে। আমাদের উচিত হবে আরো বেশি করে চিন্তা-ভাবনা করা, আরো বেশি সহানুভূতিশীল আচরণের অনুশীলন করা। এ সময়ে শিক্ষকদের সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ শিক্ষার্থীদের অনেক বেশি কাম্য। তাই আরো বেশি মানবিক আচরণের অনুশীলনে আমাদের নামতে হবে। মানবিক হয়ে শিখাতে হবে, যাতে তারা আরো বেশি মানবিক হয়ে বেড়ে উঠতে পারে।

এদিকে, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান, সহকারী প্রক্টর পদ ও প্রক্টরিয়াল বোর্ডের সদস্য আরো এক ধাপ এগিয়ে নিজের ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করেছেন। তিনি ১৬ জন শিক্ষার্থীর মাথার চুল কাঁচি দিয়ে কেটে দিয়েছেন। তার হেন কর্মে এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যার চেষ্টাও চালায়।

তার এই অপকর্মের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি তার ওপর অর্পিত ৩টি পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন তিনি কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দায়িত্ব পেলেন। আশা করি গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে এত সতর্ক অবস্থান গ্রহণ না করলে হয়তো কিছুই হতো না। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে এগিয়ে আসেনি। সুতরাং আমরা অনুমান করতে পারি।

এ বিষয়ে আমাদের বোধ দিনকে দিন ভোতা হয়ে যাচ্ছে। বোধোদয় আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। মনে রাখতে হবে, আমরা যেন কুম্ভকর্ণের ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে না পড়ি। কেউ জাগিয়ে দেওয়ার আগে আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে। সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। মনে রাখতে হবে, অর্থনৈতিক উন্নতি শেষ কথা নয়। নান্দনিক সমাজ গড়তে চাই মানবিক আচরণে সমৃদ্ধ একটি জাতি। আর সেই জাতি গঠনে শিক্ষকদের ভূমিকা হতে হবে এক দক্ষ নাবিকের মতো। কেননা যেকোনো অবস্থায় জাতি গঠনের অন্যতম কারিগর হচ্ছেন ‘শিক্ষক’।

লেখক : সম্পাদক, প্রতিদিনের সংবাদ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সম্পাদক,প্রতিদিনের সংবাদ,শেখ নজরুল ইসলাম
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close