মো. শহীদুল্লাহ

  ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১

বিএনপির জন্ম ও রাজনীতি

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এখন সরকারের বিশেষ বিবেচনায় জেলের বাইরে। তিনি এতিমের টাকা মেরে খাওয়ার মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি। দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন) তারেক রহমানও দুর্র্নীতির মামলায় দোষী ব্যক্তি। এ ছাড়া তিনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় আজীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। এখন স্বেচ্ছায় লন্ডনবাসী। তিনি আর দেশে ফিরতে পারবেন বলে মনে হয় না। সব মিলিয়ে দলটি এখন যারপরনাই মুশকিলে পড়েছে। এই মুশকিল যে কোনদিন আছান হবে তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। এদিকে, দলটির সাংগঠনিক শক্তিও ভেঙে পড়েছে। রাজনৈতিক ও সরকারবিরোধী কার্যক্রম বিবৃতি দেওয়া পর্যন্তই সার। সরকারের ওপর চাপ দেওয়ার সামান্য শক্তিও নেই এখন নেতৃত্বশূন্য এই দলটির। দেশের রাজনীতি নিয়ে যারা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে আগ্রহী, তাদের মনে প্রশ্নÑ এত বড় দল বিএনপির এই করুণদশা হলো কেন? এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে বিএনপির জন্ম এবং এর রাজনৈতিক নীতির নির্মোহ যাচাই-বাছাই দরকার। সে রকম তাগিদ থেকেই এই লেখা।

বিএনপির জন্ম : জনগণের কোনো ন্যায্য অধিকার আদায় কিংবা অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া থেকে রাজপথে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দলের জন্ম হয়নি। জন্ম হয়েছে সেনাছাউনির আঁতুড়ঘরে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যারা হত্যা করেছিল তাদের মদদদাতাদের অন্যতম একজন তৎকালীন সেনা কর্মকর্তা মেজর জিয়াউর রহমান। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর দেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রক্ষমতায় বিরাট শূন্যতা তৈরি হয়। আওয়ামী লীগকে চিরতরে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য ৩ নভেম্বর জেলখানায় বন্দি অবস্থায় খুন করা হয় চার নেতাকে। তারা হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান। এখানেও জিয়াই খলনায়ক, জড়িত তারই কালো হাত। এরপর প্রথম ধাপে আওয়ামী লীগের বেইমান নেতা খন্দকার মুশতাকসহ অন্যরা এবং সেনাবাহিনীতে চরম ডানপন্থি চক্রের সমর্থক মেজর জিয়া রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। তখন এদের হটানোর জন্য একটা বড় আঘাত করেন সেনা কর্মকর্তা খালেদ মোশাররফ। তিনি সেনা প্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দি করেন। এ সময় সমাজবিপ্লবের লক্ষ্য নিয়ে সেনাবিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন জাসদ নেতা কর্নেল তাহের। কর্নেল তাহের ও জিয়াপন্থি সৈনিকরা মিলে খালেদ মোশাররফের হাতে বন্দি জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেন। কিন্তু এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব কর্নেল তাহেরের হাতে থাকেনি। চলে যায় সেনাপ্রধান জিয়ার পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত চরম প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক, সামাজিক শক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী চীনপন্থি বামদের সমর্থনে জিয়াই তখন হয়ে পড়েন দেশের মালিক। দণ্ড-মুণ্ডের মালিক। এরপর সেনাপ্রধান এবং দেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই, এনএসআই এবং বেসামরিক আমলাতন্ত্রের প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকর্তাদের ব্যবহার এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ খরচ করে ১৯ দফার ভিত্তিতে গড়ে তোলেন জাতীয় গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে একটি পকেট-সংগঠন। এ দলের সভাপতি করা হয় উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে। এরপর জিয়াউর রহমান ১৯ দফার সমর্থক হিসেবে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করেন। ১৯৭৮ সালের ৩ জুনের প্রহসন ও সিলমারা নির্বাচনে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। অবশেষে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ভেঙে দিয়ে এই ১৯ দফা কর্মসূচির আলোকে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা শহরের রমনা রোস্তারাঁয় গঠন করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। তখন এই দলের ৭৬ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমানের এই দলে যোগ দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী মশিউর রহমান জাদু মিয়ার অনুসারী ভাসানী ন্যাপের বৃহৎ অংশ, মুসলিম লীগ, জাসদের দলছুট অংশ, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী আরো ব্যক্তি এবং মুক্তিযোদ্ধার অনেকে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধকে দুই কুকুরের কমড়া-কামড়ি হিসেবে মূল্যায়ন করা চীনপন্থি বামদের বড় অংশই জিয়ার বিএনপিতে যোগ দেয়।

জিয়াউর রহমান তার প্রাণ রক্ষাকারী যুদ্ধাহত সেক্টর কমান্ডার (জিয়া নিজেও সেক্টর কমান্ডার ছিলেন) কর্নেল তাহেরকে জেলখানায় বসানো সামরিক আদালতের বিচারে ফাঁসি দেন। সেনাবাহিনীর বাম ও প্রগতিশীল সেনা কর্মকর্তাদের টার্গেট করে হত্যা করেন। জেলে পুরেন এবং চাকরি ছাড়া করেন। মুক্তিযুদ্ধে ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি ও নেজামে ইসলামকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেন। নিষিদ্ধ করেন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এই ৪টি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! রাষ্ট্রপতি জিয়াও পরে চট্টগ্রামে সেনাবিদ্রোহের নিহত হন ১৯৮১ সালে। তিনি তো মরলেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা, শোষণমুক্তির অঙ্গীকার এবং ৩০ লাখ শহীদের রক্তঋণ তার সামরিক বুটের লাথিতে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে গেলেন।

খালেদার বিএনপি : রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর দলটির নেতা হন বেগম জিয়া। তিনি স্বৈরাচারী সেনাশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনে দেশের অন্যতম প্রধান নেত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনবার প্রধানমন্ত্রী হন, দীর্ঘ সময় দেশ পরিচালনা করেন। তার শেষবারের শাসন আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে আওয়মী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়। ওই হামলায় ২৩ জন নিহত হন। এরও আগে জঙ্গি মুফতি হান্নান কোটালিপাড়ায় বোমা পেতে শেখ হাসিনাকে হত্যা করার প্রচেষ্টা চালান। হবিগঞ্জে গ্রেনেড হামলা করে হত্যা করা হয় সাবেক অর্থমন্ত্রী এ এম এস কিবরিয়াকে। বিচার তো দূরের কথা, এসব ঘটনার পর অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল বিএনপি সরকার। জজ মিয়া কিচ্ছা তো আইন-আদালত ও বাংলাদেশের বিচার জগতে এক মহাবিস্ময়! ওই সময় বিএনপি সরকারের বিকল্প হিসেবে গড়ে ওঠে হাওয়া ভবন। জিয়া-পুত্র তারেক রহমান অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করতে থাকেন। বড় বড় প্রকল্প থেকে নিতে থাকেন বিপুল অঙ্কের বখরা। জামায়াত ও জঙ্গিবান্ধব তারেকের সঙ্গে বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল ভারতবিরোধী পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের মহব্বত গড়ে ওঠে। ইসলামি রাষ্ট্র কায়েমের জন্য মুফতি হান্নান, বাংলা ভাই ও শায়খ আবদুর রহমানরা ভয়ংকর রূপে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তারা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সেøাগান দেন ‘আমরা সবাই তালেবান/বাংলা হবে আফগান। দেশে কায়েম হয় মগের মুল্লুক। এই আফগানওয়ালাদের লেলিয়ে দেওয়া হয় আওয়ামী লীগ এবং দেশের বাম প্রগতিশীল নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। তারা দেশের প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা, প্রগতিশীল নেতা এবং মুক্তমনা লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের খুন করার জন্য হিটলিস্ট তৈরি করে। তাদের এই হিটলিস্ট থেকে বাদ পড়েননি সুফিবাদী ও উদার প্রকৃতির আলেম-ওলামারও। রাজধানী ঢাকা, রাজশাহীর বাঘমারা এবং নওগাঁয়ে এই মৌলবাদী জঙ্গিরা রক্তের হোলি খেলায় মেতে ওঠে। বগুড়ার বিভিন্ন গ্রামে মুজাহিদ বাহিনী গঠন করে বাংলা ভাইয়ের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীরা মানুষ হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রাখেন।

আইন শিক্ষার ভুয়া সনদ দিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি হওয়ার মতো ঘটনাও দেশে ঘটে। আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার বলতে আর কিছু অবশিষ্ট থাকেনি। সর্বশেষ ছিল বঙ্গভবনে ড. ইয়াজ উদ্দিন নাটক। এমনই এক প্রেক্ষাপটে ২০০৬ সালে ১৪ দলীয় মহাজোটের ধারাবাহিক আন্দোলনে পতন হয় খালেদা জিয়ার সরকারের। ক্ষমতায় আসে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

খালেদার ব্যর্থতা : খালেদা জিয়ার সুযোগ ছিল বিএনপিকে গণকল্যাণকামী আধুনিক দল হিসেবে গড়ে তোলার। তিনি তা করেননি। তিনি ‘ধরাকে সরা’ জ্ঞান করে আওয়ামী লীগবিরোধী রাজাকার, আলশামস, আলবদর নেতা এবং বঙ্গবন্ধুর খুনি ফ্রিডম পার্টির নেতাদের আশ্রয় দিলেন। যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিপক্ষে দাঁড়ালেন। বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক-রশিদ চক্রকে সমর্থন-সহযোগিতা করলেন। ৭১-এর ঘাতকদের মন্ত্রী বানালেন। ১৫ ফেব্রুয়ারির সাজানো নির্বাচনে কর্নেল রশিদকে করলেন এমপি। তার স্বামী জিয়াও এই দুই খুনির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

খালেদা জিয়া শাহবাগে গড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের গণজাগরণের বিরোধিতা করলেন। শাহবাগে জ্বলে ওঠা প্রগতির আলোক শিখা নিভিয়ে দেওয়ার জন্য হেফাজতের মোল্লাদের ঢাকায় জঙ্গিরূপে জমায়েত হওয়ার সব ধরনের সমর্থন জোগালেন তিনি। এরপর হেফাজতের সঙ্গে জামায়াত-শিবির ও জাতীয় পার্টির ইসলামি উগ্রপন্থিরা মিলে মতিঝিলে মধ্যযুগীয় অসভ্যতার প্রকাশ ঘটাল। দেশবাসী ও বিশ্ব দেখল হিটলারি তাণ্ডব। জানি না, কার পরামর্শে বিএনপি নেত্রী সমসাময়িক বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার মতো যোগ্যতা হারিয়ে বসলেন। বুঝতে ব্যর্থ হলেন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এশিয়ার নতুন সামরিক শক্তিবিন্যাসকে। হেফাজত ও জঙ্গিদের প্রতি বিএনপি এবং এর বুদ্ধিবণিকদের এই আদর-আপ্যায়ন ও সমর্থন দেখে গণতান্ত্রিক বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে গেল। তাদের মনে প্রশ্ন জাগল- বিএনপি কী গণতান্ত্রিক দল, না কি মিসরের ইখওয়ানুল মুসলিম (মুসলিম ব্রাদার হুড)। তাদের কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল বিএনপি গণতন্ত্রের সর্বজনীন মূলভিত্তিগুলো ধারণ করে না। দলটি মৌলবাদের কাছে বাঁধা পড়েছে। ফলে তালেবান-পছন্দ এই দল বাংলাদেশে থাক বা না থাক এতে গণতান্ত্রিক বিশ্বের কিছু যায় আসে না। বরং দলটিকে দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য ঝুঁকি বলে মনে করল প্রাশ্চাত্যবিশ্ব। নিজ দেশের শিংঝিয়াং প্রদেশের উইঘুর, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে তালেবানি-কাণ্ড দেখে চীনও বাংলাদেশের মৌলবাদী ও জঙ্গিদের প্রতি বিএনপির আত্মঘাতী নীতিতে আস্থা রাখতে পারল না। দেশের নতুন প্রজন্মের মানুষরাও মুখ ফিরিয়ে নিল দলটির দিক থেকে। দুর্দশার যামিনী গ্রাস করল বিএনপিকে।

ভারত বিরোধিতা : একটা সময় ছিল যখন ভারতের সিংহভাগ অর্থনীতি ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত। এটাকে সে দেশের সমাজতাত্ত্বিকরা নেহরু ধাঁচের সমাজতন্ত্র বলতেন। এদিকে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দেশটা ছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র রাশিয়ার মিত্র। এই অবস্থা ছিল গত শতাব্দীর ৯০-এর দশক পর্যন্ত। সেই ভারত কিন্তু নেহরুর সমাজবাদী দর্শনে আটকে থাকেনি। বাজার অর্র্থনীতির দিকে প্রথম সতর্ক পা ফেলেন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি। এরপর প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও। তারপর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাজারমুখী ও পাশ্চাত্য ধাঁচের উদার অর্থনীতির পথে রীতিমতো ওসাইন বোল্টের গতিতে দৌড়ান। দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতেও পরিবর্তন আসে দ্রুত। রুশপন্থি ভারত ক্রমেই ঝুঁকতে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। দেশটি ডব্লিউটিও সই করে। দেশের বাজার দেশি পুঁজি বিনিয়োগকারী ও বিদেশি লগ্নীকারদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ভারতের এই যে বাজারমুখী সংস্কার ও নীতি পুনর্গঠন (Reforms and Policy reconstruction), এটা দেশটিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশে পরিণত করেছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর মাধ্যমে ভারতকে অস্থিতিশীল রাখার জন্য যে ‘কাশ্মীর-সপ্তকন্যা খেলা’ খেলত তা ক্রমেই বন্ধ করে দেয়। ভারতও যুক্তরাষ্ট্রের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ইসলামি জঙ্গিদের শায়েস্তা করতে নয়াদিল্লিকে সঙ্গে পেতে চায় ওয়াশিংটন। শেষে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তি এবং সর্বশেষ সামরিক মৈত্রী চুক্তি সই হয়। এতে চীনের চোখ কপালে ওঠে, চুপসে যায় পাকিস্তান।

এশিয়ায় চীনের দাদাগিরির বিরুদ্ধে ভারত-মার্কিন এখন এক প্রাণ, এক মন। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এই যে বিদেশনীতির যুগান্তকারী নতুনত্ব এটা বোঝার ক্ষমতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক মান খালেদা জিয়ার না থাকারই কথা, কারণ তার কী আর অত-শত চিন্তা-ভাবনা করার মেধা আছে? কিন্তু তার দলে তো অনেক জ্ঞানী ও উচ্চশিক্ষিত নেতারা আছেন। তারাও বিষয়টা ধরতে পারলেন না, এমনটা মানা যায় না। ভারত-মার্কিন এই যে নতুন স্ট্র্যাটেজিক মেলবন্ধন তা আমলে না নিয়ে বিএনপি নেত্রী তার পাকিস্তানি জোশের ভারত বিরোধিতা বজায় রাখলেন। বিএনপি-জামায়াতের (জোট সরকার) শাসনামলে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া হয়, ভারতে ১০ ট্রাক অস্ত্র ঢোকানোর চেষ্টা হয়। খালেদার শিল্পমন্ত্রী জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী বায়তুল মোকাররমের এক জনসভায় ঘোষণা করলেন আসামের উলফারা স্বাধীনতা-সংগ্রামী। তাদের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন আছে। কী নির্মম পরিহাস! নিজের দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিপক্ষে পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষে যিনি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেনÑ সেই তিনি সাজলেন আসাম ও কাশ্মীরের স্বাধীনতাযুদ্ধের পৃষ্ঠপোষক, ভণ্ডামী আর কাকে বলে! নিজামীদের এই অপরিণামদর্শী কাজের কাফ্ফারা কী বিএনপিকে দিতে দিতে হয়নি? আমি বলব এখনো দিতে হচ্ছে।

মিয়ানমার, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের মধ্যে পণ্য-পুঁজি-শ্রমশক্তি ও প্রযুক্তির আদান-প্রদান সহজ করার জন্য বিশ্বব্যাংকের কর্মসূচি রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এই কর্মসূচি এসব দেশে বাজার অর্থনীতির বিকাশ এবং মানুষের আয়বৈষম্য কমাবে। দারিদ্র্য হ্রাস করবে। বিশ্বব্যাংকের এই কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে সাউথ এশিয়ান কানেকটিভিটি। এই কানেকটিভিটির যোগাযোগ স্থাপনা যেহেতু ভারত হয়ে বাংলাদেশকে যুক্ত করে, সেজন্য বিএনপি এর বিরোধিতা করে থাকে। এ ক্ষেত্রে দলটি যেন কমিউস্টি পার্টি! কিন্তু কেন? বিএনপি কী মওলানা ভাসানীর মতো কমিউনিস্টবেষ্টিত যে, বৈশ্বিক পুঁজিবাদ বিকাশের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করতে হবে! বিএনপি ক্ষমতায়, মাহমুদুর রহমান তখন প্রাইভেটাইজেশন বোর্ডের পরিচালক। ভারতের বহুজাতিক কোম্পানি টাটা বাংলাদেশে ৪টি বড় শিল্প প্রকল্প করার জন্য জমি চাইল। পাছে চীন নাখোশ হয় এবং বিএনপি-জামায়াতের ভারতবিরোধিতা ক্ষুণ্ন হয় তাই টাটাকে বিমুখ করা হলো। বিএনপির মতো একটি পুঁজিবাদী দলের এমন আচরণের কথা ভাবা যায়! টাটারা ব্যবসায়ী, এক দেশে না হলে অন্য দেশে ব্যবসা করবে তারা। বেনিয়াদের আবার ক্ষতি কী, তাদের তো লাভের পাল্লাই ভারী থাকে সব সময়। কিন্তু আখেরে বিএনপির ক্ষতির পাল্লা যে এত ভারী হবে এটা কী তখন বুঝতে পেরেছিলেন খালেদা জিয়া? তিনি এসব বুঝবেন কী করে? তিনি তো চলতেন জামায়াতের কথায় আর পাকিস্তানের আইএসআইয়ের পরামর্শে। বিএনপি নেতাদের মুখেই শুনেছি তার দলের জ্ঞানী-গুণী কারো কথার তিনি কানাকড়ির মূল্যও দেন না।

বিএনপির সংখ্যালঘুনীতি : পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগ নেতা খাজা নাজিমুদ্দীন, লিয়াকত আলী খান, জেনারেল আইয়ুব খান, নুরুল আমীন ও মোনায়েম খানদের রাষ্ট্র পরিচালনায় একটা গুপ্ত ফ্যাসিবাদী নীতি ছিল। ওই নীতির মূল কথা ছিল, পাকিস্তানকে অমুসলিম (বৌদ্ধ, হিন্দু ও খ্রিস্টান) শূন্য করা। অন্যদিকে কমিউনিস্টদের শিরদাড়া এক্কেবারে ভেঙে দেওয়া। এ কারণে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নির্মমভাবে নির্মূলীকরণের শিকার হন এবং পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান সাজ্জাদ জহিরকে ভারতে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হয়। পূর্বপাকিস্তানে ঠাঁই হয়নি ইলামিত্রদের। পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতা যোগেন মণ্ডলকে শ্রমমন্ত্রীর পদ ছেড়ে কলকাতায় আশ্রয় নিতে হয়। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও বেগম জিয়ার সংখ্যালঘুনীতি হুবহু খাজা নাজিমুদ্দীন ও লিয়াকত আলিদের মতোই। এই কারণে বেগম জিয়া-গোলাম আজম-নিজামীদের আমলে দেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও কাদিয়ানীদের রাষ্ট্রীয় বৈষম্য এবং হামলার শিকার হতে হয়েছে। মাটিতে মিশে গিয়েছিল তাদের মান-সম্মান এবং জানমালের নিরাপত্তা।

ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি এলেন ঢাকায়। খালেদা জিয়া তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ পর্যন্ত করলেন না। ঘরের লক্ষ্মী পায়ে ঠেললেন। ঠেলবেনই তো- তিনি যে সরস্বতীর বরকন্যা! তার কী দরকার হয় ঠাকুর পূজার! পরে তো হিন্দু মৌলবাদীদের আখড়া মহারাষ্ট্রের নাগপুর এবং নয়াদিল্লির চাণক্যপুরীতে লবিস্ট পাঠিয়েও ভারতের মন পায়নি বিএনপি।

বিএনপির নয়াদিল্লি কূটনীতি ব্যর্থ হয়েছে। তারেক জিয়া লন্ডনে থেকে সুখী জীবন কাটাতে পারবেন। হাওয়া ভবনের মাধ্যমে মাতা-পুত্রের অবৈধভাবে অর্জিত টাকায় হয়তো স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আমোদ-আহ্লাদেই থাকবেন। কিন্তু তারেক কোনোদিন বাংলাদেশের নেতা হবেন এই চিন্তা এখন মাটিচাপা পড়েছে। আর থাকল কী? সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের ডাক। এই আহ্বান মাঝেমধ্যেই উচ্চারিত হয় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কণ্ঠে। মির্জা সাহেব অর্থনীতির ছাত্র ছিলেন। এ বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন কিছু সময়। তিনি কী জানেন না, স্বাধীন দেশে জাতীয় ঐক্য হয় না। আর যদি দেশ ও দেশের মানুষের বিশেষ দরকারে সমমনা দলগুলোর মধ্যে এ ধরনের ঐক্য হয়ও তার তো একটা রাজনৈতিক কর্মসূচি লাগবে। আজকের যুগে সেই কর্মসূচি অবশ্যই হবে মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদবিরোধী। সঙ্গে থাকতে হবে দেশের ধনি ও গরিবের মধ্যে আয়বৈষম্য কমানোর দূরদর্শী দিকনির্দেশনা। বিএনপির কী এ ধরনের আর্থসামজিক কর্মসূচি আছে?

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক ইমেইল : [email protected]

পিডিএসও/এসএমএস

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বিএনপি,রাজনীতি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close