এম এ মাসুদ

  ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১

মাদকমুক্ত হোক নতুন প্রজন্ম

সমাজ সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকেই বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা ছিল। আর সমাজ আছে বলেই সামাজিক সমস্যাও রয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় এ সমস্যাগুলোর পরিবর্তন হয়েছে শুধু ধরণ বা রূপ। আর নানাবিধ সমস্যার মধ্যে মাদক সমস্যা অন্যতম। মাদক সেবন বা নেশা করার প্রবণতা আবহমানকাল থেকেই চলে আসছে। তবে বর্তমান সময়ে এসে তা এক ভয়ঙ্কর রূপ পরিগ্রহ করছে। এর ইতিবাচক কোনো দিক না থাকলেও নেতিবাচক প্রভাব মারাত্নকভাবে গিয়ে পড়ছে আমাদের সামাজিক ও নৈতিক জীবনের ওপর। পত্রিকার পাতা উল্টালেই চোখে পড়ছে মাদক নিয়ে ভয়ঙ্কর সব তথ্য।

গত ১ সেপ্টেম্বর প্রতিদিনের সংবাদে 'পলাশবাড়ীতে ৫ কেজি গাঁজাসহ নারী মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার, গত ৩ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এলজিইডির কর্মকর্তার মাদক সেবনের ভিডিও ভাইরাল, ২৮ আগস্ট সাতক্ষীরায় ৪০০ পিস ইয়াবাসহ ব্যাংক কর্মকর্তা গ্রেপ্তার, ২৬ আগস্ট ঢাকায় মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার ৫৪, ২৪ আগস্ট চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় মাদক সম্রাট বানু আটক, ১৯ আগস্ট গাজীপুরে ১৬ কেজি গাঁজাসহ দুই বোন গ্রেপ্তার, ১৮ আগস্ট রাজধানীতে ৫০০ গ্রাম আইস এবং ৬৩ হাজার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার ৭, ১২ আগস্ট যশোরের বেনাপোলে পুলিশ ডেকে ইয়াবাসহ ছেলেকে ধরিয়ে দিলেন মা' শিরোনামগুলো বাস্তব অবস্থার খন্ডচিত্র মাত্র। আর মাদকাসক্তদের গ্রেপ্তারের খবর তো প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা খবরের কাগজে আসছেই।

দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যুবদের গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণে তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাদক সেবনের মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। মাদকাসক্তির শুরুটা মূলতঃ মাদকাসক্ত সঙ্গী বা বন্ধুদের সাথে মেলামেশা থেকেই। উঠতি বয়সের কিশোরদের স্বভাব সাধারণত কৌতূহল প্রবণ হয়। মাদক সেবনের ভয়ঙ্কর দিকগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকায়, কেবলমাত্র সঙ্গীদের প্ররোচনায় এবং সাময়িক উত্তেজনা কিংবা কৌতূহল বশেও কিশোর বয়সীরা মাদকদ্রব্য সেবন করে থাকে। এভাবে এক সময় কিশোর-কিশোরীরা ধীরেধীরে এ মরণ নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। কিশোর-কিশোরীরা লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ি, সিগারেট টেনে কৌতূহল মেটালেও সেই কৌতূহলই এক সময় তাদের মদ, গাঁজা, আফিম, ভাং, মারিজুয়ানা, হেরোইন, পপি, কোকেন, ফেনসিডিল, এল এস ডি বিভিন্ন মাদকে আসক্ত করে ফেলে। সাধারণত নিঃসঙ্গতা, আপনজনের মৃত্যু, বেকারত্ব, পারিবারিক অশান্তি, ঝগড়াবিবাদ এমনকী প্রেমে ব্যর্থতাজনিত কারণেও অনেকের মনে হতাশার সৃষ্টি হয় এবং তা থেকে মুক্তি লাভের আশায় সঙ্গীদের পরামর্শ বা দেখাদেখি মাদক গ্রহণ শুরু করে এবং পরে নেশাগ্রস্ত হয়ে গেলে নেশার গতি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে তার নিজের তাগিদেই। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, অবৈধ আয় আর অপসংস্কৃতির প্রভাবও যে মাদকে আকৃষ্ট হওয়ার জন্য অনেকখানি দায়ী তা বলা যায়।

যে ভাবেই হোক না কেন, মাদক নামক এ মরণ নেশা একবার যাকে পেয়ে বসেছে তার মুক্তি মেলা সুকঠিন। মাদক সেবনের ইতিবাচক দিক তো নেই ই বরং এর নেতিবাচক প্রভাব মারাত্নকভাবে ফুটে ওঠে মাদকাসক্তের চেহারায় আর আচার-আচরণে দেখা দেয় অস্থিরতা।

নেশার খরচ যোগাতে জড়িয়ে পড়ে তারা চুরি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে। সমাজে বেড়ে যায় চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকাসক্তদের দেখা দেয় ক্ষুধামন্দা, ওজন কমা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস ও স্নায়ু দুর্বলতা। এছাড়া হৃদরোগ, যক্ষা, ক্যান্সার এবং শ্বাসকষ্টও হতে পারে। মানসিক দিক থেকে মাদক গ্রহণকারীরা হতাশার পাশাপাশি ভোগে হীনমন্যতায়ও। নিজের ক্ষতির পাশাপাশি সমাজেও সৃষ্টি করে নৈরাজ্য এবং বয়ে নিয়ে আসে পরিবারের বদনাম। বাড়ি থেকে পালানো বা নিরুদ্দেশ হওয়া এবং আত্নহত্যার মতো ঘটনাও ঘটে।

জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক কার্যালয়(ইউএনওডিসি) বিশ্ব মাদক প্রতিবেদন ২০২১-এর দেয়া তথ্য বলছে, ২০২০ সালে বিশ্বে মাদক নিয়ে অসুস্থ হয়েছেন ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ এবং মাদক নিয়েছেন ২৭ কোটি ৫০ লাখ মানুষ। বিশ্বের কিছু অঞ্চলে গত ২৪ বছরের মধ্যে শুধু ২০১৯ সালেই করোনা মহামারির সময় গাঁজা সেবনের হার বেড়েছে চারগুণ। ২০১০ থেকে ২০১৯ এর মধ্যে মাদক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে ২২ শতাংশ। সংস্থাটির ধারণা ২০৩০ সালের মধ্যে মাদক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।

এর মধ্যে শুধু আফ্রিকাতেই বৃদ্ধি পাবে ৪০ শতাংশ। ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে মাদক নেন, যাদের অর্ধেকই হেপাটাইটিস সি তে আক্রান্ত।

যেহেতু বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠিই তরুণ ও যুবক এবং তারাই উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রকৃত কারিগর। তাই মাদকাসক্তি নিয়ে প্রত্যেক বাবা, মা, অভিভাবকদের তো বটেই, এমনকী সমাজ ও রাষ্ট্রকেও উদ্বিগ্ন করে তুলছে। মাদকের ভয়ঙ্কর ছোবল থেকে কিশোর, কিশোরি ও যুবদের উত্তরণের সবচেয়ে ভাল ও কার্যকর পন্থা হলো- প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। এ জন্য সমাজে গুরুত্ব দিতে হবে নৈতিক শিক্ষাকে। ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষা দিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান,, বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া সংগঠনগুলো নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে মাদকাসক্তি প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে। পাঠ্যপুস্তক, রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, সিনেমা, নাটক, বিলবোর্ড, পোস্টার, লিফলেট এগুলোর মাধ্যমে মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে সৃষ্টি করতে হবে জনসচেতনতা। বন্ধ করতে হবে নেশাজাতীয় দ্রব্যের উৎপাদন ও বিজ্ঞাপন প্রচার। সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রচার করতে হবে মাদকের ভয়ঙ্কর পরিণতি সম্পর্কে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ওষুধ হিসাবে উৎপাদিত ও ব্যবহৃত দ্রব্যের। গড়ে তুলতে হবে মাদক ব্যবসা ও চোরাচালানের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ আন্দোলন, সৃষ্টি করতে হবে বেকার যুবকদের জন্য কর্মসংস্থান।

মানুষের কল্যাণের জন্য আবিষ্কৃত যে ওষুধ আজ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছে মাদকাসক্তি নিরোধকল্পে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) মনে করে এমন ওষুধের ব্যবহার বন্ধ করা আবশ্যক। মাদকের বিরুদ্ধে যেহেতু রবীন্দ্রনাথসহ অনেকেই কলম ধরেছিলেন, তাই বর্তমানেও মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে কবি, সাহিত্যিকদের এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের এটি ভুলে গেলে চলবেনা, 'সৎ সঙে স্বর্গ বাস, অসৎ সঙে সর্বনাশ।' ফেরাতে হবে আমাদের নতুন প্রজন্মকে অসৎ সঙ্গ ও মাদক সেবন থেকে। ফেরাতে হবে তাদেকে অন্ধকারাচ্ছন্ন, অনিশ্চিত এক ভবিষ্যত থেকে আলো ও নিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। সাথে এটিও মনে রাখতে হবে মাদকের ভয়াল থাবা থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব কেবলমাত্র রাষ্ট্রের নয়। সমাজ, পরিবার সবার। তবেই মাদকমুক্ত হয়ে গড়ে উঠবে আমাদের নতুন প্রজন্ম। আর সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

পিডিএসও/রি

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মাদকমুক্ত,যুব সমাজ,মুক্তমত
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close