লেফটেন্যান্ট কর্নেল নাজমুল হুদা খান

  ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১

কোভিড-১৯-পরবর্তী জটিলতা ও ভাবনা

কোভিড-১৯-এর হিংস্র থাবা আজ সারা বিশ্বে বিস্তৃত। উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু সর্বত্র প্রতিটি মানুষ করোনাভাইরাসের ভয়ে সন্ত্রস্ত। বিশ্বব্যাপী এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ২২ কোটি, প্রাণ নিয়েছে ৪৫ লাখেরও বেশি। প্রতিষেধক ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও প্রয়োগের পরও স্বস্তিতে নেই বিশ্বের কোনো প্রান্তের মানুষ। করোনাভাইরাস পাল্লা দিয়ে আলফা, বিটা, গামা, ডেল্টা, ল্যামডা, কাপ্পা, ডেল্টা প্লাস এবং মিউয়ের মতো একের পর এক ধরন পাল্টিয়ে সংক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। আগামী দিনে এ সার্স কোভিড-২ ভাইরাসের সঙ্গে লড়তে প্রয়োজনে মনোক্লোনাল এন্টিবডি বা সুপার এন্টিবডির মাধ্যমে চিকিৎসার কথা ভাবছে বিজ্ঞানীরা।

তারপরও যেন মুক্তি নেই। আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও এ ভাইরাসের প্রকোপ থেকে যাচ্ছে অনেক রোগীর দেহে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা যার নাম দিয়েছেন পোস্ট কোভিড সিন্ড্রোম বা ক্রনিক কোভিড সিন্ড্রোম, অনেকে বলছেন ‘লং হল কোভিড। তবে সবচেয়ে জনশ্রুত নাম হচ্ছে লং কোভিড। নামেই যায় চেনা; অর্থাৎ সাধারণভাবে দীর্ঘ সময় ধরে কোভিডের প্রকোপ দেহে অবস্থানকেই বলা হচ্ছে লং কোভিড। কতটা সময় ধরে কোভিডের এ কালো মেঘ দেহে অবস্থান করার সময়কে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর হেলথ অ্যান্ড কেয়ার এক্সেলেন্স (NICE) তিন ধাপে ভাগ করেছে। যথা- সংক্রমণ থেকে চার সপ্তাহ পর্যন্ত, ৪ থেকে ১২ সপ্তাহ এবং ১২ সপ্তাহের ঊর্ধ্বে। তবে বিভিন্ন দেশে কোভিড রোগীদের মধ্যে বিভিন্ন মেয়াদের প্রকোপ দেখা যায়। চীনের উহান সিটিতে প্রায় ছয় মাস, অনেক দেশে ৩৫ সপ্তাহ পর্যন্ত লং কোভিড রোগ শনাক্ত হয়েছে। সাধারণত কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর শতকরা প্রায় ৩০ ভাগের মধ্যে লং কোভিডের উপসর্গ পাওয়া যায়। যুক্তরাজ্যে এর সংখ্যা প্রায় ৩১ ভাগ, ইন্দোনেশিয়ায় ৬৩ এবং চীনের উহানে ৪৯ ভাগ। লং কোভিডে মৃত্যুর ঝুঁকিও আশঙ্কাজনক। নেচার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে ৮৭ হাজার লং কোভিড রোগীদের মধ্যে গবেষণালব্ধ ফলে দেখা যায়, সাধারণ মানুষের চেয়ে মৃত্যুর হার হাজারে প্রায় ৩০ জন বেশি।

লং কোভিড রোগীদের দেহে নানা ধরনের উপসর্গ দেখা যায়। প্রায় তিন সহস্রাধিক রোগীর মধ্যে গবেষণায় পঞ্চাশের অধিক উপসর্গ শনাক্ত করা হয়। যাদের মধ্যে অবসাদগ্রস্ততা, দীর্ঘস্থায়ী কাশি, পেশীর দুর্বলতা, মৃদু জ্বর থাকা, স্বাদ ও গন্ধ কমে যাওয়া, গলাব্যাথা, বুকে ব্যাথা, এসিডিটি, বুক ধরফর করা, কাজে মনোযোগহীনতা, স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া, হতাশা, দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, ডায়রিয়া, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্ত চাপ, চর্ম রোগ, কিডনি রোগ এবং রক্ত জমাট বাঁধা অন্যতম।

এ ভাইরাস দেহের সব অঙ্গ ও তন্ত্রের ক্ষতিসাধন করে থাকে। তবে শ্বাসতন্ত্র, রক্ত সংবহনতন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র, হরমোন ও গ্রন্থিতন্ত্র, রেচনতন্ত্র, চর্ম বা আচ্ছাদনতন্ত্র এবং পেশি ও হাড়জোড় তন্ত্রগুলো প্রধান লক্ষ্যস্থল।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্নের উদ্রেক হয়, কোভিড-১৯-এর লং কোভিডের কারণ কী? বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, মূলত চারটি কারণে এ রোগের উদ্ভব। প্রথমত, করোনাভাইরাস কর্তৃক ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত। দ্বিতীয়ত, ভাইরাসকে দমন করতে দেহের প্রতিরোধী কোষগুলোর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব। তৃতীয়ত, ভাইরাস কর্তৃক দেহের রক্তনালিগুলোতে ক্ষত ও রক্ত জমাট বাঁধা ব্যাহতকরণ এবং চতুর্র্থত, করোনাভাইরাস কর্তৃক কিডনির পরিস্রাবণ প্রক্রিয়ায় জটিলতা প্রভৃতি। মানুষের দেহে এতসব ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা লং কোভিড নিয়ে চিন্তিত। বিশেষ করে বয়স্ক, স্থূলকায়, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হাঁপানিসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগে ভুগছেন এমন ব্যাক্তিদের মধ্যে লং কোভিড হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বেশি। নারীদের মধ্যে পুরুষদের তুলনায় এ পর্যন্ত অধিক হারে এ রোগ শনাক্ত হয়েছে বলে বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে। এ কারণে উন্নত বিশ্বের প্রায় সব দেশে; বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অন্য দেশগুলোর বিভিন্ন জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থা লং কোভিড শনাক্ত, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্যে এ রোগের জন্য পৃথক বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় এ রোগের ব্যবস্থাপনায় গাইডলাইন প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ লং কোভিড শনাক্তকরণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনার জন্য পৃথক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।

করোনাভাইরাসের ধরন ও প্রকৃতি শনাক্তকরণ, প্রতিকারে ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও প্রয়োগসহ নানাবিধ স্বাস্থ্যবিধি প্রণয়নের পরও বিশ্ব থেকে একে নিশ্চিহ্ন কবে নাগাদ করা যাবে, সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান। তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ না সব জায়গায় করোনা সংক্রমণ কমে, তত দিন অতিমারি চলবে। এমতাবস্থায় করোনার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব লং কোভিডের প্রভাব সময়সম্মত প্রতিরোধ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসতে না পারলে মানুষের শারীরিক সুস্থতা, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বাধাগ্রস্থ হবে এতে সন্দেহ নেই।

লং কোভিড মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরই মধ্যে এ বিষয়ে গবেষণা, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার কর্মপরিধিও কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এতে এ রোগ নির্ণয় পদ্ধতি, রেফার এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার চার্ট সুপারিশ করা হয়েছে। কোভিড-১৯-এর ব্যবস্থাপনা গাইডলাইনে লং কোভিড বিষয়ে ভিন্ন অধ্যায় সন্নিবেশ করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি এবং ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব কার্ডিওলজি এ রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার গাইডলাইন প্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশ কোভিড-১৯ আক্রান্ত একটি দেশ। আমাদের দেশে এ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ লাখ ছাড়িয়েছে। লং কোভিডের প্রভাব যে আমাদের মধ্যে রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে তাতে সন্দেহ নেই। সুতরাং কোভিড নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি লং কোভিডের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট সবার বিশেষভাবে নজর দেওয়া প্রয়োজন।

লেখক : সহকারী পরিচালক

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ঢাকা

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কোভিড-১৯,মহামারি,করোনাভাইরাস
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close