লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান
করোনাযুদ্ধে মাস্কই প্রধান অস্ত্র
চীনের উহানে কোভিড-১৯ আবির্ভাবের পর থেকেই সতর্ক ছিল বাংলাদেশ। দ্রুত ৩৬৩ জন বাংলাদেশি নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে এনে কোয়ারেন্টাইন ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এ বৈশ্বিক মহামারি বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশে। ৮ মার্চ ২০২০ প্রথম করোনা আক্রান্ত শনাক্তের পর এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরণে কোয়ারেন্টাইন, শনাক্তকরণ, আইসোলেশন, কন্ট্রাক্ট ট্র্যাসিং, লকডাউন থেকে শুরু করে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সব কার্যক্রম গ্রহণ করে বাংলাদেশ।
করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে জনগণকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধকরণ, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানো, দেশের মানুষের জীবনযাত্রাকে সচল রাখা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মতো চ্যালেঞ্জিং কার্যক্রমগুলো সফলতার সঙ্গে অদ্যাবধি পাশাপাশি চলছে। দেশে করোনা চিকিৎসার সক্ষমতা বৃদ্ধিতে হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি, নতুনভাবে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল স্থাপন, গুরুতর অসুস্থ রোগীদের নিবিড় পরিচর্যার জন্য আইসিইউর সংখ্যা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। দেশের সবাইকে করোনা সুরক্ষায় গণটিকা প্রদানের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্বের সম্ভাব্য সব উৎস থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহ ও প্রদান শুরু হয়েছে।
করোনা প্রতিরোধ যুদ্ধে আমরা আইসিইউ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও ভ্যাকসিনের নানাবিধ বিষয় নিয়ে সদা সোচ্চার। প্রকারান্তরে কোভিড-১৯ প্রতিরোধের মূলমন্ত্র স্বাস্থ্যবিধি মানা, বিশেষ করে সর্বাত্মক মাস্ক ব্যবহারের প্রচলনটি অনেকটাই উপেক্ষিত। এ বিষয়ে যথাযথ সচেতন হলে এ মরণঘাতী ব্যাধির বিরুদ্ধে যুদ্ধটা অনেকটা সহজতর হতো।
আইসিইউ বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত জটিল ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা ব্যবস্থা। আর্থিক সমৃদ্ধি থাকলেও রাতারাতি নতুনভাবে এ ব্যবস্থা সংযোজন করা সময়সাপেক্ষ ও দুরূহ। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে হৃদরোগীদের সেবায় আইসিইউ (ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট) বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের যাত্রা। সারা দেশে এর সংখ্যা ৪০০তে উপনীত হতে সময় লেগেছে প্রায় ৩০ বছর। দেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি হিসেবে আইসিইউ শয্যা সংখ্যা ১২৮৭টি। বিভিন্ন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের এসব আইসিইউ বেড মেডিকেল, সার্জিক্যাল, ট্রমা, বক্ষব্যাধি, স্নায়ুরোগ, বার্ন, হৃদরোগ, হৃদশল্য চিকিৎসা ইত্যাদি শ্রেণির রোগীদের জন্য নির্ধারিত। এসব আইসিইউর প্রায় ৬৫ শতাংশ মেডিকেল ও সার্জিক্যাল, ২০ শতাংশ হৃদরোগী, ১০ শতাংশ হৃদশল্য, ২ শতাংশ বার্ন, স্নায়ু ও অন্যান্য জটিল রোগীর জন্য ব্যবহৃত হয়। কোভিড-১৯ অতিমারি শুরুর পর থেকে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোয় করোনা রোগীদের জন্য এসব আইসিইউ ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে সংশ্লিষ্ট জটিল রোগীরা আইসিইউ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমাদের দেশে আইসিইউতে দক্ষ চিকিৎসক ও নার্সেরও অভাব রয়েছে। দেশের ৬০ ভাগ আইসিইউ আবেদন বিশেষজ্ঞ কর্তৃক পরিচালিত হয়। ১০ ভাগ নিবিড় পরিচর্যা বিশেষজ্ঞ এবং বাকি ৪০ ভাগ হৃদরোগ, স্নায়ুরোগ বা মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা পরিচালনা করে থাকেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় কিছুটা বিঘ্ন ঘটে। প্রকৃতপক্ষে নিবিড় পরিচর্যা বিশেষজ্ঞরাই এসব রোগীর যথাযথ চিকিৎসা প্রদানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সারা দেশে বর্তমানে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞের সংখ্যা মাত্র ৪৩ জন। তবে বর্তমানে প্রতি বছর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ১৮ জন চিকিৎসক এ বিষয়ে ৫ বছরের উচ্চতর প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা রয়েছে। আইসিইউতে ভর্তি রোগীদের ২৪ ঘণ্টা সেবায় নিয়োজিত থাকে নার্সরা। আইসিইউতে নার্স/ রোগীর অনুপাত ও চাহিদার তুলনায় অনেক কম। এসব নার্সের বেশির ভাগ নিবিড় পরিচর্যার ওপর অ্যাকাডেমিক প্রশিক্ষণ নেই। এ নার্সদের মাত্র ৪০ ভাগ বেসিক লাইফ সাপোর্ট এবং সিপিআরের ওপর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত।
আইসিইউতে ব্যবহৃত মেডিকেল যন্ত্রপাতি সবক্ষেত্রেই বিদেশনির্ভর। এসব যন্ত্রপাতি আমদানি করতে কমপক্ষে ৬ মাস থেকে ১ বছর প্রয়োজন হয়। অকার্যকর হয়ে পড়লে মেরামতও দুষ্কর। দেশের হাসপাতালের আইসিইউগুলো অর্ধেকেরও বেশি ক্ষেত্রে ইসিজি মেশিন, ইকো মেশিন, আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন ও ল্যাব সুবিধা নেই। স্থাপনাসহ সব সুবিধা থাকার পরও নতুন একটি সাধারণ মানের ১০ শয্যাবিশিষ্ট আইসিইউ স্থাপন করতে কমপক্ষে ২০ কোটি টাকার প্রয়োজন। সুতরাং দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা, দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী, দুর্লভ যন্ত্রপাতির অপর্যাপ্ততার কারণে সদিচ্ছা থাকলেও পর্যাপ্ত পরিমাণে আইসিইউ সেবা চালুর বাস্তব অবস্থা কঠিন।
তদপুরি এআইএসপিওর তথ্য মতে, বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোর শয্যা সংখ্যার ৬ শতাংশ আইসিইউ শয্যার সুবিধা রয়েছে; যেখানে চীনে ৩ শতাংশ, জাপানে ৩ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ৯ শতাংশ ও সৌদি আরবে ১০ শতাংশ মাত্র।
পক্ষান্তরে স্বাস্থ্যবিধির প্রধানতম হাতিয়ার সর্বাত্মক যথাযথভাবে মাস্ক পরিধান। মাস্ককে কোভিড-১৯ প্রতিরোধের অন্যতম অস্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল। ২০২০ সালের জুন মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জুলাই মাসে সিডিসি করোনা প্রতিরোধে মাস্ককে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে বর্ণনা দিয়ে বিশ্ববাসীকে সর্বাত্মক মাস্ক ব্যবহারের নির্দেশনা দেন। সিডিসি মাস্ককে একটি অত্যন্ত সহজলভ্য ও কার্যকরী করোনা প্রতিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করে।
মাস্ক করোনা সংক্রমণ থেকে ৯০ ভাগ সুরক্ষা দেয়। আক্রান্ত ও সুস্থ ব্যক্তি যদি মাস্ক পরিধানরত থাকে, তাহলে দুজনের সংক্রমণের হার মাত্র ১.৫ শতাংশ। ২০২০ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরী প্রদেশের এক স্যালুনে দুজন কোভিড-১৯ আক্রান্ত হেয়ার স্টাইলিস্ট মাস্ক পরিধানরত অবস্থায় ১৩৯ জন সুস্থ মানুষের চুল কাটার পর পরীক্ষায় দেখা যায়, তাদের কেউই করোনায় আক্রান্ত হননি। চীনের বেশকটি গবেষণায় দেখা যায়, মাস্ক পরিধানের কারণে প্রায় ৮০ শতাংশ লোক করোনা আক্রান্ত হওয়া থেকে রেহাই পেয়েছে। যুক্তরাজ্যের ৮টি বাণিজ্যিক বিমানে গবেষণায় দেখা যায়, কর্তৃপক্ষের মাস্ক ব্যবহারে কড়াকড়ির কারণে ২ হাজার যাত্রীর মধ্যে কেউই করোনায় আক্রান্ত হয়নি। অথচ অপর একটি বিমানে মাস্ক পরার ব্যাপারে ঢিলেঢালা নীতির কারণে ২৫ জন করোনা আক্রান্ত হয়। থাইল্যান্ডে ৮৩৯ জনের মধ্যে এক গবেষণায় দেখা যায়, শুধু মাস্ক পরার কারণে তাদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ শতকরা ৭০ ভাগ হ্রাস পায়। মাস্ক পরার কারণে পূর্ব এশিয়ায় ৭০ শতাংশ, জার্মানিতে ৯০ শতাংশ করোনা সংক্রমণ কমে যায়। কানাডার ওয়ান্টারিও শহরের ৩৫টি জনস্বাস্থ্য অঞ্চলে মাস্ক ব্যবহারের অভ্যাসের কারণে প্রতিদিন ২৫ণ্ড৩৫ শতাংশ করোনা সংক্রমণ হ্রাস পায়।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, মাস্ক করোনা সংক্রমণ ইনডেক্সকে ১-এর নিচে কমাতে সক্ষম। যার অর্থ হলো করোনা সংক্রমণ স্থায়ীভাবে নিম্নমুখী হয়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. মনিকা বলেন, মাস্ক শুধু সংক্রমণই কমায় না; এটি কোভিড-১৯ রোগের তীব্রতা ও মৃত্যুহারও কমায়। তারা যুক্তরাষ্ট্রের বেশকটি প্রদেশে মাস্কের ওপর পরীক্ষায় এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন।
আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা যায়, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের মাত্র ৫ শতাংশ রোগীর আইসিইউ সেবার প্রয়োজন হয় এবং একটি আদর্শ আইসিইউ সেবা ভর্তি রোগীদের শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ মৃত্যু হ্রাস করতে সক্ষম অর্থাৎ মোটের ওপর শতকরা ২.৫ শতাংশ মৃত্যু কমাতে ভূমিকা রাখে। কিন্তু আইসিইউ স্থাপন, বিশেষজ্ঞ জনবল তৈরি, প্রশিক্ষণ, যন্ত্রপাতি স্থাপন ও মেরামত একটি জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হয়; যা অত্যন্ত দীর্ঘসূত্র ও ব্যয়বহুল।
অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সিডিসিসহ অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান সহজেই প্রমাণ করে, কোভিড-১৯ সফল প্রতিরোধ যেকোনো দেশের জন্য অত্যন্ত সহজলভ্য ও কার্যকরী করোনাপ্রতিরোধী অস্ত্র হচ্ছে মাস্ক। এটি বায়ু, শ্বাস ও ধূলিকণাবাহিত করোনাভাইরাসসহ শ্বাসনালির মাধ্যমে অন্যান্য সংক্রামক রোগও প্রতিরোধ করে। মাস্ক আমাদের হাতের সংস্পর্শে আসা জীবাণু অসচেতনভাবে নাকে-মুখে প্রবেশে বাধা দেয়।
শেষ কথা, দেশের মানুষকে সুরক্ষিত করতে এরই মধ্যে গণটিকা প্রদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে এবং দেশের মোট জনসংখ্যার ২.৬ শতাংশ পূর্ণ ডোজ এবং ৩.৬ শতাংশ প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছে। পুরো জনসংখ্যাকে এর আওতায় আনতে সময়ের প্রয়োজন। স্বাস্থ্য খাতের একটি বিশাল জনবল এ টিকা প্রদান কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত রয়েছে এবং থাকতে হবে। স্বাভাবিকভাবে অন্যান্য রোগের রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হবে। স্বাস্থ্যবিধির ব্যত্যয় কোভিড-১৯ সংক্রমণের তীব্রতা ও দ্রুততা বৃদ্ধি আশঙ্কাজনক অবস্থায় উপনীত করবে; দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হবে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সচেতন নাগরিক হিসেবে সার্বজনীনভাবে আমরা সহজলভ্য করোনাপ্রতিরোধী অস্ত্র মাস্কের সর্বাত্মক ব্যবহারে নিজে উদ্বুদ্ধ হই এবং অন্যকে সচেষ্ট করে তুলে দেশকে করোনামুক্ত করতে আত্মপ্রত্যয়ী হই।
লেখক : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা।
পিডিএসও/ জিজাক