এম এ মাসুদ

  ২৮ জুলাই, ২০২১

যোগ্যতা নয়, জ্যেষ্ঠতাই যখন যোগ্যতা

সন্দেহ নেই, জন্ম সময় বা তারিখ অনুযায়ী যিনি আগে ভূমিষ্ঠ হয়েছেন, সুন্দর এ ধরণির আলো দেখতে পেয়েছেন তিনিই জ্যেষ্ঠ। এমনকি একই মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া জমজ ভাই-বোনের ক্ষেত্রেও জ্যেষ্ঠতা শব্দটি সমভাবে প্রযোজ্য।

বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, 'যারা বড়দের শ্রদ্ধা করে না এবং ছোটদের স্নেহ করে না, তারা আমার উম্মত নন।' গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের মতে, 'মানুষকে সম্মান দিতে শেখো, এতে করেই নিজেও সম্মান পাবে।'

হোক না তারা কয়েক মিনিট, ঘণ্টা, দিন বা মাসের বড়, শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত বয়োজ্যেষ্ঠরা সবার নিকট সম্মান বা শ্রদ্ধার পাত্র। কোনো কথা কিংবা আচরণে তারা ব্যথিত হন, এমনটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। মানুষের মানবিক গুণাবলিগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি গুণাবলি হচ্ছে বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা আর ছোটদের প্রতি স্নেহ, ভালোবাসা প্রদর্শন করা। আর একে অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেই তো গড়ে ওঠে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক।

এমন মানবিক মূল্যবোধের জন্যই সমাজে নেমে আসে শান্তি আর মূল্যবোধের অবক্ষয়ে নেমে আসে বিশৃঙ্খলা বা অশান্তি। জ্যেষ্ঠদের সম্মান এবং কনিষ্ঠদের স্নেহ করা শুধু পরিবার বা সমাজেই নয়, সকল কর্মক্ষেত্রেও পদমর্যাদা অনুযায়ী ঠিক একইভাবে প্রযোজ্য।

কিন্তু শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় যদি সরকারি বিধিমালার ব্যত্যয় ঘটিয়ে টাকার জোরে কিংবা প্রভাব খাটিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আনুকূল্য পেয়ে কিংবা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা ব্যতিরেকেই প্রভাষক পদের মত গুরুত্বপুর্ণ পদে নিয়োগ পান এবং এমপিওভুক্তির তারিখ অনুযায়ী জ্যেষ্ঠ হন, সে ক্ষেত্রে উচ্চতর গ্রেডে পদোন্নতি নিয়ে সিনিয়র ও জুনিয়রদের মধ্যে যে তিক্তভাব বা জটিলতার সৃষ্টি হয় তা সহজেই বোধগম্য।

এমপিওভুক্ত বে-সরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় নাম সর্বস্ব শিক্ষাগত যোগ্যতা, কম্পিউটার শিক্ষা, নিবন্ধন এবং অভিজ্ঞতার সনদ নিয়ে অতীতে সহকারি শিক্ষক ও প্রভাষক পদে নিয়োগ পেয়েছেন অনেকেই। বছর কয়েক আগে প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনামে দেখেছিলাম '৬০ হাজার শিক্ষকের সনদ জাল!' শিক্ষা বিষয়ক একটি অনলাইন দৈনিকে শুভ্র চক্রবর্তী নামে এক নিয়োগ প্রার্থী লিখেছেন, 'জাল সার্টিফিকেটধারী শিক্ষকদের হাসি বনাম মেধাবীদের দীর্ঘশ্বাস।' এমন খবরগুলো কারও অজানা নয়।

নীতি-নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের পৃষ্ঠপোষকতায় নিয়োগ পাওয়া নাম সর্বস্ব শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রভাষকদের তৃতীয় শ্রেণি/বিভাগ প্রাপ্ত সার্টিফিকেটের ফটোকপিতে দ্বিতীয় শ্রেণি/বিভাগে পরিবর্তন করে কেউ বা সহকারি অধ্যাপকের পদ (৬ষ্ঠ গ্রেড), কেউ বা টাইম স্কেল(৭ম গ্রেড) বাগিয়ে নিয়েছেন এবং পদোন্নতির পথ রুদ্ধ করে দিয়েছেন তারা মেধাবীদের। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখা যায় পরে নিয়োগ পাওয়া যোগ্যতা সম্পন্ন প্রভাষকদের অনেককেই।

২৪ অক্টোবর ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী কলেজ ও মাদ্রাসায় ( কামিল, ফাজিল বা আলিম) প্রভাষক পদে কামিল দ্বিতীয় শ্রেণিসহ সকল পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণি/বিভাগ এবং প্রভাষক(সাধারণ/বিজ্ঞান) পদে দ্বিতীয় শ্রেণির মাস্টার্স ডিগ্রীসহ সকল পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণি/বিভাগ থাকতে হবে। অথচ কামিল কিংবা মাস্টার্সে তৃতীয় শ্রেণিসহ একাধিক পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগ/শ্রেণি পাওয়া এমন শিক্ষকও রয়েছেন। ফলে ২০০৫ সালের(১ম নিবন্ধন) পর প্রভাষক পদে যে সমস্ত শিক্ষক যোগদান করেছেন তারা অনুপাত প্রথার যাতাকলে পড়ে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক বা সহকারি অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি(উচ্চতর গ্রেড) থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ওইসব অবৈধ নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্য যারা কিনা আগে এমপিওভুক্ত হওয়ার যুক্তিতে জ্যেষ্ঠ হয়েছেন, পেয়েছেন বা পাচ্ছেন পদোন্নতি।

২৩ নভেম্বর ২০২০ সংশোধিত এমপিও নীতিমালায়(মাদ্রাসা) প্রভাষকগণের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে এমপিওভুক্ত প্রভাষকগণ প্রভাষক পদে এমপিওভুক্তির ৮ বছর পুর্তিতে ৫০% জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ সাপেক্ষে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক(আলিম মাদ্রাসা) এবং সহকারি অধ্যাপক (ফাজিল, কামিল মাদ্রসা) পদে পদোন্নতি পাবেন। জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রথম এমপিওভুক্তির তারিখ হতে গণনা করা হবে। তবে এমপিওভুক্তির তারিখ একই হলে যোগদানের তারিখ বিবেচনা করা হবে। যোগদানের তারিখ একই হলে জন্ম তারিখের ভিত্তিতে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করা হবে। জন্ম তারিখ একই হলে যার শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশি তিনি জ্যেষ্ঠ হবেন।

গত ২৮ মার্চ প্রকাশিত স্কুল-কলেজের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২১ জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে এমপিওভুক্ত প্রভাষকগণ প্রভাষক পদে এমপিওভুক্তির তারিখ থেকে ৮ বছর চাকরি পুর্তিতে মোট পদের ৫০% নির্ধারিত বিভিন্ন সূচকে মোট ১০০ নম্বরের মূল্যায়নের ভিত্তিতে 'জ্যেষ্ঠ প্রভাষক' (উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ) এবং সহকারি অধ্যাপক( ডিগ্রী কলেজ) পদে পদোন্নতি পাবেন।

উভয় নীতিমালা অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এমপিওভুক্তির তারিখ প্রাধান্য পাওয়ায় প্রয়োজনীয় সকল যোগ্যতা সম্পন্ন প্রভাষকগণ পদোন্নতিতে পেরে উঠতে পারছেন না অযোগ্যতা সম্পন্ন প্রভাষকগণের সাথে। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, 'যোগ্যতা নয়, জ্যেষ্ঠতাই যোগ্যতা।'

কেমন করে শিক্ষাগত যোগ্যতার অভাব থাকা প্রভাষকগণ এমপিওভুক্ত হলেন? এর জবাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলছেন, আগে প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ হাতাহাতি অর্থাৎ সরাসরি এমপিওভুক্তির ব্যবস্থা করতেন। তাই ফলাফল না দেখেই এমপিওভুক্ত হয়েছে।

সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা অন্যায় করতে পারেন না এবং ন্যায় বোধের উৎস হচ্ছে জ্ঞান এবং অন্যায় বোধের উৎস হচ্ছে অজ্ঞতা। সক্রেটিসের এমন বিশ্বাস মনে হয় ভুল প্রমাণিত হচ্ছে অযোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ গড়ার কারিগরদের কাছে।

সে যাই হোক, যোগ্যতার অভাব রয়েছে এমন শিক্ষকদের পদোন্নতি বন্ধসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকগন যাতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো হয়রানির শিকার না হন বা অগ্রাধিকার পান সেই বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কমিটি এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এমন বিশ্বাস শিক্ষক সমাজের। আর যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকগণ পদোন্নতি পেয়ে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে মানসম্মত পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবেন, সেই প্রত্যাশা আমাদেরও।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
যোগ্যতা,জ্যেষ্ঠতা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close