রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৬ জুলাই, ২০২১

ভিন্ন এক বাস্তবতায় ঈদুল আজহা

ত্যাগের মহিমা নিয়ে ঈদুল আজহা উদযাপন করবে সৌদি আরবসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা। প্রতি বছরের মতো এবারও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন দেশে ঈদুল আজহা পালিত হবে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, ১৬ মাস পার হয়ে গেল করোনার নিত্যনতুন রূপান্তরিত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে লড়াই করতে করতে। তারপরও সংক্রমণকে ঠেকানোর মতো উপায়, অবলম্বন এবং কৌশল এত দিনে মানুষের নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে বিপরীত চিত্র আমাদের হতাশ এবং উদ্বিগ্ন হওয়ার মতোই।

আসছে বহুল প্রতীক্ষিত কোরবানির ঈদ। মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবের আর এক মহাআয়োজন তো বটেই। দেশি গরুর হাট বসা থেকে শুরু করে সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় গরু আমদানি সবই এক অসহনীয় দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে পার করতে হবে। এবার বলা হচ্ছে, দেশি গরুই কোরবানির চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট। ভারত থেকে পশু আমদানি কোনোভাবেই সমীচীন হবে না। তবে এরই মধ্যে অনলাইনভিত্তিক কার্যক্রমে পশু কেনা থেকে সার্বিক তত্ত্বাবধানে গুছিয়ে দেওয়া সবই শেষের পর্যায়ে। সবার পক্ষে তেমন প্রযুক্তির বলয়ে যুক্ত হওয়া আসলে সম্ভব কি না, তাও বিবেচনার দাবি রাখে। কিন্তু দ্বিতীয় কার্যক্রমে সরাসরি পশুর হাটে সম্পৃক্ত হওয়া এবং কোরবানি দেওয়া, মাংস গোছানো সবই করতে হবে আবাসিক এলাকায়। যা কতখানি স্বাস্থ্যবিধি নিয়মের আওতায় আসবে, সেটাও বলা মুশকিল। তার ওপর আমরা উৎসবপ্রিয় জাতি। উৎসবে, উদযাপনে, আয়োজনে আমরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানকেও সাড়ম্বরতায় ভরিয়ে তুলি।

এমনকি যারা সৌদি আরবে হজ পালন করতে যান, তাদের থেকেও জানা গেছে কোরবানির দিন দুম্বা কিংবা ভেড়া জবাই করে কিছু মাংস ঘরে নিয়ে আসা হয়। বাকি মাংসগুলো সরকারি প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে অন্য দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তেমন মাংসের সঙ্গে পরিচয় আমাদেরও আছে। তবে আমাদের চিরাচরিত ঐতিহ্যে ধর্মীয় বিশেষ বিশেষ পর্যায়কে যেভাবে সাজিয়ে তোলা হয়, তা একেবারে বাঙালির সমৃদ্ধ বোধ আর নিজস্ব চেতনায়। আর আবহমানকালের এমন ধর্মীয় সংস্কৃতির মধ্যেই আমাদের জন্ম, বসবাস এবং সামনে এগিয়ে চলাও। সুতরাং জাঁকজমকের নিয়মের ব্যত্যয় কখনো হয়নি, এবারও তার ব্যতিক্রম আশাও করা যায় না।

করোনা শনাক্তের হার কমতে না কমতেই বন্যায় বিপর্যস্ত হয়েছে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন। তাই এবারের ঈদ উপলক্ষে আলাদা কোনো চিন্তা নেই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের। আসন্ন ঈদুল আজহা নিয়ে বন্যায় সংকটপূর্ণ বানভাসি সাধারণ মানুষের এবারের ঈদ যেন গত বছরগুলোর অন্যান্য ঈদ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পাঁচ মাস ধরে করোনাভাইরাসের কারণে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মান আগের তুলনায় অনেকটা থমকে গেছে। অন্যদিকে এই বছর করোনাভাইরাসের প্রকোপ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই বন্যা যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে উঠেছে। মহামারি করোনাভাইরাসের মধ্যে বন্যার এই প্রাদুর্ভাব যেমন জনজীবনকে বিপর্যস্ত করেছে; তেমনি অর্থনৈতিকভাবে হতাশাগ্রস্ত করেছে সাধারণ মানুষকে।

সারা বিশ্ব করোনার বহুল সংক্রমণে নাজেহাল। তার সঙ্গে বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। মহামারি এই ভাইরাসটি এখন সারা দেশে ভয়ংকরভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। শুধু তাই নয়, শনাক্ত এবং মৃত্যুর হারও ঊর্ধ্বগতির পর্যায়ে। উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে পড়েছে এক অবাঞ্ছিত দুর্দশা। বাংলাদেশ অতিক্রম করছে এক দুঃসহ ক্রান্তিকাল। সীমিত আকারে বারবার লকডাউন দেওয়া হচ্ছে সেই এপ্রিল, মে এবং জুন মাস থেকে। সম্প্রতি ১৪ দিনের কঠোর লকডাউন পার করল বাংলাদেশ। দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় ভারতীয় নতুন ভ্যারিয়েন্ট আশঙ্কাজনকভাবে ছড়ানোর যে অসহনীয় দাপট, তাতে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা ক্রমেই বাড়ছে। গত বছরের এ সময়ে করোনার বহুল সংক্রমণে রাজধানী ঢাকার অবস্থা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছলেও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে মোটামুটি নিরাপদ দূরত্বেই ছিল বলা যায়। ফলে গ্রামগঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে অতিসাধারণ নিম্নবিত্তের খেটে খাওয়া মানুষকে সেসময় করোনা মোকাবিলা করতে হয়নি।

২০২০ সালের এপ্রিল-মে যথার্থ লকডাউনের মধ্যেই ১ বৈশাখ, পবিত্র রমজান মাস এবং ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর পালিত হয় সীমিত আকারে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধিকে আমলে নিয়েই। কিন্তু ঈদের আয়োজনে শেকড়ের টানে গ্রামে ছুটে যাওয়ার করুণদৃশ্যও হতাশ হওয়ার মতোই ছিল। প্রায় দেড় বছর ধরে করোনার সঙ্গে ক্রমাগত লড়াইয়ে মানুষ কেমন যেন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। এ বছরের এপ্রিল, মে ও জুন মাসে অনেক কিছু ছাড় দিয়ে যে স্থবিরতার নির্দেশনা আসে, তাতে স্বাস্থ্যবিধি মানা তো হয়ইনি বরং অযাচিতভাবে লঙ্ঘন করার চিত্র সত্যিই হতবাক হওয়ার মতো। আর তার দাম দিতে হচ্ছে সারা দেশের অসচেতন মানুষদের। নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে মানুষ যেন কেমন বেপরোয়া এবং অস্থির হয়ে উঠেছে। সময়টা তো একেবারে কমও নয়। আবার নাড়ির টানে গ্রামের বাড়ি ছুটে যাওয়াও ঈদের অপরিহার্য উৎসব আয়োজন। ১ জুলাই থেকে যে কঠোর বিধিতে সারা দেশকে আটকে দেওয়া হয়েছে সেখানে অনেকের দেশের বাড়ি চলে যাওয়ার দৃশ্য উঠে এসেছে। আর ৭ দিন পরেই পবিত্র কোরবানির ঈদ। সংগত কারণে যারা গেছে তাদের কর্মস্থলে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। নতুন লকডাউনে রাজধানী ঢাকা তার চিরাচরিত যানজটের অসহনীয় চিত্র বহাল তবিয়তে সময় পার করলেও ১ জুলাই থেকে অন্য দৃশ্যে বৃহত্তর এই নগরীকে অবলোকন করা যাচ্ছে। এ মুহূর্তে রাজধানীসহ সারা দেশ শান্ত, নিরাপদ এবং যানজটশূন্য। সুতরাং কোরবানির ঈদে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার ঢল হয়তো আর দেখা নাও যেতে পারে। কারণ সময় এখন খুব বেশি হাতেও নেই। যারা যাওয়ার তারা সবাই নিজ নিজ গন্তব্যে চলেও গেছেন। ঈদের আগে যে বাড়তি চাপ সড়ক-মহাসড়ক এবং গণপরিবহনে, সেটা বোধহয় আর হবে না। বরং ঈদের পরে ফিরে আসার যে অসহনীয় ঢল তাতে করোনার নতুন সংক্রমণ বয়ে নিয়ে আসার সম্ভাবনা থাকবে।

মানুষ যদি নিজের ভালোটা নিজেই বুঝতে পারে, সেটাই অপেক্ষাকৃত মঙ্গল। যেমন নিজের জন্য একইভাবে দেশের সার্বিক কল্যাণের পর্যায়কেও নিরাপত্তায় আগলে রাখে। তবে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতিতে শুধু যে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, তা কিন্তু নয়। পাশাপাশি চিকিৎসাসামগ্রীর যথার্থ ঘাটতিও চোখে পড়ার মতো। যা বাংলাদেশের ঢাকা ছাড়া অন্যান্য বিভাগীয় শহর, জেলা, উপজেলা এবং গ্রামগঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে দৃষ্টিকটুভাবে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। রাজশাহী, খুলনা ও সাতক্ষীরা এসব অঞ্চলে করোনার অত্যধিক প্রাদুর্ভাবে মৃতের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়াই শুধু নয়, চিকিৎসা সরঞ্জামের সংকটও এক বিব্রতকর অবস্থায় চলে যাচ্ছে। বিশেষ করে অক্সিজেনের প্রয়োজনীয় সরবরাহ একেবারে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠিত হওয়ার মতো। আর আইসিইউর অতুলনীয় সংকটাপন্ন রোগীদের প্রাসঙ্গিক চিকিৎসাও ব্যাহত হওয়ার চিত্র সংশ্লিষ্টদের বিপদের ঝুঁকি বাড়িয়ে চলেছে। সারা দেশে যেভাবে করোনার চরম সংক্রমণ অতীতের রেকর্ডকে অতিক্রম করে যাচ্ছে, সে মাত্রায় প্রাসঙ্গিক চিকিৎসার অভাবও অনেক দুর্ভাগ্য রোগীকে মরণের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। গত বছর কঠোর অবরুদ্ধতার দুঃসময়ে সারা বিশ্ব করোনার নৃশংস ছোবলে আক্রান্ত হলে সৌদি আরব হজ পালনে অন্যান্য দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে সেবার কেউ হজ পালনের জন্য মক্কা কিংবা মদিনায় যেতে পারেননি। অবস্থা দেখে মনে হয়, এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। কারণ আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলে এরই মধ্যে কঠোর বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। বহির্বিশ্বের সব বিমান যোগাযোগে যে রুদ্ধতার জাল ফেলা হচ্ছে, সেখান থেকে আপাতত মুক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত নেই। ফলে এবারও বাংলাদেশের মানুষ হজ পালনের জন্য পবিত্র কাবা শরিফ দর্শনে যেতে পারবেন না। এমন ধারণাই ব্যক্ত করা সংগত। ঈদের জামাতও গণজমায়েতের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত না হওয়ার সতর্কতা তো সরকারের পক্ষ থেকে আসা বাঞ্ছনীয়।

যাহোক স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা ময়দানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তা পালন করার নির্দেশনা এরই মধ্যে দেওয়াই আছে। সবচেয়ে বিপন্ন অবস্থার শিকার হতে হবে পশুর হাটে। তা ছাড়া নতুন সংক্রমণে সয়লাব ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের অনুপ্রবেশের আশঙ্কায়। কারণ সীমান্ত যতই কঠোর অবস্থানে যাক ভারতীয় গরু আসাকে কীভাবে প্রতিরোধ করা হবে, সেটাও এক অনিশ্চয়তার বিষয়। গরু কেনা ছাড়াও মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ করা এক সংকটময় ব্যাপার। এখানে লোকবল অবধারিত বিষয় বলে স্বাস্থ্য সুরক্ষা আমলে নেওয়াও অত সহজসাধ্য হবে না। কারণ মানুষ এখন অবধি তার নিজের সুরক্ষাকে খুব বেশি তোয়াক্কাও করছে না। তার ওপর ধর্মীয় উৎসব পালনের ক্ষেত্রে কতখানি সহনশীল এবং পরিমিত হবে, তাও দেখার অপেক্ষায় আমরা সবাই। এবার আমাদের মাঝে এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ঈদুল আজহা এসেছে। বিশ্বজুড়ে মহামারি করোনাভাইরাসের থাবা। বাংলাদেশেও এ অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণ। প্রতিদিনই আক্রান্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। অনেকে মৃত্যুবরণ করছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, অর্থনীতির অবস্থাও নাজুক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ পরিস্থিতিতে জনকল্যাণমুখী নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। ঘোষণা করেছেন নানা প্রণোদনা। ফলে গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে। এতকিছুর পরও আমরা মনে করি, করোনাভাইরাস মহামারির সব অন্ধকার কাটিয়ে ঈদুল আজহা সবার মাঝে আনন্দ বয়ে আনবে।

কোভিড-১৯-এর উদ্ভূত দুর্যোগময় পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে ধৈর্য, সাহস ও শক্তির প্রয়োজন। আমরা বিশ্বাস করি, সে শক্তি আমাদের আছে। ঈদুল আজহা আমাদের শান্তি, সহমর্মিতা, ত্যাগ ও ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা দেয়। সঞ্চারিত করে আত্মদান ও আত্মত্যাগের মানসিকতা। এ মর্ম অনুধাবন করে সমাজে শান্তি ও কল্যাণের পথ রচনা করতে আমাদের সংযম ও ত্যাগের মানসিকতায় উজ্জীবিত হতে হবে। পবিত্র ঈদুল আজহার আনন্দ ও ত্যাগের অনন্য মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক দেশের প্রতিটি নাগরিকের জীবন। সবাই ভালো থাকুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, সুরক্ষিত থাকুন। দূরত্ব বজায় রেখে ঈদ জামাতসহ প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করি। সবাইকে আবারও জানাই পবিত্র ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ঈদুল আজহা,কোরবানি,মুক্তমত
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close