রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৬ জুন, ২০২১

সচেতন হতে হবে প্রযুক্তি ব্যবহারে

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আদিকাল থেকে সভ্যতার সিঁড়ি বেয়ে মানুষ তার প্রয়োজনে সামাজিকভাবে জীবনযাপনের লক্ষ্যে কিছু নিয়মনীতি, শৃঙ্খলাবোধ ও আইন প্রথা মেনে চলে। যদিও জনগণের কল্যাণ মূলত আইনের উদ্দেশ্য তবু সব সময় সর্বক্ষেত্রে আইন ন্যায়বিচার ও নীতির ওপর অটল থাকে না। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই আইনের দৃষ্টিতে সমান এই কথাটি সবাই বললেও মূলত তা পুরোপুরি সঠিক নয়। যদিও আইন কোনো ব্যক্তি বা বিশেষ মোকদ্দমার জন্য প্রণীত হয় না, তবু গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আইনের শাসন ও মানবাধিকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মানুষ নিজকে সভ্য করার চেষ্টা করছিল সেই আদিকাল থেকে, যা এখনো নিরন্তর। আদিকালে মানুষের ভাষাজ্ঞান, পরিসংখ্যান ও তথ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার সম্পর্কে তাদের জ্ঞান ছিল না। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ সব সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সে যুগের মানুষকে বর্বর বা অসভ্য ভাবা হলে ও তারা বর্তমানে একশ্রেণির মানুষের মতো অমানবিক ছিল না। সামাজিক নীতিশাস্ত্র একটি ধারণা, যা ব্যক্তির নৈতিক আচরণের পাশাপাশি তাদের সম্মিলিত বাস্তবতা এবং তাদের ব্যক্তিত্বের সংমিশ্রণের সঙ্গে সম্পর্কিত। এটা সব সম্পর্কে লোকরা তাদের শারীরিক ও নৈতিক সততা এবং অন্যের প্রতি সম্মান রেখে অন্যের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বাঁচতে সক্ষম হতে হবে এমন আচরণের নীতিমালা। মূল্যবোধের দীনতা এবং নৈতিকতার বিচ্যুতি সমাজে ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন ঘটনায় প্রায়ই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় পরিবার ও সমাজের দায় এবং আমাদের বিপরীতমুখী যাত্রার প্রবণতা ও বাসনা।

সমাজের মূল্যবোধচর্চার নিম্নগামিতার সুযোগেই নানামুখী নেতিবাচক প্রপঞ্চগুলো যাপিত জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে সমাজ-সংসারে বিঁধছে। একসময় এ সমাজে সামাজিক অসংগতি-অস্থিরতা ও অসামাজিক ক্রিয়াকলাপ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চোখ লজ্জার অস্তিত্ব থাকলেও বিশ্বায়ন এবং প্রযুক্তির প্রসারে আজ এসব অতীত এবং কারো কাছে গেয়ো এবং সেকেলের মানসিকতা বলে বিবেচিত হয়। যেকোনো দেশের উন্নয়ন কখনো টেকসই হতে পারে না, যদি সে দেশের মানুষ সভ্য ও মানবিক না হয়। কোনো দেশে যদি মানবতা, মানবাধিকার, গুম, খুন, জুলুম, একক আধিপত্য, বিরোধী মতবাদকে উপেক্ষা করা হয়, তখন ওই দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিনষ্ট হয়, যা কখনো কাম্য নয়।

মানবাধিকার বলতে এমন কিছু অধিকারের সমষ্টিকে বোঝায়, যা একজন মানুষ সমাজে বসবাস করলে স্বাভাবিকভাবে সে যা লাভ করে, সে অধিকার যা অহস্তান্তর যোগ্য, অক্ষয় ও অন্তনির্হিত থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় মানবাধিকারের যে তত্ত্বসমূহ দেখা যায় তম্মধ্যে প্রকৃতিবাদী মতবাদ, প্রত্যক্ষবাদী মতবাদ, ঐতিহাসিক মতবাদ ও সমাজতাত্ত্বিক মতবাদ মূলত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সমাজতাত্ত্বিক মতবাদের মূল উপজীব্য মানুষ তাই এই মতবাদ অনুযায়ী আইন প্রণয়নের পদ্বতি হচ্ছে সমাজকে নতুনভাবে নির্মাণ করা। সমাজকে বিনির্মাণে প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবাধিকারের যে রূপ বর্তমানে রয়েছে, তা পাশ্চাত্য সভ্যতারই ফল। অন্যদিকে বিশ্বের কিছু ধনী রাষ্ট্রের নিছক স্বার্থের কারণে আজ বিশ্বমানবতা হুমকির মুখে পড়েছে। বর্তমান বিশ্বে মানবতা একটি নিছক ভন্ডামিতে পরিণত হয়েছে।

প্রত্যেক সমাজ, পরিবার এবং সম্প্রদায়ই তার পথচলায় বেশ কিছু অলিখিত আচার-আচরণ নৈতিক মানদন্ড প্রথা বিধি মূল্যবোধে অভীষ্ট হয়ে সামাজিক বন্ধন নির্ভরশীলতা বিশ্বাস নিরাপত্তা এবং অকৃত্রিম তৃপ্তি ও সন্তুষ্টি পাওয়ার মানসে নিয়ত নিযুক্ত। এসব বিধিবিধান মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অনুশীলন চর্চা এবং আমরা মনোভাবে সম্পৃক্ত হয়ে সমাজ-সংসারে বেঁচে থাকার অক্সিজেন এবং রসদ জুগিয়ে মানব মনে স্বস্তি ও আস্থার আভায় সম্পৃক্ত থেকে সামনে আগাতে শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে। এ যেন এক অকৃত্রিম বন্ধন। যেখানটায় আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্তের বাঁধন গোষ্ঠীগত সংযুক্তি সব সময় না থাকা সত্ত্বেও সবার মাঝেই আন্তরিকতা ও ভালোবাসার প্রতিধ্বনিত অনুরণিত হয়।

শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ভোগবাদী মানসিকতা এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্রীকরণের লাগামহীন প্রসারে আমাদের মনন মেধায় অস্তিত্বে যান্ত্রিকতা ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় সামাজিক সম্পর্ক রীতিনীতি বন্ধন ভালোবাসায় কোথায় যেন ছেদ পড়েছে। কেন জানি মনে হয় সমাজ কি পারছে তার নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি অলিখিত বিধি আঁকড়ে ধরে সম্মুখ পানে নিজেদের নিয়ে যেতে! কোথায় যেন অসামঞ্জস্যতা? মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি হলো যূথবদ্ধভাবে পারস্পরিক মিলেমিশে সুখে-দুখের সঙ্গী হয়ে সহযোগিতা সহানুভূতি ভালোবাসা প্রীতি আবেগকে পুঁজি করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখা। সামাজিক জীবের তকমায় ভূষিত মানবজাতি। যারা কি না সমাজের বিবর্তনের নানা পথ বেয়ে বিজ্ঞানের অভাবনীয় সাফল্যের সুফল ভোগ করে সময়ের ধারাবাহিকতায় গ্লোবাল ভিলেজের বাসিন্দার পরিচয়ে অজান্তেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে।

সমাজে সুদ ঘুষকে ঘৃণার চোখে দেখা হতো। যেসব লোক এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল সমাজের অন্যরা তাদের সঙ্গে মেলামেশায় দূরত্ব বজায় রাখত। গ্রামে অনেকটা এক ঘরে বসবাস করত। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আজ এসবের উৎস না খুঁজে অবলীলায় তাদের সঙ্গে অভিযোজন ঘটিয়ে অজান্তেই সুদ-ঘুষকে বৈধতা দিয়ে এসবের চর্চায় মগ্ন থাকছি। এ মানুষরাই কি না নামে-বেনামে দান-খয়রাত উপঢৌকন এবং সামাজিক কাজে নিজেদের জড়িয়ে হাতেম তাঈয়ের লকব গায়ে মাখছে। সমাজ কি পারছে তার কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে? ইগো দ্বন্দ্ব এ সমাজে নানাভাবে জেঁকে বসেছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার মতামতকে পায়ে পিষে নিজের দৈন্যতা এবং দাম্ভিকতার প্রভাবে অনেক সময় কর্তাব্যক্তিদের মিথ্যার আশ্রয় নিতে হচ্ছে।

ভাবার সময় এসেছে। ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তির আশীর্বাদের সুফল সব বয়সের শ্রেণি-পেশার মানুষেরই ভোগ করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু একবার কি ভেবেছি টিনএজারদের হাতে এসব ডিভাইস তুলে দিয়ে আগামী প্রজন্মকে বিপথগামী করছি না তো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অবাধ ব্যবহারের সুযোগে অসম সম্পর্ক অপরাধের বিস্তৃতি বলগাহীন চলাফেরা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। প্রজন্মের হাতে এসব তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে পরিবার কি একবারও ভেবেছে এসবের পরিণতি কী হতে পারে? পরিবারের প্রয়োজনীয়তা এবং অস্তিত্বের কারণেই মানবসমাজের এক বিশেষ স্থান রয়েছে। মানুষ সারা জীবনব্যাপী শিক্ষা লাভ করে। এমনকি মৃত্যু অবধি সে ভুল করে এবং শিখে। পারিবারিক আবহে এবং পরিমন্ডলে শিশুরা যে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সবক পায়, তা পরবর্তী জীবনে চলার বাতিঘর হিসেবে কাজ করে। পরিবার কি পারছে তার কাঙিক্ষত দায়িত্ব পালন করতে!

মূল্যবোধ ও নৈতিকতার গুণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা। এ তকমা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। হেন কোনো অনিয়ম স্বার্থপরতা এবং পাপাচার নেই, যার সঙ্গে মানবকুলের সম্পর্ক নেই। নৈতিকতার বিচ্যুতি সামাজিক বন্ধনের শিথিলতা রীতিনীতি নিয়ম প্রথার যথার্থ অনুশীলনের ঘাটতির সুবাদেই এসব হচ্ছে। একে থামানো দরকার। এ ক্ষেত্রে পরিবারই পারে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে। যার হাত ধরেই সমাজ-সংসারে সুদিন ফিরতে পারে। পারিবারিক বন্ধন ভালোবাসা শাসন পরিচর্যা মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার মাঝেই এ দৈন্যতার অবসানের স্বপ্ন দেখা যেতে পারে। প্রযুক্তির অপব্যবহার আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরকে ধ্বংস করে দিতে পারে। প্রযুক্তির অপব্যবহারে মানুষ যেভাবে ডুবে আছে তাতে ভবিষ্যতে আমরা একটি মানবিকতাশূন্য প্রজন্ম পেতে পারি। এর বেশি নয়। প্রযুক্তি ডিভাইস আবিষ্কৃত হয়েছিল জরুরি প্রয়োজন মেটানোর জন্য। সারা রাত ধরে কথা বলার জন্য নয়। প্রযুক্তি বন্ধ করে নয়। তবে কিছু কিছু বিষয় অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং তা সম্ভব। মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য যেমন মাদকের সরবরাহ বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হয়; তেমনি প্রযুক্তির খারাপ জিনিস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মোবাইলে একজন মানুষ কতটুকু কী দেখতে পারবে, কী কী কাজে এর ব্যবহার হবে, সে ক্ষেত্রেও একটা নিয়ন্ত্রণ ও সীমা আরোপ করা উচিত। সবকিছু সবার হাতে তুলে দেওয়া উচিত নয়। এখন মোবাইলের মধ্যে সবকিছু ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাই এর ব্যবহারের সঠিক তদারকি করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি যেভাবে অবাধ আর সহজ করে দেওয়া হয়েছে পৃথিবীর কোনো দেশে এটা নেই। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার এখানে মহামারি আকার ধারণ করেছে। বিশ্বের কোনো দেশে এত সহজে, এত সস্তায়, এত বিষয় কারো হাতের মুঠোয় নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ১৮ বছরের নিচের ছেলেমেয়েদের ফেসবুক ব্যবহারের বিষয়ে বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে ঘরে ঘরে ওয়াইফাই ঢুকে গেছে আর শিশুর হাতে রয়েছে এর পাসওয়ার্ড। এসব প্রতিকারের উপায় হিসেবে রাষ্ট্রকে সবার আগে ঠিক করতে হবে আমরা আসলে কী চাই, কোথায় যেতে চাই। সেজন্য আজ দেশের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি ঐক্যের জায়গায় আসতে হবে এবং সবাই মিলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ধ্বংসাত্মক প্রবণতা ও পরিণতি থেকে রক্ষা করতে হবে। সমাজে অনেক পরিবর্তন এসেছে। মানুষের কাছে এখন চাহিদা পূরণই আসল বিষয়। কীভাবে পূরণ করা হলো, সেটা মুখ্য বিষয় নয়। নৈতিকতা আর মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে মানুষ তার আকাক্সক্ষা পূরণের ক্ষেত্রে এখন সামনে কোনো বাধা এলেই হত্যাকে বেছে নিচ্ছে সহজ পথ হিসেবে। ভোগের আকাঙ্ক্ষা তীব্র আকার ধারণ করছে আমাদের মধ্যে। আজকে অবাধে ছড়িয়ে পড়া তথ্যপ্রযুক্তি, গণমাধ্যম নানামুখী চাহিদা ভোগের আকাঙ্ক্ষাকে তীব্র থেকে তীব্রতর করছে। পাশাপাশি সন্তানদের প্রতি মা-বাবার মনোযোগের অভাব, ধর্মীয় এবং নীতিনৈতিকতা চর্চার অভাবে ছড়িয়ে পড়ছে নানাবিধ অনাচার। এ ছাড়া ভোগবাদিতা, অধিক পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, সবকিছুতে তীব্র প্রতিযোগিতা। রাজনৈতিক অনিয়ম অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা, নৈতিকতাচর্চার অভাব, সমাজে ছড়িয়ে পড়া অন্যায়-অনাচারের কম-বেশি শিকার আজ সব শ্রেণির মানুষ। ফলে মানুষ সহজেই বিবেকশূন্য হয়ে হিংস্রতায় লিপ্ত হয়ে পড়ছে, যা কোনো সভ্যসমাজের কাম্য হতে পারে না।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মুক্তমত,সচেতনতা,অবক্ষয়
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close